ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
শ্রীমতী কল্পনা সুর। আজকে যাঁর স্মৃতিচারণা করব তাঁর কর্মময় এবং বর্ণময় জীবনের বেশীর ভাগটাই আমার শোনা। আমার অনুভব, আমার অন্তরের শ্রদ্ধা থেকেই দু-চার কথা লিখতে চেষ্টা করছি।
বিপাশা ওঁনার কন্যা, আমার সহকর্মী এবং আমাদের বসার জায়গাও কর্মক্ষেত্রে পাশাপাশি। ওকে যতদিন যাবৎ চিনি ওর শান্ত, ধীর, স্থির, গভীর স্নিগ্ধ অথচ দৃঢ় একটি চরিত্র— দেখেই মনে হত এই চরিত্রের বীজ বপন হয়েছে কার হাতে? প্রত্যেকেরই চরিত্র গঠনে তার পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমি প্রায় ওর মুখে মা, বাবার গল্প শুনতাম। মায়ের নানান কাহিনী, কত অভিজ্ঞতা যা তিনি সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করেছেন তার নানান গল্প। ওর কথা শুনতে শুনতে একটি নরম মনের গুণী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক মায়ের চরিত্র আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করত।
উনি নিজে একজন শিক্ষিকা ছিলেন। সঙ্গে একটি শিশুদের পত্রিকারও সম্পাদনা করতেন। বর্তমানে যে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দিন থেকে আজ পর্যন্ত তার সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
ওঁনার কর্মজীবন সম্পর্কে ওঁনার কর্মসূত্রে যারা কাছে থেকে পেয়েছেন তারা আলোকপাত করবেন নিশ্চয়ই, আমি আমার চোখে ওঁনাকে যেভাবে দেখেছি তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। উনি আমাকে তখনও চিনতেন না, বলা যায় যেটুকু চিনতেন বিপাশার কাছ থেকে শুনে। উনি নিজেও তখন খুব একটা সুস্থ নন। আমার পায়ের অবস্থা তখন খুব খারাপ। খুব কষ্ট পাচ্ছি তাই শুনে উনি যে আয়ুর্বেদ ওষুধ খেয়ে ভালো ছিলেন তখন সেই ওষুধ বিপাশার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন, সেটা তবুও ঠিক আছে কিছুদিন পর ওষুধ শেষ হয়ে গেলে নিজে, আলোদিকে সঙ্গে করে স্কুলের গেটে ওষুধ পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন আমার অজান্তে। সেদিন আমার চোখে জল এসে গেছিল। অন্যের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে ওঁনার ঐশ্বরিক ইচ্ছার প্রমাণ সেদিনই পেয়েছি। উনি মাঝে মধ্যেই রান্না করে আমাদের স্কুলে পাঠাতেন, বিশেষতঃ যেটা ইচ্ছা হলেও আমরা রাঁধতে পারিনা (শুটকি মাছ, যেটা শুনে অনেকেই নাক বন্ধ করবে) কত অপূর্ব রান্না করতেন, আমাদের মুখে তার স্বাদ এখনও লেগে আছে। রান্নার হাতও ছিল চমৎকার।
জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা একমাত্র পুত্রের মৃত্যু। সেই ভয়ঙ্কর দিনে যখন আমরা ওঁনার বাড়িতে গেছি তখন অবাক হয়ে দেখলাম নিজের পুত্রের জন্য কাঁদছেন অঝোরে তার মধ্যেও ওঁনার পুত্রবধূ যে দূরে কলেজ করতে যায় তাতে পুত্রবধূর যে কতখানি কষ্ট হয় সেটাও বার বার বলছেন! আমি সেদিন অবাক হয়ে ভাবছিলাম নিজের সন্তানশোক বুকে করে পুত্রবধূর কষ্টের কথাও ওর দরদী মনের কষ্টে বয়ে চলেছেন। মন কতখানি উদার হলে সেই মুহূর্তে সেই কথা বলা যায়!
যখনই দেখা হয়েছে, খুব কমই দেখা হত যদিও, তখনই ওঁনার মুখে বিভিন্ন জন কীভাবে সমস্যায় দিন কাটাচ্ছে তাদের সমস্যা কী কী করলে লাঘব হয় তার কথা শোনাতেন।
আসলে আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যাদের কাছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অনেক উপরে সমষ্টিকে রাখেন তাঁরা। সমষ্টির কল্যাণের জন্যই তাঁদের জীবন উৎসর্গীকৃত। ওঁনার সম্পর্কে আরও অনেক কথাই না বলা রয়ে গেল। বিপাশার কাছে শুনতাম উনি জীবনের উপান্তে এসে যে যে লেখা লিখতেন তা নিজের স্বপ্ন নিয়ে। যদিও হাতের আঙুল নিজের বশে ছিল না, স্যার-এর চাপাচাপিতে লিখতেন। বিভিন্ন স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন।
তিনি যখন জ্ঞানহীন অবস্থায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন তখন চোখ বন্ধ অবস্থায় তিনি নিশ্চয় যে স্বপ্ন দেখছিলেন তা হয়ত নতুন কিছু সৃষ্টির স্বপ্ন। হয়ত দিন বদলের স্বপ্ন—
অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।