ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
বীন্দ্রনাথের হাত ধরে দোল অন্য মাত্রা পায়। নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক এই উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আজও প্রতি বছর দোলের দিন সকালবেলায় প্রভাতফেরি বের করে আশ্রমিকেরা। তারা দল বেঁধে— ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল’ গানটি গেয়ে বসন্তোৎসবের সূচনা করে। সন্ধ্যাবেলায় গৌরপ্রাঙ্গণে কবিগুরুর কোনও না কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়। তা দেখতে শুধু এ দেশের নানা কোণ থেকেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করে। রবীন্দ্রনাথ উৎসব ভাবনায় ছিলেন এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্বপ্নের ‘কর্মতীর্থভূমি শান্তিনিকেতন’ ও শ্রীনিকেতনে কবির আশীর্বাদে ও শুভেচছায় বারো মাসে পার্বণের সংখ্যা তেরোরও বেশি। তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে সব উৎসবের একটা মৌলিক দিক হল— প্রকৃতি ও মানুষের অমলিন মৈত্রীর সেতু নির্মাণের আন্তরিক প্রয়াস। এক অনন্য নান্দনিক পরিমণ্ডলে শান্তিনিকেতনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল কবিগুরুর হাত ধরে। ঋতু উৎসব হিসাবেই শুরু হয়েছিল। সময়টা ছিল ১৯০৭ সাল। এটাই ইতিহাস। তদানীন্তন ছাত্রাবাস ‘প্রাককুটির’-এর সামনে থেকেই এই উৎসব শুরু হয়েছিল। কবি পুত্র শমীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রজীবনী-কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ১৭ ফেব্রুয়ারির সেই উৎসবে ‘শমীন্দ্র এবং আরো দুইজন ছাত্র বসন্ত সাজে, একজন সাজে বর্ষা; আর তিনজন হয় শরৎ।’ ‘রবিজীবনী’-কার প্রশান্তকুমার পাল অবশ্য পাঁজি- পুঁথি ঘেঁটে জানিয়েছেন, সেবছর ‘শ্রীপঞ্চমী’ পড়েছিল ১৮ জানুয়ারি। প্রভাতকুমার সেই উৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। শমীন্দ্রনাথের একটি পত্রাংশ থেকে তিনি নাকি সেদিনের উৎসবের বিবরণ পেয়েছিলেন। তবে ‘শ্রীপঞ্চমী’ তিথিতে পরবর্তী সময়ে শান্তিনিকেতনে ‘বসন্তোৎসব’ উদযাপিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২৫ সালে প্রথম বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেই বছর কবি বিদেশে পাঁচ মাস কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন আশ্রমে ভরা বসন্ত। ছাব্বিশে ফাল্গুন বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। সেবার ঝড়, জলের জন্য আম্রকুঞ্জে অনুষ্ঠান হয়নি। সেকালে পুরোনো লাইব্রেরির দোতলায় কলাভবনের ঘরে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘‘রুদ্রবেশে কেমন খেলা
কালো মেঘের ভ্রুকুটি
সন্ধ্যাকাশের বক্ষ যে ওই
ব্যবধানে যায় টুটি।’’
সেকালের প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে আরো নিবিড়ভাবে গড়ে তোলার জন্য ‘মাস্টারমশাই’ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু শালবীথি আর আম্রকুঞ্জের গাছের গায়ে নানান রঙের উত্তরীয় বেঁধে সাজিয়ে দেওয়ার এক অপূর্ব শিল্পের সূচনা করেছিলেন। প্রমথনাথ বিশী-র লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইটিতে এই দিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন— ‘সেবারে বসন্তোৎসব খুব ধুম করিয়া হইবে স্থির হইল। রবীন্দ্রনাথ নূতন গানের পালা লিখিয়া গানের দলকে শিখাইয়া তুলিলেন। আম্রকুঞ্জের সভাস্থল আলপনা ও আবিরে সজ্জিত হইল, আমের ডালে ডালে বাতির ব্যবস্থা হইল, সকলে পীতবর্ণের ধুতি ও শাড়ি পরিয়া প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল— পূব আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠিলেই সভারম্ভ হইবে।’ ১৯৩৫ সালে ২০ মার্চ সকালে আম্রকুঞ্জের বসন্ত উৎসব উদ্যাপিত হয়েছিল। ‘ফাল্গুন’ নাটকের কিছু অংশ কবি পাঠ করেছিলেন। এর আগে তিনি উৎসবের মূল কথাটি বলেন সংক্ষেপে।
পুঁথি-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পঞ্চানন মণ্ডল লিখেছেন ‘১৯৩৭ সালে ১৩ ফাল্গুন (১৩৪৩) মাঘীপূর্ণিমা তিথিতেই আশ্রমে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় গৌরপ্রাঙ্গণে সেবার সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান হয়। সেই বছরই ২৬ মার্চ (১২ চৈত্র) দোলপূর্ণিমার দিনে দ্বিতীয়বার বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। এখনকার মতন তখনও বৈতালিক দল ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ গানটি গেয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ করে। ড. পঞ্চানন মণ্ডল আরও লিখেছেন— ‘সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীভবন হইতে আশ্রমিকদের নৃত্য ও সংগীত সহযোগে শোভাযাত্রা আসিল মঙ্গলঘট লইয়া আম্রকুঞ্জ পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ বসিয়া আছেন বটবৃক্ষমূলের ঘণ্টাতলায়। ছোট মেয়েরা আবিরে গুরুদেবের পা রাঙা করিয়া দিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের বসন্ত সংগীতের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটিল।’
উৎসবের আগের রাতে গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে ‘ও আমার চাঁদের আলো’ গানের সঙ্গে শালবীথিতে পথ ধরে এগিয়ে চলে বৈতালিকে সূচনা হয় বসন্ত বন্দনার— ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ গান দিয়ে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত বরণ— যার শুরু ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল’ আর অনুষ্ঠানের শেষ— ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে’ —এই সমবেত গান দিয়ে। সকালে এক স্নিগ্ধ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বসন্তের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দেওয়া হয় বৈদিক মন্ত্র, গানে, পাঠে, নাচে, কবিতায়। ‘যা দিল কালোধলো’ —এই গান শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় বর্ণময় আবির খেলা। শান্তিনিকেতন পত্রিকা’র ৪র্থ বর্ষ মাঘ সংখ্যা সূত্রে জানা যায় ‘শ্রীপঞ্চমী’ উপলক্ষ্যে আশ্রমে সেবার ১৩২৩ সালে মহাসমারোহে ‘বসন্তোৎসব’ আয়োজন করা হয়েছিল। সংবাদে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘এইদিন সন্ধ্যাবেলায় গুরুদেব ছাত্রীদের লইয়া কলাভবনে গান করিয়াছিলেন। ছাত্রীরা সকলেই বাসন্তী রঙে ছোপানো শাড়ী পরিয়াছিল, মাথায় সকলের ফুল গোঁজা ছিল। পূজনীয় গুরুদেব রং-এর পোষাক পরিয়া তাহাদের মধ্যে বসিয়া ছিলেন।’
১৯২৬ সালে বসন্তোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৪ চৈত্র ১৩৩২ তারিখে। অনুমান করা যায়, এই দিনটিতেই ছিল বসন্ত পূর্ণিমা। সেবার ‘নটরাজ’-এর ‘আবাহন- গীতিকা’ (‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’) নৃত্যছন্দে অভিনীত হয়েছিল। ১৯৩১-এর ৪ মার্চ লাইব্রেরির বারান্দায় (বর্তমান পাঠভবন অফিস) বসন্তোৎসব উপলক্ষ্যে ‘নবীন’ নাটিকাটির অভিনয় হয় আজ থেকে একাশি বছর আগে ১৯৪০ সালের ২৭ মার্চ, রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতন বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন। সেবারে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিংহ সদনে। এর পরের বছর, ১৯৪১ সালে অসুস্থতার কারণে কবি বসন্ত উৎসবে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। সেবারের বসন্ত উৎসবের দিনে কবি লিখেছিলেন—
‘আর বার এল উৎসবের দিন
বসন্তের অজস্র সম্মান
রুদ্ধকক্ষে দূরে আছি আমি—
এ বৎসর বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।’