ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
৪ ডিসেম্বর ব্রাহ্ম মুহূর্ত ৪টা ৪৪ মিনিটে বর্ধমানে এক বেসরকারী হাসপাতালের বেডে আদরের কন্যা, জামাতাকে সাক্ষী রেখে না-ফেরার দেশে পাড়ি দিল আমার ছ’দশকের বেশী সময়ের সংগ্রামী সাথী এবং জীবনসঙ্গী কল্পনা। পূর্ণ করল নিজের অন্তিম ইচ্ছা আমাকে রেখে, আমার আগে না-ফেরার দেশে পাড়ি দেবার। তার আগে রাত আড়াইটা নাগাদ আমাকে হাসপাতালে অনুমতি দিয়ে আসতে হয়েছিল সহজভাবে চলে যাবার, কোন কৃত্রিম উপায়ে আর আটকে রাখতে চাইনি। মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম আসন্ন কঠিন সত্যকে মেনে নেওয়ার জন্য। সকাল এগারোটা নাগাদ কল্পনার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে এল দোলা, পল্লব এবং শিশু নিকেতন স্কুলের শিক্ষকরা। প্রতিবেশীদের অন্তিম দর্শন ও শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের পর শিশু নিকেতন স্কুলে নিয়ে গেল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রেক্টর, শিক্ষক -শিক্ষিকাদের প্রিয় কল্পনাদিকে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের জন্য। সেখান থেকে সোজা বর্ধমান মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে। উল্লেখ্য ২০০০ সালে আমাদের দুজনেরই মৃত্যুর পর আমাদের মরদেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য দানপত্র করা ছিল। সেখানেই দোলা ও পল্লব মা-র নশ্বর দেহ অ্যানাটমি বিভাগে হস্তান্তর করে দেয়। পরিসমাপ্তি ঘটে ৮৩ বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, সাংসারিক জীবনে সকলের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ ও স্নেহশীল, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় দিদিমনি, ছোটদের সৃজনশীলতা ও সাহিত্যপ্রতিভা স্ফূরণের জন্য পঞ্চাশ বছর ধরে ‘ছোটদের কথা’ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালনের অনন্য নজির স্থাপন করা এক বর্ণময় জীবনের।
দেশভাগ মেনে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষময় ফলশ্রুতি পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় নতুন করে জীবন জয়ের কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস আমরা জানি। আমাদের দুটি পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘকালীন সেই কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমেই নিজেদের প্রথম জীবন অতিবাহিত হয়েছে। আর এই সংগ্রামই এই দুটি পরিবারকে বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের অনুগামী করেছিল। আর এই আদর্শের বন্ধনেই ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৯৬০ থেকে দুজনে পরস্পরের সংগ্রামের সাথী। পরে ১৯৬৫ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অনেক বাধা বিঘ্নের মধ্য দিয়ে চলেছে আমাদের দাম্পত্য জীবন। ২০২৪-এর ৪ ডিসেম্বর আমাকে ভারমুক্ত করে কল্পনা পরিতৃপ্ত চিত্তে জীবন মঞ্চের যবনিকা টেনে বিদায় নিল। ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম’।
আমাদের যৌথ সংসার জীবনে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে পর্যন্ত প্রথম জীবনের কৃচ্ছতা এবং কঠিন সংগ্রামের পর সবদিক দিয়েই আমরা পৌঁছেছিলাম পরিপূর্ণ সুখ ও শান্তিতে উপচে পড়া শান্তির নীড়ে। আমরা দুজনেই ভাবতাম বিদায় বেলায় এই কথা বলে যাব ‘‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’’। আমাদের দুজনের এটাই ছিল জীবনাদর্শ। কিন্তু ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ আমাদের একমাত্র পুত্র ধৃতিমানের ৪৪টি বসন্ত পেরোনোর আগেই আকস্মিক অকাল প্রয়াণ আমাদের সেই শান্তির নীড়ে ঘটে যায় বিনা মেঘে বজ্রপাত। ভরা সুখের সময় এই শোকের আঘাতে কল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে বাহ্যিক ভাবে আপাতদৃষ্টিতে সব ঠিক আছে বলে মনে হলেও আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করতাম ওর নীরব কান্নার গুমরে ওঠা। এখান থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারাতে শুরু হয়।
আমরা বিশ্বাস করতাম এ ধরায় মানুষের একটাই জীবন। সেই জীবন শুধু আপনারে লয়ে বিব্রত থাকার জন্য নয়। পৃথিবীতে জীবজগতে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সবশেষে মানুষের আবির্ভাব। প্রকৃতি থেকেই মানুষের সৃষ্টি হলেও মানুষই পেরেছে শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে। মহাকালের গর্ভে মানব জীবন পদ্মপাতায় শিশিরবিন্দুুর মতই ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। আমরা দুজনেই এই সত্যকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সাধ্যমত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং সুস্থ মননের বিকাশে নিঃস্বার্থ ভাবে এবং ধারাবাহিক ভাবে কিছু কাজের প্রয়াস করেছি। জীবনের অমূল্য সময়ের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশী সময়ে কল্পনা নীরবে অনেক কৃচ্ছতাকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে বলেই আমরা অসংখ্য গুণীজনের সান্নিধ্য, ভালবাসা, উপদেশ, পরামর্শে নিজেদের ঋদ্ধ করেছি, নতুন উদ্যমে কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ছিন্নমূল এক অতি সাধারণ পরিবারের দুই কিশোর-কিশোরী সম্পূর্ণ অচেনা অজানা শহরে কঠিন জীবন সংগ্রামের পর জীবনের সায়াহ্নে এসে মানুষের এত ভালবাসা, শ্রদ্ধা অর্জন আমরা পরম প্রাপ্তি বলেই মনে করতাম। কাজের মধ্যেই খুঁজে নিতাম বেঁচে থাকার রসদ। এতদিন দুজনে যৌথভাবে চলেছে এই সংগ্রাম। এখন থেকে অন্তরে কল্পনার স্মৃতিভার নিয়ে খুঁজে নিতে হবে একাকী চলার নতুন পথ।