ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
চলে যাচ্ছেন একের পর এক অভিভাবক। রিক্ত হচ্ছি। সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে ছায়া প্রদানকারী গুরুজনেরা।
কেবলই হারানোর পালা চলছে আমাদের। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু মন যে মানতে চায় না। যেতে দিতে হয় তবু, হায়!
ছোটবেলা থেকেই মা বাপির মুখে ধীরেনদা ও কল্পনাদির নাম শুনে শুনে কত আখ্যান কাহিনী শোনা। ছোটবেলা থেকে ধীরেন জেঠুকে দেখে আসছি আমাদের পরিবারের অভিভাবকদের মধ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করতে।
সেই শিশু নিকেতনের জন্মলগ্ন... কল্পনা জেঠিমা ও ধীরেন জেঠুর সঙ্গে সমানতালে পরিশ্রম করে তিলতিল করে গড়ে তুললেন এই স্কুল। কত স্মৃতি! ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছায়া ছায়া হয়ে। ‘ছোটদের কথা’ পত্রিকার সম্পাদনায় গুরু দায়িত্ব তুলে নিলেন কল্পনা সুর। ছোটদের জন্য কবে আর ভেবেছে কেউ এভাবে আমাদের শহরে।
‘ছোটদের কথা’ হাাঁটি হাঁটি পা পা করে পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে গেছে। আমার বাপি সলিল ভট্টাচার্য নিয়মিত লিখে গেছেন কল্পনা সুর সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকায়। পত্রিকার সম্পাদনায় কল্পনা জেঠিমাকে নিয়ে আলোচনা, মিটিং এসব নিয়ে বাপিকে কত ব্যস্ত থাকতে দেখেছি।
মায়ের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক যখন ধীরেন জেঠু, তখন আরো নিবিড় করে চিনেছি মানুষটিকে। আর আমাদের শৈশব কৈশোরের রাংতা মোড়া সেই দিনগুলিতে তো এইসব মানুষগুলির আনাগোনায় কেটে গেছে।
মায়ের ও বাপির কোনো অসুবিধা বা দরকারে দেখতাম কেবলই ধীরেন জেঠুকে ফোন করতে। জেঠু কত যে আসতেন আমাদের জগৎ বেড়ের বাড়ি এষণায়!
বাপি তার শেষের দিনগুলোতে বারেবারে আমায় বলতেন, ‘‘ধীরেনদা অনেক দিন আসেন না। একবার বলিস তো আমি আসতে বলেছি।’’
সেদিনগুলোতে বাপির কাছে আসার লোকজনের সংখ্যা কমতে কমতে যে গুটিকয় ছিলেন, তাদের মধ্যে ধীরেন জেঠু একজন। নিয়ম করে তার ছোট ভাই সলিল ভট্টাচার্যকে দেখতে আসতেন। বাপির অসুস্থ গৃহবন্দী অবস্থায় স্থবিরতার দিনগুলির মনোকষ্টের উপশম ছিলেন তার ধীরেনদা।
মায়ের কাছে কল্পনা জেঠিমাকে নিয়ে ছোটবেলার গল্প শোনা। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলে পড়তেন মায়ের চেয়ে অনেকটা উঁচু ক্লাসে। খেলাধুলায় চৌকস ছিলেন বরাবর। মা আজও স্মৃতিচারণ করছেন। স্পোর্টস-এ বরাবর চ্যাম্পিয়ান। অ্যাথলেট ছিলেন ছাত্রাবস্থায় ভালো। মায়েদের দলবলকে লিড করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। পেশায় তিনি শিক্ষিকা পরবর্তীতে। বর্ধমান সাধুমতী বালিকা বিদ্যালয়ের। জেঠু ধীরেন সুরের যোগ্য। একসাথে দুজনে কত যে সাংগঠনিক কাজ করেছেন আমাদের এই বর্ধমান শহরের!
ধীরেন জেঠুকে দেখে দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর এই মানুষটি যখন ফিরলেন পুত্রকে অন্তিম বিদায় জানিয়ে বাড়ি, আমার অসুস্থ অশক্ত বাপি ও মা কে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে জেঠুর বাড়ির সামনে। কী অবলীলায় এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়েও ঋজু হয়ে হেঁটে আসছেন জেঠু! ঘরে ঢুকেই কল্পনা জেঠিমাকে বলছেন, ‘‘কল্পনা, সলিল এসেছে, ঊষা এসেছে।’’
একবারের জন্য ভাঙতে দেখিনি শোক বিপর্যয়ে। কোথাও বিলাপ নেই, প্রকাশ নেই, হাহাকার নেই।
সন্তান হারানোর বেদনাকে বহন করে প্রতি বছর মৃত্যু দিনে আয়োজন করেন পুত্রের স্মরণ অনুষ্ঠান। সেও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। জেঠিমাও একই ভাবে সাথে থাকলেন।
জেঠিমা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন বারংবার। জেঠু ধীরেন সুরের পরম মমতায় তাকে আগলে রাখা, সঙ্গ দেওয়া, সুস্থ করে তোলা... সবটাই গল্পকথা হয়ে থাকবে।
এবারে আর জয় হলো না। হারতে আমাদের হয়, হারানো যে অবশ্যম্ভাবী! মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছি বারেবারে। মানুষ চলে যায়। থেকে যায় কাজ। যে মানুষ তার ছাপ রেখে যায়, সে ছাপ ইতিহাসের পাতা থেকে কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও ফিরে আসতে বাধ্য।
কল্পনা সুর বেঁচে থাকবেন আমাদের শহরের শিশু নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে, ‘ছোটদের কথা’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে।
আমার অন্তিম শ্রদ্ধা ও প্রণাম জেঠিমা।