ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
বৌদ্ধ শাস্ত্রে আছে যে বুদ্ধদেব বহুবার বহুরূপ নিয়ে জন্মেছিলেন এবং প্রত্যেক জন্মেই সুকৃতির ফলে শেষবার বুদ্ধদেব হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর এই অতীত জন্মকাহিনীগুলো বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘জাতক’ নামে পরিচিত। এই জাতক থেকে বুদ্ধদেবের একটি জন্মের কথা বলছি, —শোনো।
প্রাচীন ভারতে মিথিলা নামে এক সমৃদ্ধিশালী নগর ছিলো। এই নগরীর পূবদিকে একগণ্ড গ্রামে বোধিসত্ত্ব জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তিনি অতুল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে শৈশব থেকে ন্যায় অন্যায় বিচারের ক্ষমতা ছিল তাঁর অদ্ভূত।
ঐ গ্রামের একদিকে এক দরিদ্র চাষী বাস করত। সেবার আসন্ন বর্ষা দেখে সে অনেক দূর গ্রাম থেকে চাষের জন্য কয়েকটা বলদ কিনে এনেছিল। চাষের কাজ তখনো আরম্ভ হয়নি, তাই একদিন সে গরু গুলোকে মাঠে চরাতে নিয়ে গেলো। গরু চরাতে চরাতে শ্রান্ত হয়ে এক গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়লো। একজন চোর দূরে একটি গাছের আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করছিল এবং মাঠে চাষার গরুগুলোকে চুরি করে নিয়ে যাবার মতলব আঁটছিল। চোর মনে মনে ভাবছিল যদি চাষা ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে সে গরুগুলো নিয়ে সরে পড়বে। এই ভেবে সে গরুগুলো নিয়ে যেই কিছুটা এগিয়েছে, অমনি চাষার ঘুম গেল ভেঙ্গে। সদ্য ঘুম থেকে উঠে চোরকে গরু নিয়ে পালাতে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল এবং বলল— ‘কিরে আমার গরু নিয়ে কোথায় পালাচ্ছিস?’
চোর কোন রকম সংকোচ না করে বলল, ‘সে কি রে আমার গরু আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
চাষা বলল, ‘বাঃ আমার গরু তোর হল কবে থেকে?’ চোর এতে আরো বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আমার গরুকে তোর গরু বলছিস, এতবড় মিথ্যা বলতে তোর এতটুকু লজ্জা হলো না রে।’
চাষা বলল, ‘সেদিন এ-গরুগুলো আমি কিনে আনলাম, আজ তুই কিনা বলছিস্ আমার গরু, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল তো!’
এ নিয়ে কৃষক ও চোরের তর্কাতর্কি ঝগড়ায় পরিণত হল। তারা ঝগড়া করতে করতে সুবিচারের প্রত্যাশায় বোধিসত্ত্বের কাছে গেল। ইত্যবসরে তাদের ঝগড়া দেখে সেখানে অনেক লোক উপস্থিত হল। বোধিসত্ত্বের কাছে পৌঁছে তারা উভয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করতে লাগল। বোধিসত্ত্ব তাদের ঝগড়া ও নালিশ শুনেই এক পলকে বুঝতে পারলেন কে চোর আর কে প্রকৃত গরুর মালিক। বুঝেও তিনি বিষয়টা সকলের কাছে প্রকাশ করবার জন্য প্রথমে চোরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচছা ভাই, তুমি আজ গরুগুলোকে কি খাইয়েছে?’ চোর চটপট উত্তর দিল, ‘সে অনেক কিছু, —জাউ, মাষকলাই, তিলের খোল আরো কত কি?’
বোধিসত্ত্ব তখন একটু হেসে বললেন, ‘বেশ’। তারপর প্রকৃত গরুর মালিকের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তুমি বল ভাই এবার, —আজকে তুমি কি খাইয়েছ গরুগুলোকে?’ চাষী কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘আমি গরীব চাষা, এত ভাল খাবার দেবার পয়সা কোথায় পাব? আমি এদের মাঠে চরাই— শুধু ঘাস খাইয়েছি।’
ব্যাপার দেখে গ্রামের অনেক লোক জড়ো হয়েছিল সেখানে। বোধিসত্ত্ব কৌতূহলী জনতার মাঝখান থেকে একজনকে ডেকে কতগুলো পিয়ঙ্গু পাতা (এক রকম গাছের পাতা) আনতে বললেন এবং পাতাগুলো বেটে গরুগুলোকে খাইয়ে দিলেন। পাতাবাটা খাওয়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে গরুগুলো বমি করে টুকরো টুকরো ঘাসের ডগাগুলো বার করে দিল। বোধিসত্ত্ব চোরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘এবার বল ত চোর কে? তুমি না ও।’
ধরা পড়ে চোরের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এবং ভয়ে সে কাঁপতে লাগল। বোধিসত্ত্ব তাকে অভয় দিলে সে ক্ষীণস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ আমিই চোর।’ যেই চোর স্বীকার করল যে সে চোর অমনি সমবেত জনতা তাকে ঘিরে ধরে বেদম মারতে লাগল। বোধিসত্ত্ব তাড়াতাড়ি তাদের থামিয়ে দিয়ে তাকে মারমুখী জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে ভবিষ্যৎ জীবন সৎভাবে যাপন করবার জন্য অনেক উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, ‘কখনো চুরি করোনা, চুরি করা মহাপাপ। চুরি করলে সারাজীবন দুঃখেই কাটে। পরকালেও তার গতি হয় দুঃখময় নরকে।’
ছোটদের কথা, ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ থেকে পুনর্মুদ্রিত