ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
স্নেহের ছোট্ট বন্ধুরা,
সুকান্ত ভট্টাচার্য কিশোর বাহিনীর প্রতিষ্ঠা লগ্নের মুখ্য সংগঠক ছিলেন এবং কিশোর বাহিনীর চলার পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের মধ্যে আগামী দিনে মহীরুহকে দেখেছিলেন বলে তাদের শক্তিকে কোনভাবেই অবহেলা করেননি, বরং বারে বারে ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো’ বলে ইস্পাত কঠিন পণ উচ্চারণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রমজীবী মানুষের জয় একদিন হবেই হবে।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট সুকান্ত জন্ম নেন তাঁর মাতামহ সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের কলকাতার কালীঘাটের ৪২ নং মহিম হালদার স্ট্রীটে। সুকান্তর বাবা নিমাইচন্দ্র আর মা হলেন সুনীতি দেবী। শৈশবে মা সুনীতি দেবীকে হারিয়ে সুকান্তর দিন কেটেছে কষ্টে তবে জ্যেঠতুতো বোন রাণীদি তাঁকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন— সে সুখও সুকান্তর সইলো না। রাণীদিও অকালে মারা যান। তখন সুকান্তর বয়স মাত্র সাত-আট। বন্ধু অরুণাচলের মা সরলাদেবী সুকান্তকে স্নেহ আর যত্নে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। বৈমাত্রেয় বড়ভাই মনোমোহনের স্ত্রী সরযু দেবী সুকান্তকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। মা-হারা সুকান্তের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা এঁরা অনেকটা মিটিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
সুকান্ত ছোটবেলা থেকে সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন সেই সঙ্গে সমাজসেবা ও রাজনীতির পাঠ নিতে শুরু করেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ভারতছাড়ো আন্দোলন— সব মিলিয়ে ভারতবর্ষ উত্তাল— আর এই সময় সুকান্তকে নানাভাবে আবেগ তাড়িত করে তুলেছিল— প্রতিবাদে প্রতিরোধে গর্জে উঠেছিল তাঁর কণ্ঠ এবং লেখনি।
সুকান্ত মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন ছোটরাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গড়ে ওঠা চল্লিশের দশকের কিশোর বাহিনীর নামে শিশু সংগঠনের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। সুকান্ত কিশোর বাহিনীর ভাইবোনদের জন্য ‘জনযুদ্ধ’ এবং ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় গল্প, কবিতা, নাটিকা পরিবেশন করতেন। তাঁর চেষ্টায় কিশোর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় তিরিশ হাজারে পৌঁছে যায়।
মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে কবি সুকান্ত আমাদের ছেড়ে চলে যান। যক্ষারোগের নিরাময় করানোর মতো ওষুধ তখনো আমাদের দেশে ছিল না। বহু চেষ্টা করেও তাই বাঁচানো যায়নি কবিকে। ১৯৪৭ সালের ১৩ মে সকাল ৯টা নাগাদ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দলমত নির্বিশেষে কবি সুকান্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থাকেন রসিক কাব্য-পাঠকেরা। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত আর রবীন্দ্র আদর্শে অনুপ্রাণিত সুকান্ত বাঙালির প্রাণের কবি হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘যে কবির বাণী লাগি’ ‘কান পেতে’ ছিলেন সে কবি হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের কথা ফুটে উঠেছে— মুক্তির কথা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়— খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কবিরূপে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
আজ তাঁর জন্ম শতবর্ষে ‘ছোটদের কথা’ পত্রিকার পক্ষ থেকে এবং পত্রিকার পাঠক-পাঠিকা অগণিত শিশু কিশোর-কিশোরীদের পক্ষ থেকে কবি সুকান্তকে আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই। সেই সঙ্গে আর একবার স্মরণ করি কবির অঙ্গীকারে—
‘‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’’