মনে থাকবে ছোটবেলায় বিজয়াতে দিদুর হাতে নিমকি আর শীতে চুষি পিঠে
পৌলোমী চট্টোপাধ্যায়
মা.যখন বলল দিদুর স্মরণে একটা বই বেরোবে, কিছু লিখে পাঠাস দিদুর স্মৃতি, লিখতে বসে আমার সবার আগে সেই ছোটোবেলার কথাই মনে পড়ে গেল। ছোটোবেলার মামাবাড়িটা অনেক অন্যরকম ছিল, দেখতেও ছিল অন্যরকম, স্মৃতিগুলোও অনেক আলাদা। আমাদের বাড়িতে TV ছিল না। প্রায়ই weekend-এ আমি আর দিদি চলে যেতাম মামাবাড়ি আবার কখনও বা সারেগামার final দেখার জন্য। রোববার মানেই TV-তে সকাল থেকে একটার পর একটা show চলত। সকালে উঠেই দিদুর বানানো চা আর মেরি বিস্কুট এর কৌটো নিয়ে আমি আর দিদি বসে পড়তাম TV-র সামনে। বিকেল বেলায় সবাই মিলে ছাদে যাওয়া হত, তখন ছাদে দিদুর হাতে লাগানো গাছে ভর্তি থাকত। আর লম্বা একটা পাইপে করে সেই সব গাছে জল দেওয়াটাই একটা বিশাল উৎসাহের কাজ ছিল আমার কাছে। অনেক বছর হয়ে গেছে আর যাওয়াই হয়নি ছাদে। আমার মনের মধ্যে এখনও সেই ছাদের গাছে জল দেবার পর টবের মাটির সোঁদা গন্ধ, চিলেকোঠার ঘরটা, মামা-মামির সাথে রাত্রিবেলা ছাদে উঠে আমাদের বানানো অদ্ভুত সব খেলা— এগুলোই রয়ে গেছে। সন্ধ্যে হলেই প্রায়ই মামাবাড়ি গেলে আইসক্রিম খাওয়া হত। চকোবার আইসক্রিম দিদুর খুব পছন্দ ছিল।
দিদুর যেবার প্রথম হাত ভাঙল, হাতে প্লেট লাগাতে হয়েছিল, তখন আমি ছোটো। দিদুর তখন হাত নাড়াতেই অসুবিধা আর আমি নাকি দিদুকে মজা করে একদম ৩৬০ডিগ্রি হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতাম আর বলতাম, তুমিও করো তো এরকম!
দিদুর আরেকটা অভ্যাস ছিল যে আমরা মামাবাড়ি গেলেই আমাদের খালি বলত ক্রীম লাগাতে। আমরা বোধহয় নিজেরা লাগাতাম না ক্রীম। আর দিদু খালি বলত, ‘ক্রীম লাগা ভালো করে। চামড়াটা একদম খসটা খসটা হয়ে আছে।’
ছোটোবেলায় বিজয়া মানেই ছিল দিদু নিমকি বানিয়ে পাঠাবে আর শীতকালে ঘুড়িমেলার সময় হলেই পিঠে। ঘুড়ি ওড়াতে না পারলেও ঘুড়ি দেখে যে কী মজা পেতাম ছোটোবেলায়। শীতকালে দুপুরে ছাদে সেই পিঠে খাবার কথা খুব মনে পড়ে। পিঠে আমার ভীষণ প্রিয়। যদিও আমি ভাজা পিঠে একটু বেশি ভালোবাসি কিন্তু কোনভাবে দিদুর মনে হয়েছিল, আমার চুষি পিঠে বেশি পছন্দ। দিদু এত উৎসাহ নিয়ে আমাকে চুষি পিঠে খাওয়াতে চাইত যে দিদুর এই ভাবনাকে আর কোনদিন পাল্টাতে মন চায়নি।
কিছু দিন আগেও আমি বাড়ি গেছি শুনে দিদু মাকে দিয়ে সব সরঞ্জাম আনিয়েছিল। তিন্নি চুষি পিঠে ভালোবাসে, ওর জন্য পাঠাবো।
দিল্লি আসার পর থেকে বাড়ি গেলে, প্রতিবারই যাবার আগের দিন যেতাম মামাবাড়ি, দাদু দিদুর সাথে দেখা করতে। এই বছর মে মাসে যখন বাড়ি গেলাম, সেবার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনো কারণে। ফেরার দিন সকালে দাদুকে ফোন করেছিলাম প্রণাম জানাতে যে এবার আর যাওয়া হল না। দাদু বলেছিল, ‘এলি না? দিদা অপেক্ষা করেছিল দেখা করবে বলে।’ এক ঘণ্টা পরই বেরোনো এয়ারপোর্টের জন্য, কিন্তু দাদুর ওই কথাটা শুনে তখনই চলে গেছিলাম মামাবাড়ি দেখা করতে দিদুর সাথে। গিয়ে দেখলাম দিদু উঠোনে একটা চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছে। দাদু ভিতরে ঘরটায়। দিদু আমাকে দেখে এত surprised আর খুশি হয়ে গেছিল, ভাবতেই পারছিল না আমি সত্যিই চলে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে দাদুকে বলতে লাগল, ‘কী খাবে তিন্নি? কী আছে ওকে দাও।’ জুস খেতে খেতে সেদিন অনেক গল্প হল। ছবি তোলা হল। সেদিনও দিদু ওটাই বলছিল, ‘‘কত বড় হয়ে গেলি হ্যাঁ! এখন দিল্লি যাবি একা একা!’’
আমার কাছে ওই দিনের সকালটাই দিদুর সব থেকে প্রিয় স্মৃতি হয়ে থাকবে।