ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
আমার একান্ত আপন কল্পনা চলে গেল চিরকালের মত। আর ওকে দেখতে পাব না। কবির ভাষায়—
‘‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল সে
বসন্তের বাতাসটুকুর মত।’’
মৃত্যু এক চিরন্তন সত্য। তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। মাইকেল মধুসূদনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে হয়—
‘‘জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে?’’
কিন্তু সত্যিটাকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া বড়ই কঠিন, বড়ই বেদনাদায়ক।
কল্পনা আমার ছোটবেলা থেকে আজীবনের বান্ধবী। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলে আমি Class III থেকে পড়েছি। ও পড়েছে Class VI থেকে। সেই থেকেই ও আমার Best friend ও ছিল সদা চঞ্চল, উচ্ছল, প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। ওই গুণগুলোই আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করতো। কারণ আমি ছিলাম একটু ভীতু, শান্ত প্রকৃতির। কল্পনা ছিল আমার প্রেরণা শক্তি। আমাদের আর এক বান্ধবী ছিল সুলেখা। সব সময় এক সেকশনে তো থাকতে পারিনি। কিন্তু আমাদের জোট কেউ ভাঙতে পারেনি। অনেকেই আমাদের বলতো Three Masketiers.
ক্লাস এইটেই কল্পনা কোন একটা রাজনৈতিক প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল বন্দী হয়। আমি তো ভয়ে কেঁদেই মরি। প্রধান শিক্ষিকা বিভাদি যদি ওর স্কুলের নাম কাটিয়ে দেয়, তবে কী হবে! আমিই বা কী করবো? যাই হোক তা কিন্তু হয়নি। ওর অমায়িক ব্যবহার ও অন্যান্য গুণের জন্য উনি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কল্পনা Sports এবং N.C.C.-তেও খুব ভাল ছিল।
ওর নিজের মাতৃভূমি চট্টগ্রামকে ভুলতে পারতো না। দেশের নানা গল্প শোনাতো আমাদের।
বর্ধমান উইমেন্স কলেজেও তিনজন একই সাথে Three Years Degree Course-এ ভর্তি হলাম। কিন্তু কল্পনা Politics-এ একটু বেশী জড়িয়ে পড়লো। পড়াশুনায় বেশ বাধা হতে লাগলো। ও কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে আমাদের কোন ভাবেই প্রভাবিত করতো না। ও ওর নিজের আদর্শে চলতো। এক সময় কলেজ ছাড়তে হল। তবে ইটাচুনা কলেজ থেকে graduation করে ঠিকই সাবলম্বী হয়েছে। তবে এ-সব ব্যাপারে স্বামী ধীরেন বাবুর সহযোগিতা এবং প্রেরণা অনস্বীকার্য।
বিয়ের পর বিচ্ছিন্ন হলেও চিঠিতে নিয়মিত আমাদের যোগাযোগ ছিল। বর্ধমানে বাপের বাড়ি গেলেই দেখা হত। দুর্গাপুরে আমাদের কোয়ার্টারে বেশ কয়েকবার এসেছে।
উপযুক্ত পুত্রের বিয়োগ ব্যথা মেনে নিতে পারেনি। সেই ডানপিটে কল্পনা কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে গেল। স্বামী ধীরেন বাবু, কন্যা দোলা, জামাতা যত্ন বা চিকিৎসার কোন ত্রুটি রাখেনি।
কলকাতায় হাঁটু অপারেশন করতে এসেও ধীরেন বাবুকে দিয়ে আমায় খবর দিয়েছে। কিন্তু সঙ্গীর অভাবে আমার পক্ষে নার্সিংহোমে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ভেবেছিলাম ছেলে আমেরিকা থেকে ফেব্রুয়ারিতে আসবে, তখনই বর্ধমানে গিয়ে দেখা করবো, তা আর হল না। আফশোষ রয়ে গেল। মনে হয় ও হয়তো আমায় শেষবারের মত দেখতে চেয়েছিল।
মৃত্যুর পরপার সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু ভেবে নিতেই পারি— সেটা চির সুন্দর, শান্তিময় একটা স্থান। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সকল দুঃখ, যন্ত্রণা, রোগভোগের উর্দ্ধে উঠে কল্পনা চির শান্তিতে সেখানে থাকুক।
আমরা আর ওকে দেখতে পাব না, স্পর্শ করতেও পারবো না কিন্তু শুভ কামনা, চিরন্তন ভালবাসাটুকু নিশ্চয়ই পৌঁছাতে পারবো।