ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
সুকান্তর যখন বালক বয়স, তখন থেকেই তার কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমি তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে বি.এ. পড়ছি। ‘পদাতিক’ বেরিয়ে তখন পুরনো হয়ে গেছে। রাজনীতিতে আপাদমস্তক ডুবে আছি। ক্লাশ পালিয়ে বিডন স্ট্রীটের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা। কলেজের বন্ধু মনোজ একদিন জোর করে আমার হাতে একটা কবিতার খাতা গছিয়ে দিল। পড়ে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি কবিতাগুলো সত্যিই তার চোদ্দ বছর বয়সের খুড়তুতো ভাইয়ের লেখা। শুধু আমি কেন, আমার অন্যান্য বন্ধুরা, এমন কি বুদ্ধদেব বসুও কবিতার সেই খাতা পড়ে অবাক না হয়ে পারেননি।
আমার সন্দেহভঞ্জন করবার জন্যেই বোধহয় মনোজ একদিন কিশোর সুকান্তকে সেই চায়ের দোকানে এনে হাজির করেছিল। সুকান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে তার কবিত্বশক্তি সম্বন্ধে সেদিন কেন আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম, সে বিষয়ে কেউ যদি আমাকে জেরা করে আমি তার সদুত্তর দিতে পারব না।
সে সব কবিতা পরে ‘পূর্বাভাস’-এ ছাপা হয়েছে। তাতে কী এমন ছিল যে, পড়ে সেদিন আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম? আজকের পাঠকেরা আমাদের সেদিনকার বিস্ময়ের কারণটা ধরতে পারবেন না। কারণ, বাংলা কবিতার ধারা তারপর অনেকখানি বয়ে এসেছে। কোনো কিশোরের পক্ষে ঐ বয়সে ছন্দে এমন আশ্চর্য দখল, শব্দের অমন লাগসই ব্যবহার সেদিন ছিল অভাবিত। হালে সে জিনিস প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
জীবনের অভিজ্ঞতাকে ক্ষমতায় বেঁধে সুকান্ত যখন কবিতার বিদ্যুৎ শক্তিকে কলকারখানায় খেত খামারে ঘরে ঘরে সবে পৌঁছে দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়ে গেল। আরম্ভেই সমাপ্তির এই শোকে বাংলা সাহিত্য চিরদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
সুকান্ত বেঁচে থাকলে তার অনুরাগী পাঠকদের মধ্যে আমার চেয়ে বড় সমালোচক আর কেউ ছিল কিনা সন্দেহ। এখন ভেবে খারাপ লাগে। সামনাসামনি তাকে কখনও আমি বাহবা দিইনি। তার লেখায় সামান্য ত্রুটিও আমি কখনও ক্ষমা করিনি।
এ প্রসঙ্গ তুলেছি স্মৃতিচারণার জন্যে নয়। পাঠকেরা পাছে বিচারে ভুল করেন, তার যুগ আর তার বয়স থেকে পাছে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখবার চেষ্টা করেন— সেইজন্যে গোড়াতেই আজকের পাঠকদের খানিকটা হুঁশিয়ার করে দিতে চাই।
খুঁত ধরব জেনেও, নতুন কিছু লিখলেই সুকান্ত আমাকে একবার না শুনিয়ে ছাড়ত না। আমি তখন কবিতা ছেড়ে ‘জনযুদ্ধ’ নিয়ে ডুবে আছি। অফিসে বসে কথা বলবারও বেশি সময় পেতাম না। আমাদের অধিকাংশ কথাবার্তা হত সভায় কিংবা মিছিলে যাতায়াতের রাস্তায়। ‘কী নিয়ে লিখব’— এটা কখনই আমাদের আলোচনার বিষয় হতো না। ‘কেমন করে লিখব’— এই নিয়েই ছিল আমাদের যত মাথাব্যথা।
কিশোর বাহিনীর আন্দোলনে সুকান্তকে টেনে এনেছিল তখনকার ছাত্রনেতা এবং আমাদেব বন্ধু অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য। রাজনীতিতে শুকনো ভাব তখন অনেকখানি কেটে গিয়ে নাচ গান নাটক আবৃত্তির ভেতর দিয়ে বেশ একটা রসকষ এসেছে। কবিতাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের যেমন রাজনীতির আসরে ঢুকতে হয়েছিল, সুকান্তর বেলায় তা হয়নি। সুকান্তর সাহিত্যিক গুণগুলোকে আন্দোলনের কাজে লাগানোর ব্যাপারে অন্নদারও যথেষ্ট হাতযশ ছিল। সুকান্তর আগের যুগের লোক বলে আমি পার্টিতে এসেছিলাম কবিতা ছেড়ে দিয়ে; আর সুকান্ত এসেছিল কবিতা নিয়ে। ফলে, কবিতাকে সে সহজেই রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে পেরেছিল। তার ব্যক্তিত্বে কোনো দ্বিধা ছিল না।
কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আঠারো থেকে একুশ বছর বয়সে সুকান্ত যেভাবে লিখেছিল— বেঁচে থাকলে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও সেই একই ভাবে লিখে যেত। সুকান্তকে আমি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি বলেই জানি, এক জায়গায় থেকে যাওয়া সুকান্তর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ‘পূর্বাভাসে’ আর ‘ঘুম নেই’তে অনেক তফাত। তেমনি সুস্পষ্ট তফাত ‘ছাড়পত্রে’র প্রথম দিকের আর শেষ দিকের লেখায়।
তাছাড়া কবিতা ছেড়ে সুকান্ত পরের জীবনে উপন্যাসে চলে যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে? বেঁচে থাকলে কী হত তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আজ হয়ত কোনো মানে নেই, কিন্তু কাজে হাত দিয়েই সুকান্তকে চলে যেতে হয়েছে— একথা ভুলে গেলে সুকান্তর প্রতি অবিচার করা হবে।...
ভাবতে অবাক লাগে, সুকান্ত বেঁচে থাকলে আজ তার একচল্লিশ বছর বয়স হত। কেমন দেখতে হত সুকান্তকে? জীবনে কোন্ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সে যেত? তার লেখার ধারা কোন্ পথে বাঁক নিত?
অসুখে পড়বার অল্প কিছুদিন আগে একদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এক মিটিং-এ যাবার পথে আমার এক সংশয়ের জবাবে সুকান্ত বলেছিল : আমার কবিতা পড়ে পার্টির কর্মীরা যদি খুশি হয় তাহলেই আমি খুশি— কেননা এই দলবলই তো বাড়তে বাড়তে একদিন এ দেশের অধিকাংশ হবে।
সেদিনই তর্কে আমি তাকে হারাতে চেষ্টা করেছিলাম। আজ আমাকে মানতেই হবে, একদিক থেকে তার কথাটা মিথ্যে নয়। গত কুড়ি বছর ধরে সুকান্তর বই বাংলাদেশের প্রায় ঘরে ঘরে স্থান পেয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে তার একটা ছাপা বই থেকে শ’য়ে শ’য়ে হাতে লিখে নকল করে লোকে সযত্নে ঘরে রেখেছে। তার পাঠককূল ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। সুকান্ত মুখে যাই বলুক, আসলে সে শুধু পার্টির কর্মীদের জন্যেই লেখে নি। যে নতুন শক্তি সমাজে সেদিন মাথা তুলেছিল, সুকান্ত তার বুকে সাহস, চোখে অন্তর্দৃষ্টি আর কণ্ঠে ভাষা জুগিয়েছিল। এ কথাও ঠিক নয়, কাউকে খুশি করার জন্যে সুকান্ত লিখেছিল। তাগিদটা বাইরে থেকে আসে নি, এসেছিল তার নিজের ভেতর থেকে। পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আসলে নিজেকেই সে কবিতায় ঢেলে দিয়েছিল।
সৌজন্য : সুকান্ত বিচিত্রা, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত