ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
স্নেহের ছোট্ট বন্ধুরা,
এই সংখ্যায় তোমাদের সামনে কিছু লিখতে যেয়ে এপ্রিল মাসে ১৪ তারিখটার কথা মনে হল। তোমরা প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের সময় যাঁকে স্বাধীন ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণেতা হিসেবে শ্রদ্ধা জানাও সেই ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের জন্মদিন হল ১৪ এপ্রিল, যাঁকে স্মরণ করে ১৪ এপ্রিল আম্বেদকর জন্মজয়ন্তী পালনের জন্য সরকারী ছুটির দিন পালিত হয়। ভারতের এই মহান বিশ্ববরেণ্য আম্বেদকরের ছোটবেলা এবং শিক্ষা জীবনের কিছু কথা আজ তোমাদের কাছে রাখব।
আম্বেদকর ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল বর্তমান মধ্যপ্রদেশের মোহ শহরে (বর্তমান যার নাম আম্বেদকর নগর) জন্মগ্রহণ করে এক দলিত পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন পরাধীন ভারতে ইংরেজ সেনাবাহিনীর হাবিলদার। সেই সময়ে সমাজে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে এই দলিত শ্রেণীর মানুষজন অস্পৃশ্য বলে গণ্য হত। এদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জল স্পর্শ করতে পারতো না। বেশীর ভাগ দলিত ছেলেমেয়েরা শিক্ষাঙ্গণে যেত না। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেই আম্বেদকরের শৈশব কেটেছে। মুষ্টিমেয় কিছু দলিত ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বেশীর ভাগই বেশী দূর এগোতে পারত না। বিদ্যালয়ে দলিত ছেলেমেয়েদের, উচ্চবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের থেকে আলাদা করে বসার ব্যবস্থা হত। হতদরিদ্র সেই দলিত ছেলেমেয়েদের উচ্চবর্ণের শিক্ষকরা স্পর্শ করতেন না। এদের কপালে জুটতো নানা রকমের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। এদের বিদ্যালয়ে এসে জল পিপাসা পেলে বিদ্যালয়ের পিয়ন দূর থেকে জল ঢেলে দিত। যেদিন পিয়ন আসত না সেদিন দলিত ছেলেমেয়েদের জল না খেয়ে থাকতে হত। পরবর্তীকালে আম্বেদকর লিখেছেন, ‘নো পিয়ন নো পানি’। আম্বেদকরকে বাড়ি থেকে চটের বস্তা নিয়ে যেতে হত বিদ্যালয়ে বসার জন্য। আম্বেদকরের পিতা রামজী সাকল সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার পর ১৮৯৭ সালে সপরিবারে বোম্বাই বর্তমানে মোম্বাইয়ে চলে আসেন, সেখানে এলফিনস্টোন হাই স্কুলে আম্বেদকরকে ভর্তি করান হয়। আম্বেদকরই ছিলেন একমাত্র দলিত ছাত্র। ১৯০৬ সালে তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে ৯ বছরের বালিকার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়।
১৯০৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমান মাধ্যমিক) পাশ করেন এবং পরের বছর বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীন এলফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন। তিনিই হলেন প্রথম মাহার দলিত শ্রেণীর ছাত্র কলেজে ভর্তি হন, তারপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭২ সালে অর্থনীতি ও পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি পান। ১৯১৩ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। আর সে বছরই বরোদা স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে স্নাতোকত্তর পড়ার জন্য তিনিই প্রথম ভারতীয় দলিত প্রথম আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতোকত্তর পড়তে যান। তিনিই প্রথম ভারতীয় এই গৌরব অর্জন করেন। এরপর তাঁর ঝুলিতে এক এক করে ৩২টি ডিগ্রি সঞ্চিত হয়। যার মাধ্যমে তিনি বিশ্বে অন্যতম প্রথম সারির জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। তারপর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ, প্রথম আইনমন্ত্রী, সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম। তাঁর এই কৃতিত্বের পিছনে শৈশবে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্রাহ্মণ শিক্ষক কৃষ্ণজী কেশব আম্বেদকর-এর স্নেহ এবং আশীর্বাদ সেই যুগে উল্লেখযোগ্য। স্কুলে ভীমরাও রামজীর পিতৃদত্ত পদবী পরিবর্তন করে তিনি তাঁর নিজের পদবী আম্বেদকর নথীভুক্ত করান। ফলে ভীমরাও রামজীর পদবী হয় আম্বেদকর। সেই সময়ে একজন প্রকৃত শিক্ষকের উদারতা সমস্ত শিক্ষক সমাজের কাছে আজ অনুকরণীয়।
৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে দিল্লীর নিবাসে আম্বেদকরের মৃত্যু হয়। ১৯৯০ সালে তাঁকে মরোণত্তর ‘ভারতরত্ন’ উপাধি প্রদান করা হয়।