ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
আমার দাদু ডা. পরিমল চন্দ্র মিত্রের সেজবোন, বাবার সেজপিসি আর আমাদের সেজঠাম্মি।
ছোট করে কিছু লিখতে, স্মৃতিচারণ করতে বলে দাদু (শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ সুর), কিন্তু সেজঠাম্মি মানে তো ছোটবেলা। একটা আস্ত ছোটবেলাকে ছোট করে কিভাবে লিখব?
আমার বাবার মাত্র ২৮ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের পর মাথার ওপর ছাতার মতন যারা বিপদে আপদে পরামর্শ দিয়ে অভিভাবক হয়ে আগলে রেখেছিলেন তাঁরা হলেন সেজঠাম্মি ও দাদু।
সেজঠাম্মি মানে সার্কাস দেখতে নিয়ে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, জুরাসিক পার্ক (১৯৯৩) দেখতে যাওয়া, সেজঠাম্মির বাড়ি ময়ূরমহলে শের আফগানের সমাধি দেখতে যাওয়া, আরও কত কি! দাদুর কাছে কম্পিউটার শিখতে যেতাম ছোটবেলায় প্রতি রবিবার। প্রধান আকর্ষণ থাকতো সেজঠাম্মির বানানো লুচি আর আলুর তরকারি। মাঝে মাঝেই শনিবার দুপুরে স্কুল শেষ করে আমাদের মিত্র বাড়িতে আসতে তুমি। আর আমরাও স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে দেখতাম সেজঠাম্মি এসেছে। অনেক রকম গল্পের সম্ভার নিয়ে বসতে। বাড়ির সবাই মিলে একসাথে বসে আড্ডা হত। কী যে ভালো লাগার স্মৃতি সেগুলো।
পরবর্তীকালে আমার আর দিদির মিলিয়ে তিন পুত্রের সেজবম্মা। অনেক আনন্দ করেছি সবাই মিলে ময়ূরমহলের বাড়িতে। দইবড়া, ধোকলা, পনির পকোরা আরও কত কিছু। শেষবার যখন কলকাতায় নার্সিংহোমে সেজঠাম্মির সাথে দেখা করতে গেছি, তখনও দুই পুত্র ছিল আমার সাথে। সেজঠাম্মি দুজনের গালে হাত দিয়ে স্নেহমাখা গলায় বলল, ‘‘মাকে বিরক্ত করবি না যেন!’’
কী যে খুশি হয়েছিল সেদিন আমাদের দেখে। একবারও ভাবিনি সে দেখাই শেষ দেখা হবে।
রক্ত কথা বলে. তাই সেজঠাম্মির চলে যাওয়ার খবর যখন আমার ছেলেদের জানালাম ওরাও সেদিন সারাদিন চুপচাপ, শান্ত ছিল, একটুও বিরক্ত করেনি। মন খারাপ হয়েছিল ওদেরও।
ছোট্ট একটা গল্প। একটা সাপ বাড়ির সামনে কুয়োতে আটকে আছে। তাকে তো বাঁচাতে হবে। একটা ব্যাঙকে দড়িতে বেঁধে, তাকে টোপ বানিয়ে কুয়োতে নামিয়ে সাপটাকে টেনে ওপরে তোলা হল। মুক্তিলাভের আনন্দে সাপটাও ব্যাঙটাকে ছেড়ে দিলো। এই হল সেজঠাম্মি। বিড়ালের হাত থেকে টিকটিকিদের বাঁচানো, রাস্তার অসুস্থ কুকুরদের সেবাশুশ্রূষা, এইসব নিয়েই আমাদের সেজঠাম্মি। আদ্যন্ত প্রকৃতি ও পশুপ্রেমী। নরম মনের মানুষ।
শিশু নিকেতন স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী, সাধুমতী বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, ছোটদের কথা পত্রিকার সম্পাদিকা— এত রকম পরিচয়— সেকথা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। সেসব সকলের জানা।
যেটা নতুন করে, গর্ব করে বলার, তা হল তোমার দেহদানের সিদ্ধান্ত। এত ঘটনাবহুল, উৎসর্গীকৃত প্রাণ একজন মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তিতেও তুমি রেখে গেলে তোমার নিজস্বতা।
তোমাকে প্রণাম।
পুনশ্চ: ছোটনীলপুরে মিত্রবাড়ির সবটা জুড়ে তুমি থাকবে সেজঠাম্মি। তোমার লাগানো আম্রপালি গাছটা এবার থেকে তোমার স্মৃতি বহন করে চলবে।