ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
২০২৩ সাল এবং ২০২৪ সাল আমার কাছে অভিশাপস্বরূপ। ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর, বাংলা ১৮ অঘ্রাণ, বুধবার ১৪৩১ সন, যাকে কেন্দ্র করে এই দিন মাস ও সালের অবতারণা, সে হল আমার অবিচ্ছেদ্য, অন্তরঙ্গ বান্ধবী কল্পনা সুর, সেই বন্ধু আমার সুরলোকে যাত্রা করেছে। কল্পনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মোহনবাগান মাঠের পাশে অবস্থিত কাজীর হাটের সরকারী বি.এড. কলেজে। একসঙ্গে ভর্তি হতে গিয়েছি আমরা। প্রথম পরিচয়েই ওঁর সারল্য, সজাগ ও উন্নত মানসিকতার পরিচয় আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু তৎকালীন বি.এড. কলেজের বাড়িটির ভগ্নদশার কারণে আমাদের বেশ কয়েক দিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপবাগ ক্যাম্পাসের হিউম্যানিটিজ বিল্ডিং-এ ক্লাশ করতে হয়। যে কটা দিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করেছি, একসঙ্গেই পাশাপাশি বসেছি। কিভাবে কখন যে ঐ সম্পর্কটা বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিল, তা জানিনা। প্রকৃত বন্ধুত্ব বুঝি এইরকমই হয়! একদিন কল্পনা আমাকে ওর ময়ূরমহলের বাড়িতে নিয়ে গেল। বাড়িতে ছিলেন ওর শাশুড়ী মা, মমতাময়ী মায়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কলেজ থেকে ফিরতে যেদিন দেরী হোত, সেদিনই কল্পনা জোর করে আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যেত। বলত, ‘‘শ্যামসুন্দরে পৌঁছাতে অনেক দেরী হবে’’— এখানে আমার সঙ্গে দুটি ভাত খেয়ে যাও। এই টান, আন্তরিকতা কি ভোলা যায়?
বর্তমান ব্যবস্থার মেকি সম্পর্ক, কপটতা ও ছলচাতুরীর পরিবর্তে ও ছিল এক অদ্ভুত সারল্যের প্রতিমূর্তি। অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে আমার জীবনে একমাত্র কল্পনাই। ছাত্রী জীবনে উত্তর কোলকাতার রামমোহন কলেজে আমার আর এক বান্ধবী ছিল পারুল দত্ত। ১৯৯০ সালে শ্যামসুন্দর থেকে আমরাও বর্ধমানের ছোটনীলপুরে কল্পনার দাদা ডা. পরিমল মিত্রর বাড়ির কাছেই বাড়ি করে চলে আসি। ডা. পরিমল মিত্র-র নাম জানে না, এমন লোক ঐ অঞ্চলে নেই। তিনি ছিলেন গরীবের বন্ধু। ফলে সামাজিক দায়বদ্ধতার যে পাঠ কল্পনা পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিল, তার এক উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছিল। আজকের যে শিশুনিকেতন ভাতছালায় অবস্থিত, তারই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ময়ূরমহলের একটি ছোট্ট ঘরে।
১৯৮৯ সালে কল্পনা-ধীরেনদার পরিবার, আমাদের পরিবার এবং বর্ধমান উইমেনস্ কলেজের সর্বাণীদি— এই নয়জন মিলে পুরী বেড়াতে যাই। উঠেছিলাম আমরা ‘হোটেল সাগরিকা’-তে। হোটেলের সুন্দর ব্যবস্থাপনায় আমরা ব্যালকনিতে বসে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের নান্দনিক দৃশ্যের সাক্ষী ছিলাম। আবার কখনো সী-বিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। সেই সোনালী দিনগুলো আজ বড়োই মনে পড়ে। কতো হাসি-গল্পে সময় কেটে যেত।
তাই আজ কল্পনা নেই, এটা ভাবাও যাচ্ছে না। ওর নামটা বড়ই অর্থবহ। ও আমাদের সকলের অন্তরেই স্বতঃপ্রবাহমান। কল্পনা ছিল অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেমী, গাছ-পালার প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ ছিল। আমরা যখন শ্যামসুন্দরে ছিলাম, মাঝে মধ্যেই ও শ্যামসুন্দরে চলে আসত আমাদের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়-এ। এখানে এলেই আমরা বিদ্যালয়ের গাছ-গাছালী ঘেরা তপোবন সদৃশ চত্বরে হেঁটে বেড়াতাম, এ তো ভোলার নয়।
কল্পনা ওর বাড়ির ছাদে সব্জী বাগান করতো। সীম, লাউ, বরবটী, টমেটো— কত সবজী সেখানে ফলতো। আর সেই সব্জী যে কতো মানুষকে দেওয়া হতো— তার ইয়ত্তা নেই। মানুষের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার, আন্তরিকতা ওর চরিত্রের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। কখনো কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে দেখিনি। কল্পনা ওর প্রবহমান কল্পলোক থেকে নিরন্তর কল্পনার জাল বুনে চলেছে— এই কল্পনার মৃত্যু নেই। ও তো অবিনশ্বর। প্রশ্ন জাগে— তবে ওকে প্রত্যক্ষ করছিনা কেন? সে কোথায় গেল। মন বলে, ‘‘যেথায় গেলে হারায় সবাই, ফেরার ঠিকানা নেই।’’