ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আসেন যাঁরা চোখের সামনে থেকে সরে গেলে বোঝা যায় তাঁরা ঠিক আমাদের কতটা জুড়ে ছিলেন! এতদিন তো ভেবেছি, দাদু দিদু তো আছেই মাথার ওপর, এইরকমই থাকবে সারা জীবন। এই বার না পারি, পরের বার গিয়ে ঠিক দেখা করে আসব। আজ যখন দিদু নেই, মামাবাড়িতে গিয়ে ঐ ফাঁকা ঘরটাতে ঢুকতে হবে ভাবলেই মনটা কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছে!
ছোটবেলায় মামাবাড়িটা ছিল একটা খোলা বারান্দার মতো। অনেক কিছু নতুন নতুন জিনিস খুঁজে পাওয়া, অনেক কিছু শেখা, অনেক গল্প শোনা, মামার কাছে, দিদুর কাছে! এখানেই ছবি আঁকা, কিংবা কম্পিউটারে হাতেখড়ি। মামার সাথে বসে হরেক রকম এনসাইক্লোপিডিয়ার ছবি দেখা আর মস্ত বড় ছাদটায় রোজ বিকেলে দিদুর সাথে গাছে জল দেওয়া ছিল আমাদের দুই বোনের কাছে মামাবাড়ির একটা দারুণ আনন্দের সময়।
পড়াশোনার চাপ সেভাবে শুরু হওয়ার আগে আমি মাঝে মাঝেই বেশ কিছুদিন ধরে মামাবাড়িতে গিয়ে থেকে আসতাম। সেই সময়টাই দিদুর সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো। দিদুর সঙ্গে দিদুর বন্ধুদের বাড়ি, স্বাস্থ্যমেলা, শ্রাবণীমেলা, বইমেলা এইরকম কতজায়গায় গেছি। একবার তো দিদুর সঙ্গে দিদুর স্কুল সাধুমতীতেও গেছিলাম। দিদু পড়াতে খুব ভালোবাসত, কোনো একটা সন্ধেবেলা দিদু আমাকে ব্যাকরণ পড়াতে বসেছিল, খুব মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। তারপর মাঝে একবার হঠাৎ আমার উলবোনার শখ হল খুব। মা তো উলবোনা কিছুই পারে না, দিদুর কাছে এসে ট্রেনিং নিয়ে একটা ছোট পুতুলের সোয়েটার বানিয়ে ফেলেছিলাম সেবার। আর যখনই যেতাম দিদুর হাতের স্পেশাল ডিম ভাজাটা ছিল বাঁধা ধরা।
একবার দিদু জামাইষষ্ঠীতে বাবাকে নেমন্তন্ন করল, ‘‘সকাল সকাল চলে এস, এসে খাওয়া-দাওয়া করবে, উপর-নীচে একটু হুটোপাটি করবে, সবাই মিলে আনন্দ করবে।’’ আমরা তো সেই শুনে হেসে কুটোপাটি! আর ইদানীং খুব মজা পেতাম দিদুর ফেসবুক পোস্টগুলো দেখে। পরিস্কার বুঝতে পারতাম এদিক ওদিক হাত লেগে কোনোভাবে ওগুলো পোস্ট হয়ে গেছে। পরে দিদুকে ঐ পোস্টগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে দিদু অবাক হয়ে বলত, তাই বুঝি! কই আমি তো কিছু করিনি!
মামা চলে যাবার পর থেকেই দেখলাম, দিদু কেমন আস্তে আস্তে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে লাগল। তবু শেষ বছর দুয়েক তারই মধ্যে একটু সামলে উঠেছিল, আমরা যখন যেতাম খুব খুশি হত, অনেক কথা বলত, অনেক গল্প করত। শীতের দুপুরে গেলে দেখতাম দাদু, দিদু বাইরের ছোট্ট বাগানের গাছপালার মাঝে বসে কাগজ পড়ছে, আর দাদু দিদুর পোষা বিড়ালটি হয়তো পাশের কোনো চেয়ার বা দাদুর কোলে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। আমরা এলেই দিদু অস্থির হয়ে উঠত এটা সেটা খাওয়ানোর জন্য। একবার তো দেখি, দাদুকে বলছে অনলাইন অর্ডার করো!
সেই দিদুর হাতে লাগানো গাছপালায় ভরা বাগান, সেই ফাঁকা ছাদ, পাড়ার সব আদরের কুকুর, বিড়াল, সব কিছু রয়ে গেল, শুধু দিদু আজ আর এদের মধ্যে নেই। ভাবতে গেলে যেন হিসেব মেলানো যায় না, কিভাবে সব চলবে এখন থেকে! প্রিয়জনদের চলে যাওয়াগুলি এইভাবে প্রতিবার চিনিয়ে দিয়ে যায় জীবনের অনিশ্চয়তাকে! নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি। তবু এই হঠাৎ তৈরি হওয়া শূন্যস্থানগুলিকে মনের মধ্যে ধারণ করে রেখেই যে এগিয়ে চলতে হবে, সেই মনের জোর খুঁজে পাই না আজও!