ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
ছ’বছরের কালো রোগাটে একটি ছেলে। বাড়ির বড়বৌদির খুব আদরের। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। তখনও ভালোমতো পড়তে শেখেনি। বৌদি জোরে ছড়া পড়ে বোঝান আর ছেলেটে তা শুনে শুনে মুখস্থ করে নেয়। তারপর বাড়ির সকলকে শোনায়। খেলাধূলা করে না। বাড়িতে একটা রেডিও আছে। তার কাছে কান লাগিয়ে বসে বসে ‘কাব্যসঙ্গীত’ (এখন যা রবীন্দ্রসঙ্গীত) শোনে। এই ছেলেটিকে এবার পাঠন হল স্কুলে। আপনভোলা ছেলেটি মাঝে মাঝে খালি গায়েই চলে যায় স্কুলে। স্কুলে গিয়ে প্রথম ভাগের ছবির পাতাগুলি ছিঁড়ে ক্লাসের ছেলেদের বিলিয়ে দিয়ে বাড়ি আসে। দুমদাম করে বই শ্লেট ফেলে রেখে বৌদিকে হুকুম করে, বৌদি কি আছে দাও, বড্ড খিদে পেয়েছে। বই গুছোতে যেয়ে বৌদি যখন জিজ্ঞেস করেন বইয়ের পাতা কি হলো, ছেলেটি জবাব দেয়— জানি না যাও। বইয়ের পাতা ছিঁড়লেও এই সময়েই ছেলেটি কিন্তু অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে কবিতা লিখতে পারে। ছেলেটির বাবার ছিল একটি বইয়ের দোকান। তার একজন কর্মচারী ছিলেন। তাঁর নাম কালিরতন ভট্টাচার্য্য। তাঁকে ছেলেটি খুবই রাগাতো। একদিন তার খাবার ঘরের দেওয়ালে ছেলেটি রঙিন পেনসিল দিয়ে কালিরতনবাবুর মুখ এঁকে তার নীচে লিখে দিল—
খাঁদু খালি কলা গেলে
আর কালিরতনদা তাই দেখে ভোলে।
খাঁদু ছিলেটির ছোট ভাই। তাকে নীলরতন খুব ভালবাসতেন।
স্কুলে যেতে ভাল না লাগলেও নতুন নতুন দুষ্টুমিতে বেশ মাথা ছিল ছেলেটির। সেদিন রান্নাঘরের সামনে বৌদির ছোট ছেলেটি মুঠো মুঠো করে কয়লার গুঁড়ো নিয়ে খেলা করছে। তাই দেখে বাড়ির পুরোহিত মশাই সুর করে বললেন—
ইয়ারে আইছ কি কারণ?
ছেলেটি কাছে ছিল। সে পুরোহিত মশায়ের সামনে এসে সঙ্গে সঙ্গে একই সুরে সুরে মিলিয়ে জবাব দিলো—
ধাঁই কিরি কি ধাঁই কিরি কিরি
চলো বৃন্দাবন—
এইভাবে ছড়া কাটাই নয় ঘরের দেওয়ালেও ছেলেটি ছড়া লিখে রাখতো। একদিন বৌদির সঙ্গে দাদার কি নিয়ে যেন একটু ঝগড়ার মত হচিছল। বৌদিকে সে খুব ভালবাসতো। দাদা-বৌদির এই ঝগড়ায় ছেলেটির মন বৌদির প্রতি সহানুভূতিতে ভরে উঠল। আপন মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে লিখে দিল—
হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই
জানাই তাই।
এইভাবে দিন যায়। একদিন ছেলেটির মা মারায় গেল। মা হারিয়ে ছেলেটি বৌদির আরও কাছে এলো। বৌদি ছেলেটিকে পড়াবার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু ছেলেটির কিছুতেই পড়ার বইয়ে মন বসে না। বৌদি বলেন, ‘‘না পড়লে পাশ করবি কি করে? ক্লাসে উঠবি কি করে?’’ ছেলেটি হাসি মুখে জবাব দেয়, পাশ করে কি হবে, ক্লাশে উঠবো এই তো? ক্লাসে উঠে উঠে ডিগ্রী নেবো! কিন্তু ডিগ্রী নিয়ে কি হবে! আমি যদি ডিগ্রী না নিয়ে আরো বেশি পড়ি? লোকে তো বাজালেই বুঝতে পারবে খালি কলসি কি ভর্তি কলসি! এই বলে সে পড়ার বই মুড়ে রেখে আলমারী খুলে গল্পের বই নিয়ে বসতো।
হ্যাঁ— বলতে ভুলে গেছি, ছেলেটি ব্রাহ্মণ ঘরের। তাই পৈতের সময় হল। ছেলেটি বৌদিকে আগেই বলে রেখেছিল যে পৈতের সময় দাদার মতো তাকেও একটি আংটী দিতে হবে। পৈতের আগের দিন সে বৌদির কাছে এলো। বৌদি ইচ্ছে থাকলেও তাকে আংটী দিতে না পারায় তার হাতে একটি টাকা দিল। টাকাটা দিয়ে বলল, তোর যা ইচ্ছে কিনে খাবি। অনেক দিনের আগের কথা কিনা, তাই তখনকার দিনে একটা টাকায় অনেক কিছু কেনা যেতো। ছেলেটি কিন্তু কিছুই খেল না। পৈতের সময় ন্যাড়া হতে হয়। তাই সে তার সু¨র চুলের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঐ টাকাটা দিয়ে বেশ কয়েকটা ফটো তুলিয়ে রাখল। গালে হাত দিয়ে সে একটি ছবি তুলল। ছবিটি পরে অবশ্য অনেকেই দেখেছে। এখনও অনেকে দেখে। ভবিষ্যতেও অনেকে দেখবে।
ন্যাড়া হওয়ার পর ছেলেটি রেডিওতে ‘গল্পদাদুর আসর’-এ আবৃত্তি করার সুযোগ পায়। কিন্তু ন্যাড়া মাথায় যায় কি করে? হুকুম যখন হয়েছে তখন বৌদিকে তা মানতেই হবে। সারা দুপুর ধরে বৌদি তৈরী করে দিলে গান্ধী ক্যাপ। বিকেলে ধুতি পাঞ্জাবী আর গান্ধী টুপী পরে ছেলেটি চলল রেডিও অফিসে। যাবার সময় পাড়ার একটি ছেলেকে পাহারায় রেখে গেল বৌদি রেডিওতে তার আবৃত্তি শোনে কিনা তা দেখার জন্য। যথাসময়ে রেডিওতে ছেলেটির নাম ঘোষণা করা হল। সে রবীন্দ্রনাথের ‘শীতের আহ্বান’ আবৃত্তি করল। বাড়ি এসে ছুটে গেল বৌদির কাছে— বৌদি আমার আবৃত্তি শুনেছ?
সেদিন ছিল বর্ষার দিন। বৌদি রান্নাঘরে রান্না করছেন। পাশের ঘরে বাচ্চারা শুয়ে আছে। খোলা দরজা দিয়ে হাওয়া আর বৃষ্টির ছাট এসে ঘর ভিজিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটি ঘরের কোণে কি যেন করছে। বৌদি তাকে দরজাটা দিতে বললেন। দু’একবার বলাতেও ছেলেটির কানে কথাটি যখন গেল না তখন বৌদি চেঁচিয়ে বললেন,— ‘দরজাটা দে—’ এবার ছেলেটির সাড়া মিলল। দরজাটা দু’চারবার টেনে ধরে হতাশ ভঙ্গী করে বলল, ‘বৌদি তোমার কথা রাখতে পারলাম না। এটা বড্ড ভারী।’ বৌদি রাগ চেপে বললেন— ‘দরজাটা বন্ধ কর।’— ‘তাই বল, ব্যাকরণ শুদ্ধ করে বলবে তো? দরজা দিতে বলছো— দরজা কি দেওয়া যায়?’ ছেলেটি বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
—বাঁদর, বৌদির স্নেহসম্ভাষণ।
ছেলেটি মুখ কাঁচু মাচু করে জবাব দিল— ‘না বৌদি তোমার দিক ভুল হল, ওটা বঁ-দোর নয়, ডান্-দোর।’
এরপর কিছুদিন কেটে গেছে। ছেলেটি বৌদির সব গল্পের বই নিয়ে পাড়ায় লাইব্রেরী করেছে। নানারকম জনহিতকর কাজে ছেলেটি এখন খুব ব্যস্ত। এদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লেগেছে। এই দেখ এতক্ষণ বলাই হয়নি। ছেলেটি থাকতো কোলকাতায়। কোলকাতায় তখন বোম পড়ার ভীষণ ভয়। এমনি একটি ‘বড়দিনে’র দিন। ছেলেটি এসেছে তার বৌদির বাড়িতে। অনেকদিন পরে এসেছে তাই বৌদি তার ছোট্ট আদরের দেবরটির জন্য ভালমন্দ রান্নার ব্যবস্থা করেছেন। রাত তখন আটটা। এমন সময় সাইরেন বেজে উঠল। দোতলায় বৌদির ছোট দু’মেয়ে ঘুমুচ্ছে। ছেলেটি তাদের দু’জনকে দু’বগলে নিয়ে দৌড়োলো একতলায়। নীচের ঘরের খাটে তাদের শুইয়ে দিল। তাতেও তার স্বস্তি নেই। ওদের উপর নিজেও উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল। যেন বোমা নিজের পিঠ দিয়ে বাঁচাবে ওদের। সেইদিনই কোলকাতায় প্রথম বোম পড়েছিল।
ছেলেটির এখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোর মাত্র। বয়সে ছোট হলেও তার কাজের অন্ত নেই। ছোটদের নিয়ে সভা করা, কাগজ লেখা, পার্টির কাজ, কবিতা লেখা, কাজ আর কাজ। খাওয়া-দাওয়া ভুলে দিনরাত কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন এই কিশোর।
এই কর্মেরই অঙ্গ হিসেবে তার সুযোগ এলো বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে যাবার। উপলক্ষ্য ছাত্র সম্মেলন। ইতিমধ্যে কবি হিসেবে তার বেশ নাম ছড়িয়েছে। তখন ছিল শীতকাল। কিন্তু তার ছিল না কোন গরম পোষাক। অবশ্য তার জন্য আটকালো না। কার কাছ থেকে যেন একটা গরম প্যান্ট জোগাড় করে ফেলল। প্যান্টের কোমর বড় ঢলঢলে জীর্ণ, হাঁটুর কাছে এতোখানি গোল কালির দাগ লাগা। তাই পরে সে কোমরে একটা চওড়া বেল্ট লাগিয়ে নিলো। বেল্টের বাঁধনে কোমর কুঁচকে রইল। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে তার জৈনক ‘কবিদাদা’র সঙ্গে চলল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম পৌঁছলে ছেলেরা তাই সেই কবিদাদাকে বার বার তার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। তিনি বললেন এখানেই আছে তোমরা চিনে নাও। ছেলের দল পাঞ্জাবী পরা বাবরী চুলগুলো ‘কবি’কে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু চিনতে না পেরে তারা সেই ‘কবিদাদা’কেই ধরল তাকে চিনিয়ে দিতে। শেষে তার পরিচয় পেতেই কয়েকটি ছেলে তার দিকে খাতা বাড়িয়ে দিয়ে কেউ বলল কবিতা লিখে দিতে, কেউ বলল তার ঠিকানাটা দিতে। একটি খাতায় সে লিখে দিল—
ঠিকানা আমার চেয়েছো বন্ধু—
ঠিকানার সন্ধানে,
আজও পাওনি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?
ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু,
পথে পথে বাস করি,
কখনো গাছের তলাতে,
কখনো পর্ণ কুটীর গড়ি।
পরে এই ছাত্র সম্মেলনে এই কবিতাটি পড়া হয়। এর কিছুদিন পরেই সেই দুষ্টুমীভরা শিশু, কর্মব্যস্ত কিশোর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক দেরীতে ধরা পড়ে তার টিবি হয়েছে। শেষে...
যাদবপুর টিবি হাসপাতালে মাত্র ২১ বছর বয়সে এই কিশোর চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে।
কে এই কিশোর? এই কিশোরই হল আজকে তোমাদের প্রিয় কবি ‘সুকান্ত’। যে ঐ কৈশোরেই ঘোষণা করেছিল—
নিজের রক্তে নবজাতককে
করে যাব আশীর্বাদ
তারপর হব ইতিহাস।
হ্যাঁ, ঠিক তাই হয়েছে সেই কিশোর। নিজের রক্তে নবজাতককে আশীর্বাদ করে তিনি আজ ইতিহাস। ঘরে ঘরে আজ তাঁর কবিতার বই। আর ছোটবেলার খেয়ালের বসে তোলা সেই গালে হাত দেওয়া সৌম্য সু¨র ফটো। ঐ অল্প বয়সেই তিনি ছোটদের ভীষণ ভালবাসতেন এবং তাদের শরীর মন সুস্থ স্বাভাবিকভাবে গড়ে তোলার জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন কিশোর বাহিনী। সেই কিশোর সুকান্তের এবছর জন্মশতবর্ষ।