ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
৯ মার্চ ২০২৫ রবিবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ নীলাদিকে ফোনে জানতে চাই কেমন আছেন একবার যাব কি? উত্তর আসে চলে আসুন। রেডিই ছিলাম ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ি মনসুরের রিকসায়। মিনিট পনেরর মধ্যেই পৌঁছে যাই। প্ৰায় ঘন্টা খানেক ছিলাম। অশক্ত শরীরে বিছানায় শায়িত সহাস্য নীলা কর। ছয় দশকের বেশী সময়কাল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে, দুচার কথায় সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। ১৯৭৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী বর্ষে মেয়েদের জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা ভাবেন তিনি।পত্রিকার নাম ঠিক করেন দূর্বা, পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটির শিরোনাম দেন আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ বিশেষ সংখ্যা সেই সময়ে কলকাতার বাইরে মফঃস্বল শহর থেকে পত্রিকা বিশেষ করে মেয়েদের পত্রিকা প্রকাশ ছিল পত্রপত্রিকা প্রকাশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তেমনই ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে কল্পনা সুর এর সম্পাদনায় বর্ধমানের বোরহাটস্থ পান্নালাল সরকারের শ্রীলেখা আর্ট প্রেস থেকে কেবলমাত্র শিশু কিশোরদের জন্য সচিত্র মাসিক পত্রিকা “ছোটদের কথা” প্রকাশের ঘটনাও বাংলা শিশু সাহিত্যে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আজও প্রকাশিত হচ্ছে ছোটদের কথা।
এবার আসি ঐ রবিবার ঘন্টা খানেক নীলাদির সঙ্গে আলাপচারিতা নিয়ে দুচার কথায়। সেদিন এই প্রথম নীলাদি এত আন্তরিক এবং স্বচ্ছন্দ ভাবে ১৯৬৪ সালে দিনাজপুর থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার কঠিন সংগ্রামের দিনগুলি থেকে এপর্যন্ত নানা কথার স্মৃতি চারণ করে গেলেন।
কথায় কথায় কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমি ছোটদের কথার প্রথম সংখ্যা থেকে ডিজিটাল করে ওয়েবসাইটে রেখেছি। তাই কী মনে হল ওঁকে জিজ্ঞেস করি ওঁর কাছে দূর্বা’র প্রথম সংখ্যা আছে নাকি। আমার প্রশ্নে বিছানার মাথার কাছ থেকে বার করে দিলেন দূর্বা’র প্রথম সংখ্যাটির একটি কপি। সুন্দর প্রচ্ছদ উল্টে সূচিপত্র, সম্পাদকীয় এবং দুএকটি লেখায় চোখ বুলিয়ে মনে হল শুধু ঐতিহাসিক সংরক্ষণের জন্যই নয়, পঞ্চাশ বছর পর আজও এই সংখ্যাটির আবেদন বর্তমান নারীমুক্তি আন্দোলনে নারী পুরুষ উভয়ের কাছেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে সমাজজীবনে বৈদিক যুগ থেকে তৎকালীন সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে বত্রিশটি প্রবন্ধ, কবিতা গল্প সাজিয়ে সযত্নে দুই মলাটের মধ্যে নির্ভুল দৃষ্টিনন্দন ভাবে মাত্র তেত্রিশ বছরের এক নারীর এই প্রচেষ্টা এক অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি। আর আজকের শিশুদের ভবিষ্যত ভেবে মাতা পিতাদের কাছে এই দূর্বা’র দুই মলাটে আবদ্ধ নারী পুরুষের সম্মিলিত বিশ্ব মানবিক মূল্যবোধের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব “ছোটদের কথা”রও আছে। তাই যখন এই সংখ্যার পুনর্মুদ্রণের অনুমতি চাইলাম নীলাদি সানন্দে অনুমতি দেন। হাতের সামনে ছিল নিজের দুটি বই আমার হাতে তুলে দেন। ওঠার সময় আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বলেন, আপনি নয় ‘তুমি’ অনেক আপন, কাছের, তুমি বলবে। ওঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা না বলে ঐদিনই দূর্বার কপিটি নিয়ে এলাম না। এব্যাপারে নীলাদির অন্যতম স্নেহধন্য ডঃ গোপা সামন্তকে বিষয়টি মেসেজ করে ওঁর মতামত চাই। উনি প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং একটি ভূমিকা লিখে দিতেও রাজী হন। ১৮ মার্চ বিকেলে নীলাদিকে ফোন করলে বলেন, খুব অসুস্থ আজকে আসবেন না। কিছুক্ষণ পরেই পত্রিকাটি হাতের কাছে পেয়ে আবার আমাকে ফোন করে পত্রিকাটি নিয়ে আসতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওঁর কাছে পৌঁছে দেখি খুবই অসুস্থ। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে দূর্বা’র নারী বর্ষ সংখ্যাটি নিয়ে আসি। রাতেই যিনি ডিজিটাল করে দেবেন তাঁকে ফোন করে সব বলি এবং পরের দিনই ১৬০ পৃষ্ঠা স্ক্যান করে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। ওঁকে দশদিনের সময় দিই, খুব দুরূহ কাজ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রুফ দেখে ফেরৎ পাঠানো আরও দুরূহ কাজ। প্রুফ দেখার দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন ছোটদের কথা’র সম্পাদক বিপাশা চট্টোপাধ্যায়। যাইহোক শেষপর্যন্ত কাজটা যে করা গেছে এটাই সমস্ত উদ্যোগ, পরিশ্রমের সাফল্য। এই সঙ্গে এর মুদ্রিত কপিও ছাপা হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে মুদ্রিত কপিটিও অনেকের কাছেই সমাদৃত হবে।
ধীরেন্দ্রনাথ সুর
৩ মার্চ ২০২৫