ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
জন্ম ১৯৪১ সালের ১ মে, অবিভক্ত বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা চট্টগ্রামের অন্তর্গত শীতলপুর গ্রামে। পিতা উমেশ চন্দ্র মিত্র, মাতা প্রমোদিনী মিত্র। দেশভাগের পর সেই অশান্ত, উত্তাল পরিস্থিতিতে অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষের স্রোতে ভেসে এই দেশে এসে নতুন করে শিকড় গাঁথা শুরু হয়। বর্ধমান শহরের মিউনিসিপ্যাল গার্লস হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নতুন করে শুরু হয় স্কুল শিক্ষার পর্ব। রাজনীতি সচেতন পরিবারের কন্যা হওয়ার সুবাদে ঐ সদ্য কৈশোরেই, বাংলা বিহার সংযুক্তি প্রস্তাব প্রত্যাহার আন্দোলনের সময় ‘জেল ভরো’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া পরিবারের বড়দের সঙ্গে তিনিও বেশ কিছুদিন জেলে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে ঐ স্কুল থেকেই তিনি তৎকালীন তিন বছরের হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থায় নিয়মিত এন.সি.সি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে বর্ধমান উইমেনস কলেজে প্রবেশ করার পর, আরও সক্রিয় ভাবে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এই কলেজের পরিবর্তে ইটাচুনা কলেজ থেকে ১৯৬৫-তে তিনি বি.এ পাশ করেন। এই সময়েই পরিচয় হয় সেই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ সুরের সাথে। ১৯৬৫ সালে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ। বিবাহিত জীবনে দুই সন্তানের জননী, কন্যা বিপাশা এবং পুত্র ধৃতিমান। ১৯৭২ সালে তাঁর সম্পাদনায় এবং তাঁদের দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘ছোটদের কথা’ নামে একটি শিশুদের জন্য মাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়, যে ধারা আজ অর্ধশতাব্দী পরেও তাঁরা আন্তরিক ভাবে বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর সক্রিয় সহযোগিতা এবং উৎসাহে, তাঁর এবং শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ সুরের যৌথ উদ্যোগে, তাঁদের বর্ধমানের ময়ূরমহলের ভাড়া বাড়িতে তিনটি ছাত্র নিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুল হিসেবে আজকের শিশু নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। উল্লেখ্য যে ১৯৭২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সাধুমতী বালিকা বিদ্যালয়ে সাংগঠনিক শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন কিন্তু সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে ১৯৭২-এর ২০ ডিসেম্বর তাঁকে স্কুলে ঢুকতে না দিয়ে তাঁর হাতে ৩১ ডিসেম্বর থেকে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ এই মর্মে সম্পাদকের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি ঐ বিদ্যালয়ে স্থায়ী পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা রেক্টর হিসেবে, আজীবন শিশু নিকেতন বিদ্যালয়ের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর আত্মিক বন্ধন। ১৯৮০ সালে কর্মরত অবস্থাতেই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এড কলেজ থেকে বি.এড পাশ করেন। প্রায় ২৩ বছরের উপর ঐ বিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করে ২০০১ সালে তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি বরাবরই অত্যন্ত পরিশ্রমী, পরিবারের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন সমাজ সচেতক, পরিবেশ সচেতক, পরোপকারী, প্রকৃতিপ্রেমী এবং পশুপ্রেমী মানুষ। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল অফুরন্ত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভান্ডার। যদিও অবসর গ্রহণের পর থেকেই আর্থারাইটিসের সমস্যা তাঁর সচলতা এবং কর্মক্ষমতা অনেকখানি কেড়ে নেয়, তবে ২০১৮ সালে পুত্র ধৃতিমানের অকাল প্রয়াণের শোক তাঁকে মানসিক ভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত করে ফেলে। শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ সুরের নিরন্তর অক্লান্ত শুশ্রূষা এবং সাহচর্য সত্ত্বেও এই সন্তান শোকের শূন্যতা থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর, ভোর ৪-৪৪ মিনিটে, এই কর্মচঞ্চল, বর্ণময় জীবনের মঞ্চে শেষ পর্দাটি নেমে আসে। তবে তাঁর ক্ষেত্রে মৃত্যুই শেষ কথা নয়, মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমে তিনি মৃত্যুর পরেও নিজেকে সমর্পণ করে গেছেন সমাজের সেবার এক পবিত্র অঙ্গীকারে।