ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
মাত্র একটি অক্ষরের শব্দ ‘‘মা’’, কিন্তু এই একটি অক্ষরের মধ্যেই কী আশ্চর্য ভাবে লুকিয়ে আছে এমন একটা জগৎ, যাকে ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে শব্দের ভাণ্ডার অকূলান হয়ে যায়! প্রকৃতির নিয়মে একদিন না একদিন প্রত্যেককেই জীবনের শেষ দরজাটি পার হয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় একটি সম্পূর্ণ অজানা, অনির্দিষ্ট যাত্রায়। এই জীবন তো একটা পান্থশালা, কেউ তো আমরা এখানে থাকতে আসিনি, যেতে আমাদের সবাইকেই হবে! যতই বলি না কেন, যেতে নাহি দিব! এই চিরন্তন নিয়মেই পার্থিব সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার হাত ছাড়িয়ে আমার মা শ্রীমতী কল্পনা সুর, আজ এক অন্য জগতের বাসিন্দা।
বিছানার পাশে মায়ের বসার সেই নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে মা আর কোনদিনই বলবে না, দোলা কাছে এসে বস, আমি তোর কথা শুনতে পাচ্ছি না! কিংবা তিন চার দিন না যেতে পারলেই, ফোনে মায়ের উদ্বিগ্ন গলার স্বর আর কোনদিনই ভেসে আসবে না, কতদিন আসিসনি! তোর বাবাকে বললেই তো আমাকে বকবে, বলবে দোলাকে সবসময় অত ডেকো না তো, ওর অনেক কাজ থাকে! মায়ের সঙ্গে এখন যা কিছু কথা, সবই মনে মনে। আর সেই কথা বলতে শুরু করলে অবাক হয়ে দেখি, দীর্ঘ তিরাশি বছর ধরে পথ চলা একটি জীবন ঠিক যেন একটি রঙবেরঙের ছবিতে ভরা খোলা খাতার মতো আমার সামনে একটি একটি করে তার পাতা উল্টে উল্টে তার অফুরন্ত ছবির ঝাঁপি খুলে বসেছে! আমার আর কথা বলা হয় না, আমি ছবি দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি!
আমি দেখতে পাই একটি দুই বিনুনী ঝোলানো ছোট্ট ডানপিটে মেয়েকে, যে ভেসে যাওয়া মেঘের ছায়ায় ছায়ায় ছুটতে ছুটতে অনেক দূরের মাঠে চরতে যাওয়া তার বাড়ির পুষ্যি ছাগলের খোঁজ করতে যাচ্ছে, আবার পুষ্যি ছাগলছানাকে খুঁজে পেয়ে ফিরতি মেঘের ছায়া ধরে ধরে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে আসছে! আমি দেখতে পাই কোনো এক অদেখা গ্রামের খেসারি খেতে, বৈঁচি বনের ঝোপেঝাড়ে, প্রতিবেশীর বাগানের আম, জাম কিংবা বাতাবী গাছে হনুমানের মতো দাপিয়ে বেড়ানো এক দল দামাল কিশোর-কিশোরীর মধ্যমণি এক শ্যামলা ছিপছিপে মেয়েকে, যে কখনো ছুটে বেড়ায় চট্টগ্রামের পাহাড়ি পথের চড়াই উৎরাই জুড়ে, কখনো বা তুমুল ঝাঁপাঝাঁপিতে মত্ত বাড়ি থেকে দু-পা দূরের সমুদ্রে, উথাল- পাথাল ঢেউয়ে! আমি দেখতে পাই এক অস্থির অশান্ত সময়ের ঘূর্ণাবর্তে ছিন্নমূল হয়ে সম্পূর্ণ নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, এক প্রবল আর্থিক অনটনের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত একটি প্রাণ চঞ্চল ছটফটে কিশোরীকে! বাড়িতে দুই দাদা, দুই দিদি, তারাও তখন নিজেদের পায়ের তলে মাটি শক্ত করার জন্য প্রাণপণ ব্যস্ত। আমার চোখের সামনে কিশোরী মেয়েটি বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলের গণ্ডী ছাড়িয়ে পা রাখে উইমেনস কলেজের চত্বরে। বামপন্থী পরিবারের কন্যাটি তুমুল ভাবে জড়িয়ে পড়ে ছাত্র আন্দোলনের সাথে। সেই সঙ্গে সে তখন বাড়িতে মেজ দাদার তিন শিশু পুত্র এবং এক কন্যার স্নেহময়ী পিসি। তাদের পড়াশোনা এবং দেখভালের সিংহ ভাগ দায়িত্বই তখন এই পিসির। ভাইপো, ভাইঝিদের পড়ানোর একটা মজার গল্প খুব মনে পড়ে। সবার ছোট যে, যার নাম পাপু, সে একদম ছোটবেলায় কিছুতেই লেবু শব্দটা উচ্চারণ করতে পারত না! কেবলই বলত, ডাবু। একদিন তার সেজ পিসি তাকে লেবু খাওয়াতে খাওয়াতেই পড়াচ্ছে, বল, ল এ একার লে... লে। ব এ হ্রস্বউ বু... বু। তাহলে বল লেএএবুউউ... ডা আ আ বু উ উ! এই যখন চলছে, তখন ছাত্রর মুখে এক কোয়া লেবু, বার বার ডাবু শুনতে শুনতে মেজাজ হারিয়ে পিসি তো ভাইপোর গালে দিলেন একটি চড়, মুখ থেকে ফুড়ুৎ করে ছিটকে গেল কমলালেবুর কোয়া, তবে সেই সঙ্গে মুখ থেকে ডাবুর বদলে লেবু শব্দটিও ছিটকে বেরিয়েছিল কিনা তা অবশ্য মনে পড়ে না।
যাই হোক, ঘরে, বাইরে সংগ্রামের সাথে সাথে মেয়েটি ইতিমধ্যে পাশে পেল রাজনৈতিক সংগ্রামের এক সহযোদ্ধাকে। তিনিই আজকের শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ সুর। বর্ধমান শহরের ময়ূরমহলে রাজার আমলের একটি বিশাল পুরোনো দিনের বাড়ির বাইরের দিকের একটি অংশে ভাঁড়ার ঘর আর আধখানা রান্না ঘর নিয়ে মোট সাড়ে চারটি ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরীর ভাড়া বাড়িতে শুরু হল মেয়েটির নতুন সংসার, নতুন রকম জীবন যুদ্ধ। সালটা ১৯৬৫। বছর খানেক পর, মেয়েটির কোলে তখন আসতে চলেছি আমি, সায়াটিকার যন্ত্রণায় ভীষণ রকম কাবু হয়ে পড়েছিল আমার হবু মা। যাই হোক, তারপরে তো আমি ধরাধামে উপস্থিত হলাম। প্রথম সন্তান, সে হোক না কালোকুলো এক মেয়ে, তবু সে হয়ে উঠল মা তো বটেই, সেই সঙ্গে ঠাকুমা, দাদু, জ্যেঠুর চোখের মণি। বাবারও তাই ছিলাম নিশ্চয়ই, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ছোটবেলাটা বাবাকে কেন জানি না ভীষণ রকম ভয় পেয়ে কেটে গেল! আসলে বাবা সেই সময়ে পারিবারিক জীবনের সাথে সাথে বাম রাজনীতির সঙ্গে এতটাই জড়িত যে সত্তরের দশকের গোড়ায় সেই টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাবার পক্ষে মেয়ে নিয়ে আদর আহ্লাদ করা সম্ভব হয়ে উঠত না। তাই, আমার শৈশবে বাবা ছিল দূরের মানুষ, কাছের মানুষ মা, ঠাকুমা, দাদু, জ্যেঠু। একদম ছোট্ট বেলার দিকে চোখ রাখলে, একটা দৃশ্য খুব স্পষ্ট দেখতে পাই, শীতের রোদে উঠোনে খেলনাপাতি নিয়ে আমি খেলছি আর মা একটা থালায় হলুদ গুঁড়ো, নুন আর সর্ষের তেল দিয়ে ভাত মেখে সেই ভাতের দলা নিয়ে আমার মুখে পুরে দিচ্ছে। সেই ভাতের গ্রাসের স্বাদটা আজও যেন চোখ বুজলেই জিভের মধ্যে ফিরে আসে! আমি যখন আরেকটু বড়, মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাওয়াগুলো সবটাই বড্ড মিষ্টি স্মৃতি! মামাবাড়ির দাদুকে আমি দেখিনি, মামাবাড়িতে গেলেই দিদিমার খাটের নীচে নানা আকারের টিনে টিনে ভর্তি থাকত মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া, খইয়ের গুঁড়োর নাড়ু, মুড়কি এই রকম সব রকমারি লোভনীয় সুখাদ্য। সেই জন্য মামাবাড়ি ঢুকলেই আমার নাকি খিদে পেয়ে যেত! এর ওপর আবার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল মেজ মামার ঘরে একটি কৌটোয় রাখা, গায়ে চিনি ছড়ানো নাইস বিস্কুট। মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি সরাসরি কিছু বলতাম না, মামাতো দিদিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতাম, ঐ কৌটোয় কী আছে নাড়া তো দেখি! তখন দিদি বলত, ও তো বিস্কুট, খাবি? অগত্যা, তখন খেতেই হত!
সত্তর সালে বর্ধমানে সাধুমতী বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল শুরু হয়, মা সেই স্কুলের সংগঠক শিক্ষিকা হিসেবে কাজে যোগ দেয়, মায়ের সঙ্গে কখনো কখনো যেতাম সেই স্কুলে। একটু দূরেই রেললাইন, রেললাইনের পাশে পানা ভর্তি জলাজমি, তার ধারে দরমার দেওয়াল, টিনের চালওয়ালা লম্বা টানা একটি স্কুল ঘর, ব্যস এই। সামনের খোলা জায়গায় গুটিকতক ছাত্রী কিছু একটা উপলক্ষ্যে নাচ, গান করছিল, এইরকম একটা আবছা স্মৃতি মনের মধ্যে রয়ে গেছে। বছর দুয়েকের মধ্যে মায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে স্কুলটি সরকারি শিলমোহর পাওয়ার পর পরই মাকে শিক্ষকতা থেকে বরখাস্ত করার চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু সেই অনৈতিক বরখাস্তের বিরুদ্ধে মধ্যশিক্ষা পর্ষদে আপিল করার সাথে সাথে ছোটদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু করার তাগিদে মা, বাবা দুজনের সম্মিলিত উৎসাহে একটি শিশুদের জন্য পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু হল, তখন নাম ছিল ‘ছোটদের জগৎ’, পরে কিছু রেজিস্ট্রেশনের অসুবিধার কারণে নাম হল ‘ছোটদের কথা’। এর বছর দুয়েক পর, একটা বিকেল নাকি সকাল ঠিক মনে পড়ে না, তবে সেই ছবিটা স্পষ্ট মনে পড়ে, বাবার সঙ্গে বেরোলাম, পাড়ার মোড়ে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে বাবার সঙ্গে গেলাম হাসপাতালে। সেখানে দেখি মায়ের কোলে, কাঁধে ফিতে বাঁধা হলুদ জামা পরা ফুটফুটে একটি ছোট্ট ছানা! বাবা বলল, ঐটি নাকি আমার ভাই! আর খুব অবাক হলাম যখন আমাদের নিয়ে যাওয়া মিষ্টির প্যাকেটটাই মা আমার হাতে দিয়ে বলল, নে ভাই তোকে দিল! আমার মতোই ঠাকুমা, দাদু, জ্যেঠুর আদরে বড় হতে লাগল ভাই। ইতিমধ্যে শিশু শিক্ষার একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বাড়ির উঠোনেই শুরু হয়েছে শিশু নিকেতন নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। সেই সময় প্রথম এবং একমাত্র শিক্ষিকা মা। আমার বয়স তখন সাত, ভাইয়ের ছ’মাস। এই সময় আমিও ভর্তি হলাম বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলে। ক্লাস টু-এ। অ্যাডমিশন টেস্ট কী দিয়েছিলাম মনে পড়ে না, কিন্তু স্কুলের দিঘির বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে পরীক্ষার পর মায়ের আনা আঙুর খাওয়ার ছবিটা মনে থেকে গেছে। আসলে তখন তো আঙুর ফলটা এখনকার মতো জলভাত হয়ে যায়নি,তাই একটু স্পেশাল পরীক্ষা ছিল বলে সেদিন মায়ের ঐ স্পেশাল আদরটুকু আমার মনে গভীরে হয়তো একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
ইতিমধ্যে আমাদের বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা মায়ের মানস সন্তান শিশু নিকেতনও কলেবরে বাড়তে থাকল। আমাদের বাড়ির উঠোনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তারও যাত্রা শুরু হল বৃহত্তর পরিসরে। মায়ের হাত ধরে ভাইয়েরও শিশু নিকেতন স্কুলে নার্শারী ক্লাস থেকে পড়াশোনা শুরু হল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর, যে সমস্ত অস্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাদের পুনর্নিয়োগ করা হল। ফলে মা ১৯৭৭ সালে আবার সাধুমতী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিল। সেই সময় আমার খুব চিন্তা হত, মা তো অন্য স্কুলে চলে যাবে, তাহলে ভাইকে সারাদিন স্কুলে কে খেয়াল রাখবে! ভাই পারবে তো থাকতে! যাই হোক আমার দুশ্চিন্তা অমূলক প্রমাণ করে ভাই নির্বিঘ্নেই ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া শেষ করে, স্কুলেরই সহপাঠী পাড়ার আরও তিন চার জন বাচ্চার সাথে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল বয়েজ হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল।
এই রকম সময়গুলোতে আরও একটি চিন্তা মাঝে মাঝেই আমাকে খুব ভারাক্রান্ত করে তুলত। এই সময় দেখতাম আমাদের ঐ অ্যাসবেসটসের চালের আধখানা মাপের রান্নাঘরে সারাদিনের রান্নাবান্নার দায়িত্ব ছিল মূলতঃ ঠাকুমার। মেঝেতে পিঁড়ি পেতে বসে মাটির উনোনে কয়লা আর গুলের আঁচে রান্না। দিনের বেলায় মাকে রান্নাঘরে সেভাবে দেখতাম বলে মনে পড়ে না, তবে শীতের দিনে মা সন্ধের পর উনুনে রুটি করছে, আর আমি উনুনের পাশে দেয়ালের কোণ ঘেঁষে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে পড়া মুখস্থ করছি, এই দৃশ্যটি বেশ দেখতে পাই! সেই সময় আমার ভীষণ রকম চিন্তা হত এই ভেবে যে ঠাকুমা যদি এখন হঠাৎ করে মরে যায়, তাহলে আমরা খাব কী! মা তো রান্না করতেই পারে না। আসলে তখন তো আর সংসার জীবনের প্যাঁচ পয়জার বা রান্নাঘরের অধিকারবোধ নিয়ে টানাপোড়েনের ব্যাপারগুলো বোঝার বয়স হয় নি, তাই দুশ্চিন্তাটা দীর্ঘদিন মনকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। তারপর কখন যে মা আস্তে আস্তে বাইরের কাজকর্মের সাথে সাথে রান্নাঘরের হালটা ধরল সে আর খেয়াল পড়ে না।
আমার তখন ক্লাস এইট, পড়াশোনার বাইরে সময় কাটানোর জন্য বই পড়ার নেশা বেশ ভালো রকমই তখন চেপে ধরেছে। তখনও আমরা ল্যান্ডফোনই দেখিনি, মোবাইল ফোনের ধারণা তখন আমাদের প্রজন্মের কাছে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী, টিভিও আসেনি ঘরে ঘরে, কাজেই পড়ার বইয়ের বাইরে গল্পের বই-ই ছিল আমার মতো অনেকেরই প্রধান সঙ্গী, এমনকি খেতে বসলেও পাশে একটা কোনো বই না থাকলে আমার যেন মনে হত কিছুই খাওয়া হচ্ছে না! এই সময় মা স্কুলের লাইব্রেরী থেকে নানা রকম কিশোর পাঠ্য বই এনে দিত আমার পড়ার জন্য। গোগ্রাসে গিলতাম সেই সব বই। এই সময়ই একদিন কোনো ভাবে আমাদের বইয়ের তাকে কিছু খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করেই একটি পুরোনো বই হাতে এল, খুলে দেখি প্রথম পাতায় লেখা আছে, কল্পনা ও ধীরেনের শুভ বিবাহে আশীর্বাদ সহ, স্নেহ উপহার। উপহার দাতার নামটা মনে নেই, বইয়ের নাম— ‘চিতা বহ্নিমান’, লেখক— ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। দু-এক পাতা উল্টোতেই বুঝলাম এ যাবৎ কাল যত বই পড়েছি এই বই তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা! সেই সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া সময়ে যখন চারপাশটা সবে কেমন অন্যরকম দুর্বোধ্য রঙে রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছে, সেই মুহূর্তে চিতা বহ্নিমানের পাতায় পাতায় ধনীর দুলালী তপতী এবং দরিদ্র যুবক তপনের জীবনের করুণ, মধুর এক প্রেম উপাখ্যান আমাকে যেন প্রথম বড়দের মনোজগতের দুয়ার চেনালো! কিন্তু বড়দের বই কী করে প্রকাশ্যে পড়ি!! মা যদি বকে!! তাই জ্যেঠুর বিছানায় পড়ার বইয়ের তলায় রেখে একটু একটু করে চলতে লাগল চিতা বহ্নিমান পড়া। এই রকমই একদিন পড়া চলাকালীন ভাবে বিভোর হয়ে আছি, খেয়াল করিনি মা কখন ঐ ঘরে এসে ঢুকেছে! আমি তো ভয়ে কাঁটা হয়ে ঝট করে বইটা বালিশের তলায় চালান করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মায়ের চোখ তো, ঠিক খেয়াল করেছে! কী লুকোলি দেখি! হাতে নাতে বামাল সমেত ধরা পড়লাম। ভেবেছিলাম বিশাল কিছু শাস্তি পাব বুঝি, তবে মনে হয় তেমন কিছু শাস্তি পাইনি, তাহলে কিছু অন্ততঃ মনে থাকত!
আমার যখন নাইন, টেন এইসব ক্লাস চলছে তখন এখনকার মতো কোনো কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্কের প্রচলন ছিল না। তা নিয়ে আমাদেরও খুব একটা মাথা ব্যথা থাকত বলে মনে হয় না। আহামরি কিছু না হলেও পড়াশোনাটা মোটামুটি করতাম, স্কুলে ফার্স্ট হইনি কখনো, (আমাদের ব্যাচে ফার্স্ট বরাবর একজনই হয়ে এসেছে, আর যেই সেকেন্ড হোক মোটামুটি ভাবে সে বরাবরই তার থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ নম্বর পিছনে থেকেছে) তবে সেকেন্ড থেকে টেনথ্ পর্যন্ত কিছু না কিছু পজিশন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতি বছর পেয়ে এসেছি। আজ বুঝি ক্লাসে বরাবর প্রথম দশজনের মধ্যে থাকার পিছনে সেদিন মায়ের পরিশ্রম কতখানি ছিল! মা নিজের স্কুল সামলে কী আশ্চর্য ভাবনায় প্রতি বছর আমার স্কুলে গিয়ে গিয়ে উঁচু ক্লাসের মেয়েদের থেকে এক সেট করে প্রশ্ন যোগাড় করে রাখত। তার ফলে আমি সেভেন থেকে যখন যে ক্লাসে উঠছি দেখেছি মা সেই ক্লাসের আগের আগের অন্ততঃ দু-তিন বছরের হাফ ইয়ার্লি, অ্যানুয়াল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একসাথে জড়ো করে, আমাকে সেই সব প্রশ্নপত্র ধরে পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে। সেগুলোই ছিল আমার কাছে সেদিনের রায় অ্যান্ড মার্টিন! শুধু কী কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক রেডি করা!! আমার পড়ার কোথায় কোথায় ত্রুটি হচ্ছে, কী করলে আরও একটু ভালো ফল হবে আমার, সেটা বোঝার জন্য মা আমাদের যে বরাবর প্রথম হত, সে কীভাবে পড়াশোনা করে সেই আইডিয়া নিতে মাঝে মাঝে তার বাড়িতে পর্যন্ত যেতে ইতস্ততঃ করত না, এতটাই ছিল আমার পড়াশোনার ব্যাপারে মায়ের একাত্মতা! অবশ্য পরে ভাইয়ের বেলায় মা এইভাবে হালটা ধরতে পারেনি। কারণ পড়ানোর ব্যাপারে কেন জানি না ও মাকে ছোটবেলা থেকেই একেবারেই আমল দিত না! মায়ের কাছে একেবারেই পড়তে বসতে চাইত না, আর মায়েরও তখন ঘরে-বাইরে কাজের চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে, ফলে মায়ের পক্ষেও সেভাবে ভাইয়ের পড়ার জন্য সময় দেওয়া হয়ে উঠত না।
মা রেডিওতে নাটক শুনতে খুব ভালোবাসত। শুক্রবার রাত আটটা, শনিবার সম্ভবতঃ দুপুর তিনটে, রবিবার দুপুর আড়াইটে, এগুলো ছিল আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নাটক সম্প্রচারের সময়। একটু বড় হতেই মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও নাটক শোনার বেশ নেশা হয়ে গেল! একদিন ঐরকম কোনো এক শনিবার বা রবিবারের শীতের দুপুরে মা উঠোনের রোদে মাদুর পেতে রেডিওতে নাটক চালিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে, এদিকে আমি অঙ্ক খাতা বই নিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসেছি বটে, কিন্তু মা ঘুমিয়ে গেছে দেখে আমিও বই খাতা গুটিয়ে, এক মনে নাটক শুনছি। বাবা বোধহয় ঘরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ করে উঠে বেরিয়ে এসে দেখে আমাদের ঐ অবস্থা! বাবা তো গেল প্রচণ্ড রেগে! সেই সময় এমনিতেই বাবা খুব রাগী ছিল, বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম, তার ওপর অঙ্কে ফাঁকি দিয়ে নাটক শোনা! বাবা আমাকে তো কিছু বলল না, কিন্তু মায়ের ওপর প্রচুর রাগারাগি করে, রেডিওটা তুলে দুম করে উঠোনের আরেক দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল! ব্যস, মাথায় উঠল নাটক শোনা! তবে পরে মনে হয় বাবা নিজেই আবার সারিয়ে এনেছিল রেডিওটা।
ছোট থেকেই আমাদের বাড়িতে কোনও না কোনও পোষ্য থাকতই। একদম ছোটবেলায় বাড়ির সামনে থাকত পঞ্চু, তারপর একে একে এল লাল্টু, মান্টু, লালী। এইসব সারমেয় পোষ্যের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিড়ালছানাও দিব্যি আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছে। আমার মা ছিল এদের সবাইকার পরম আশ্রয়। ওদের জন্য মায়ের ভালোবাসা আর যত্নের অন্ত ছিল না। একটি চন্দনা পাখি ছিল আমাদের, যাকে আমি জ্ঞান হয়ে থেকে দেখছি, নাম ছিল মিঠু। তার ঠোঁটের এমনি ক্ষমতা ছিল যে সে পুরোনো দিনের মোটা পাতের তৈরি খাঁচার নিচের দিকের সব পাত বাঁকিয়ে খাঁচার নিচটা পুরো ফাঁকা করে দিয়েছিল, আর সেই ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো ঘরের ভিতর যেখানে খুশি হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াত। আমরা ধরতে গেলেই আমাদের ঠুকরে দিত, এই ভয়ে আমরা কেউই ওকে ধরতে সাহস পেতাম না। শুধু মা-ই ওকে ধরে স্নান করাতো, আদর করত, খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে খেতে দিত, ও কিছুই বলত না, বরং খাঁচা থেকে যখন বেরিয়ে ঘুরত, মাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে গিয়ে মায়ের কাপড় বেয়ে বেয়ে উঠে কাঁধে গিয়ে বসে থাকত। আমার যখন একুশ বছর বয়স, সেই সময় একদিন মা ওকে হলুদ দিয়ে স্নান করিয়ে খাঁচাটা চৌবাচ্চার পাড়ে রেখে কিছু একটা কাজে গেছে। খানিকক্ষণ পর এসে দেখে খাঁচাটা চৌবাচ্চার মধ্যে কিভাবে পড়ে গেছে, খাঁচার মধ্যে নিথর হয়ে আছে মিঠুর শরীর! মিঠুকে কোলের মধ্যে নিয়ে মায়ের সেদিনের সেই আর্ত কান্না আজও মনে পড়লে চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।
স্কুল আর বাড়ির বাইরে মায়ের ছিল অসম্ভব বেড়ানোর সখ। সবসময় হয়তো বাইরে, দূর বেরোনো সম্ভব হত না, কিন্তু মাঝে মাঝেই, সুযোগ করে মা কাউকে না কাউকে সঙ্গী করে টুকটাক বেরিয়ে পড়ত শহরের ভিতরেই যে সব দর্শনীয় জায়গা আছে সেই সব জায়গায় কিংবা বর্ধমানের আশেপাশে কাছাকাছির মধ্যে বেড়ানোর জায়গাগুলোতে। এই ব্যাপারে মায়ের একজন ভীষণ ভরসার সঙ্গী ছিল জয়তী মাসি। যদিও উনি বাবার বন্ধুস্থানীয় লেখক প্রদীপ রায়ের স্ত্রী, কিন্তু ওঁদের দুজনের বয়সের ব্যবধান ছিল অনেকখানি। মায়ের থেকেও বয়সে অনেকটাই ছোট, প্রথম দেখার পর থেকেই মাকে দিদি বলে একদম আপন করে নিয়েছিলেন, সেই সূত্রেই প্রদীপ কাকুর স্ত্রী আমাদের দুই ভাইবোনের কাছে হয়ে উঠলেন জয়তী মাসি। পেশায় এয়ারফোর্সের ডাকসাইটে র্যাডার ইঞ্জিনিয়ার হলেও, যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন, তখন তাঁর মিষ্টি মিষ্টি মৃদু স্বরে কথাগুলি শুনলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত যে এই মানুষটিই ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তরের অনেক গুরু দায়িত্ব মাথায় নিয়ে চলেন! সেই জয়তী মাসি ছুটি পেলেই আমাদের বাড়ি আসতেন আর মাঝে মধ্যেই মাকে নিয়ে দিব্যি দু-এক দিনের ছোট ছোট ট্যুরে বেরিয়ে পড়তেন! তবে ক্রমশঃ ক্রমশঃ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব বাড়তে থাকায় জয়তী মাসির সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। তারপর সম্ভবতঃ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রজেক্টের কাজে নাসায় চলে যাবার পর যে কোন কারণেই হোক জয়তী মাসির সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় মায়ের একটার পর একটা ধারাবাহিক পড়ে যাওয়ার ঘটনা। প্রতিটি পড়ে যাওয়ার সাথে অনুষঙ্গ হিসেবে আসতে থাকে একেকটি বড় বড় অপারেশনের ধকল। ক্রমশঃ ক্রমশঃ দুই হাতে, কোমরে হাড়ের পাশে সঙ্গী হয় মেটাল প্লেট কিংবা রড কিংবা বল সেই সাথে এক গুচ্ছ স্ক্রু। একটার পর একটা এই সব অঘটনের অভিঘাতে মায়ের মধ্যের সেই কর্মচঞ্চল, প্রাণচঞ্চল মানুষটি যেন আস্তে আস্তে কেমন হারিয়ে যেতে বসল। আর মায়ের মনোবল যেটুকু যা অবশিষ্ট ছিল, তার সবটুকু একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল ২০১৮ সালে, যখন আমার ভাই ধৃতিমান সুর মাত্র ৪৪ বছর বয়সে আকস্মিক ভাবে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল। তারপর থেকে একটা বিষয় আমি ভীষণ ভাবে উপলব্ধি করছি, আর সবাই আত্মস্থ করতে পারলেও, সন্তান হারানো মায়ের শোক বোধহয় কখনোই কোনো সান্ত্বনাতেই প্রশমিত করা যায় না। সেই শোকের গুরুভার অন্য কারুর পক্ষে অনুভবে আনাটাও বোধহয় দুঃসাধ্য এক কাজ! কী জানি, হয়তো শরীরের ভিতর তিল তিল করে গড়ে তোলা নাড়ীর টানের জন্যই এমনটা হয়! তখন ভাইয়ের পুত্র দীপায়ন দশ বছরের। দীপায়নের মধ্যেই মা চেষ্টা করত ভাইকে খুঁজে নিতে। একটা সামান্য ঘটনার কথা আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলব না। একদিন মায়ের কাছে গেছি, আমাদের বাড়ির ডাইনিং-এ পর্দা টাঙানোর রডটা থেকে একটা সুতো ঝুলছে। কী কারণে এখন ঠিক মনে পড়ে না, আমি ঐ সুতোটা খুলে ফেলে দেবার জন্য হাত বাড়িয়েছি, অমনি মা হাঁ হাঁ করে উঠল, খুলিস না, খুলিস না, ঐ সুতোটা দিয়ে বাবুসোনা গোগোলের পাঁচ বছরের জন্মদিনে বেলুন টাঙিয়েছিল। ওটা ওখানেই থাকুক।
এই ভাবে বিগত ছ’বছর ধরে চোখের সামনে অসহায় ভাবে দেখলাম একটু একটু করে একটা ইমারত কেমন করে চূর্ণ চূর্ণ হয়ে মাটিতে মিশে যায়! তবে সেই সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে এও দেখেছি, আমার সেই পুরোনো দিনের রাগী গুরুগম্ভীর বাবা, অসংখ্য সামাজিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে, কী অসম্ভব এক ধৈর্য্য, মমত্ব এবং নিষ্ঠা নিয়ে ভাইয়ের অনুপস্থিতির অভাবটুকু যথাসম্ভব পূর্ণ করে মাকে আগলে রাখার, যত্নে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। সৌভাগ্যবশতঃ আমার শ্বশুরবাড়ি খুব কাছেই হওয়ার জন্য, আমিও সাধ্য মতো যতটুকু পেরেছি মাকে সঙ্গ দেবার চেষ্টা করেছি। গৃহবন্দী মায়ের মন একটু ভালো রাখার জন্য মাঝে মধ্যেই বাবা চেষ্টা করত মাকে গাড়ি করে কাছে পিঠে একটু ঘুরিয়ে আনতে, মায়ের পুরোনো পরিচিত বন্ধুদের সাথে দেখা করিয়ে আনতে। কখনো কখনো সঙ্গে থাকতাম আমিও। ‘ছোটদের কথা’ পত্রিকার শারদ সম্মান অনুষ্ঠানে কিংবা শিশু নিকেতন স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে নানা রকম শারীরিক প্রতিকূলতা নিয়ে কষ্ট করে হলেও মাত্র মাস তিনেক আগে পর্যন্তও মা আমাদের মাঝখানে উপস্থিত থেকেছে। এমনকি ‘ছোটদের কথা’র এবছর শেষ শারদ সম্মান প্রদানের অনুষ্ঠানে রেলিং ধরে ধরে আস্তে আস্তে জাগরী হলের দোতলার অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠে সবাইকার সঙ্গে খুব আনন্দ করেই সময় কাটিয়েছে! অথচ ঠিক তার একমাসের মাথায়, কী যে হল, হাঁটুর ব্যথা যা ছিল সে তো ছিলই, কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন ডানদিকের হাঁটু পুরো লকড হয়ে গেল! আবার নতুন করে বিছানাবন্দী জীবন শুরু হতে চলল! এই অবস্থায় মায়ের খুবই ইচ্ছা হল হাঁটু অপারেশনের। চার বছর আগেই মায়ের ডাক্তার বলেছিলেন নী রিপ্লেসমেন্ট ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এখন চারিদিকে রোবটিক সার্জারি করে সবাই চটপট ভালো হয়ে যাচ্ছে, এই খবরটা শোনার পর থেকেই মায়ের ইচ্ছেটা আরও বেশি করে জোরালো হয়েছিল। মূলতঃ মায়ের ইচ্ছেটা পূরণ করা যায় কিনা দেখার জন্যই বাবাও বিষয়টিতে উদ্যোগী হল। কারণ একজন মানুষকে দিনের পর দিন বিছানাবন্দী অবস্থায় থাকতে হলে তার যে কতখানি কষ্ট, সেটা একমাত্র যে বা যারা তার কষ্টের চাক্ষুষ ভাগীদার হয়, তারাই শুধু বোঝে। তাই বাবাও খানিকটা ঝুঁকি আছে জেনেও কোলকাতার এক বেসরকারি নার্সিংহোমে এশিয়া খ্যাত রোবটিক সার্জনের কাছে মায়ের নী রিপ্লেসমেন্ট অপারেশন করিয়ে আনল। অপারেশন করে মা ভীষণ খুশি! বলল দুটো হাঁটুই একেবারে করিয়ে নিলে হত! আবার একটা করবার জন্যে আসতে হবে! সাতদিনের মাথায় মাকে বাড়ি নিয়ে এলাম। মা’ও খুশি, আমরাও খুব খুশি, মা এবার আবার হাঁটতে পারবে!
কিন্তু ভবিষ্যতটা যে আমরা দেখতে পাই না! তাই এতগুলো বড় বড় অপারেশনের ধকল পার হয়ে এসে এই বার মনে হয় মায়ের জীবনীশক্তি আর লড়াই করতে পারল না! বাড়ি আসার একদিন পর থেকেই নানা রকম ইনফেকশনের জটিলতায় মাকে আবার স্থানীয় নার্সিংহোমের আই.সি.ইউ-তে ভর্তি করতে হল। যতক্ষণ পর্যন্ত মা সজ্ঞানে ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত মায়ের একটাই কথা, কখন তোরা আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবি? আমার এখানে ভালো লাগছে না! কিন্তু বাড়িতে যতটা সম্ভব অক্সিজেন বা অন্যান্য সাপোর্টের ব্যবস্থা করেও আমরা তো বাড়িতে মাকে রাখতে পারলাম না, শেষ চিকিৎসার জন্য নিরুপায় হয়ে আবার আমাদের মাকে নিয়ে যেতেই হল নার্সিংহোমে। শেষ যাওয়ার সময় আমি যখন অ্যাম্বুলেন্সে মাকে ধরে বসে আছি, ভীষণ শ্বাসকষ্টের মধ্যেও মায়ের ঠোঁট দুটো যেন একটা অভিমানী কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল! মা যেন বলতে চাইছিল, তোরা আবার আমাকে ঐ নার্সিংহোমেই নিয়ে যাচ্ছিস! মায়ের সেই চাপা কান্নায় দুমড়ে ওঠা মুখচ্ছবিটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার বুকের মধ্যে গাঁথা হয়ে থাকবে।
মাকে আমরা বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট ঘরের গণ্ডী ছাড়িয়ে মা এখন পৌঁছে গেছে আরও অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধার, ভালোবাসার উন্মুক্ত আকাশে! সন্তান হিসেবে এর থেকে বড় গর্বের বিষয় আর কী হতে পারে!