ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
‘শিশু নিকেতন’ ১৯৭৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ৪টি ছাত্র নিয়ে শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক কল্পনাদি ও ওপাড়ারই ছেলে নির্মল মজুমদার। তখন আমি মাঝে মাঝে স্কুলে আসতাম। ময়ূরমহলে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে স্কুল শুরু হল। কিছুই নেই, ঘরের মেঝেতে চক দিয়ে ছবি এঁকে লিখে বাচ্চাদের সাথে খেলাচ্ছলে পড়ানোর চেষ্টা তার সাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ছড়া-গল্প বলা শেখানো। ১৯৭৫ থেকে আমি পুরোপুরি স্কুলে যোগ দিই, সবে বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে। আর সরাসরি কল্পনাদির নেতৃত্বে কাজ শুরু করি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালেই ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেল, তার কারণ বর্ধমান শহরে তখনও কেজি, নার্শারী স্কুল ছিল না— যা ছিল তা ফ্রী প্রাইমারী স্কুল, বেশীর ভাগই সকালে।
ফলস্বরূপ যে সব মায়েরা চাকরী করতেন তারা শিশু নিকেতন-এ তাদের সন্তানদের ভর্তি করতেন।
কল্পনাদির ছিল অসম্ভব স্মরণ শক্তি। উনি রাশিয়ান গল্পগুলো প্রায় বই না দেখে বাচ্চাদের গল্প শোনাতেন মনে পড়ছে ‘‘গোল রুটি’’ গল্পটা বাচ্চাদের খুব আকর্ষণ করতো আর কল্পনাদি ক্লান্তিহীন ভাবে গল্প বলতেন— আমি বহু চেষ্টা করেও আজও তা পারি না— এদিক ওদিক হয়ে যাবেই।
কয়েক বছর পর কল্পনাদি নিজের পুরোনো স্কুলে সাধুমতী বালিকা শিক্ষাসদনে যোগদান করলেন কিন্তু আমাদের অভিভাবক হয়ে রেক্টর হিসাবে রয়ে গেলেন— আজীবন তিনি শিশু নিকেতনের এই পদ অলংকৃত করে ছিলেন।
আমারও বয়েস বেড়েছে, অবসর নিয়েছি বহু বছর, ফলে বর্ধমানে কম থাকি সব সময় দেখা করতে পারতাম না, তবুও চেষ্টা করতাম সময় থাকলেই দেখা করতে। পুরোনো দিনের নানা কথা হোত— অসম্ভব এক দরদী মন ছিল। সেই সময় আমরা এক পরিবারের মতো মিশতাম তাই যখনই কল্পনাদির কাছে যেতাম উনি আমার সব ভাইবোন তাদের ছেলেমেয়ে সবার খবর নিতেন। আমার দিদির নাতনি মানে আমারও নাতনি সে কত বড় হোল তার ছবি দেখাতে হতো।
গত আগস্ট মাসে আমার পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে, তখন আমি বর্ধমান যেতে পারি নি ফলে কল্পনাদির সাথে দেখা করা আর হয় নি। পুজোর পর অন্যান্য দিদিমনিরা আমাকে ফোনে জানালো ওরা যাচ্ছে, আমি বললাম আমি পরে যখন বর্ধমান যাব তখন দেখা করবো, সেই মতো ২৮ নভেম্বর বর্ধমান গেলাম, ২৯ নভেম্বরেই দেখা করতে গেলাম। আমি ও সোমা। ধীরেনদা বললেন, ‘‘এই ঘুমিয়েছে’’। আমি বললাম, থাক পরে আসব এখন ডেকো না। কিন্তু তার পর দিনই রাত্রে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হোল। ৪ ডিসেম্বর কলকাতা ফিরব বলে ট্রেনে চেপেছি মনটা অস্থির, বসেই ফোন খুলে দেখলাম কল্পনাদি নেই। ট্রেন থেকে নেমে শিশু নিকেতন চলে গেলাম। সবাই আমরা গিয়েছিলাম, কল্পনাদি এলো শায়িত অবস্থায়— সেই অবস্থায় বর্ধমান মেডিকেল কলেজের মানব কল্যাণের জন্য কল্পনাদিকে রেখে ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে এলাম কলকাতায়।
মানুষের কথা ভেবেছে তাই মানব কল্যাণে নিজেকে দিয়ে গেলে, রেখে গেলে ধীরেনদা, দোলা, নাতি-নাতনীদের।
‘ছোটদের কথা’, ‘শিশু নিকেতন’-এর বিভিন্ন পর্যায়ে কল্পনাদিকে একজন অভিভাবিকা হিসেবে যেভাবে পেয়েছি সেই স্মৃতি আমাদের কাছে যতদিন বাঁচব অমলিন হয়ে থাকবে। ‘ছোটদের কথা’ ও ‘শিশু নিকেতন’-এর উত্তরোত্তর সাফল্যের মধ্য দিয়ে কল্পনাদির স্মৃতি জাগরুক থাকুক এই কামনা করি।