ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
অষ্টম শ্রেণি, বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল
‘ধর্ম অনুরাগে বাহ্য অনুষ্ঠানে নহে। হৃদয়ের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম। যদি দেহ মন শুদ্ধ না হয় তবে মন্দিরে গিয়া শিব পূজা করা বৃথা।’ এমন সহজ, সুন্দর, চিরায়ত ও হৃদয়স্পর্শী বাণী যিনি করতে পারেন তিনি হলেন নবজাগৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ ও ভারতপথিক স্বামী বিবেকানন্দ।
উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের, তখন অবশ্য তিনি মোটেও বিবেকানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন না। ছেলেবেলায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত, আর সবাই তাঁকে আদর করে ডাকত ‘বিলে’। বিলের ঠাকুরদা দূর্গাচরণ দত্ত একাধারে ছিলেন ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত আর অপরদিকে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। বিলের বাবা বিশ্বনাথ দত্তও ছিলেন জ্ঞানী, দয়ালু এবং ফারসি আর ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত। কলকাতা হাইকোর্টের দক্ষ আইনজীবী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। অপরদিকে তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন চিন্তাশীল, বুদ্ধমতী ও মনুষ্যপ্রেমী। এমন বাবা-মায়ের কোলে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি জন্ম হয় নরেন্দ্রনাথের।
যে কোন শিশুর জীবনে তার মায়ের প্রভাব অপরিসীম। বিলের জীবনেও তার অন্যথা হয়নি। মায়ের কোলে বসেই সে প্রথম ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালা শেখে। এমনকি সে মায়ের কোলে বসেই শোনে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি। রামায়ণ-এর কাহিনি তাকে এতই আকৃষ্ট করেছিল যে সে রাম-সীতার একটি ছোট মূর্তি কিনে পুজো করত। কখনও সে রামের বদলে শিবের পূজাও করত।
শিশুকাল থেকেই বিলে ধ্যান ধ্যান খেলতে ভালোবাসত। খেলার মাঝে সে এতটাই ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ত যে বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকত না। একবার সে এভাবেই ঘরের এককোণায় ধ্যানাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে বহুক্ষণ তার কোনো হুঁশ ছিল না।
শৈশবে বিলের দুরন্তপনার কোনো অন্ত ছিল না। দিদি-বোনদের জ্বালাতন করে মুখ ভ্যাঙানো, বাড়ির সকলের পোশাক দীন-দুঃখীদের দান করা ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। কখনও কখনও তাকে সামলানো কঠিন হলে তার মা রেগে গিয়ে বলতেন— ‘শিবের কাছে ছেলে চাইলুম। তা তিনি নিজে না এসে পাঠালেন তাঁর চেলা এক ভূতকে’।
শিশুকাল থেকেই নরেন ছিলেন মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন। ছয় বছর বয়সে নরেন এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু সেখানে কিছু বন্ধুর কুসঙ্গের জন্য সে অভব্য আচরণ শেখে, যা তার পরিবারের পছন্দ ছিল না। তাই বাড়িতেই শিক্ষকের দ্বারা তার শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী নরেন অচিরেই অন্যান্যদের থেকে বেশি করে পড়তে ও লিখতে শিখে যায়। সাত বছরে সংস্কৃত ব্যাকরণ বই ‘মুগ্ধবোধ’, রামায়ণ ও মহাভারতের অনেকখানি করে অংশ তার মুখস্ত হয়ে যায়।
সাত বছর বয়সে সে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়। সেখানেও তার শিক্ষকগণ তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা পরিচয় পেয়ে যান।
স্কুলে নরেন তার বন্ধুদের কাছে প্রিয় পাত্র ছিল। তার এক প্রিয় খেলা ছিল ‘রাজার বিচারসভা’। ক্লাসঘরের এক উঁচু ধাপ তার সিংহাসন ছিল। সেখানে সে বসে রাজার মতো রাজকার্য ও বিচার করত। কেউ তার কথার অমর্যাদা করলেই সে রাগাণ্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাত।
নরেনের অনন্য এক প্রতিভা ছিল। সে ক্লাসে পড়ার ফাঁকে তার বন্ধুদের রামায়ণ, মহাভারতের গল্প বলত। এমনি একদিন সে বন্ধুদের গল্প শোনাচ্ছে, শিক্ষক তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলত, আমরা কী নিয়ে পড়াশোনা করছি। আর কেউ না পারলেও নরেন বলে দেয় সেই উত্তর। কারণ তার এক অদ্ভুত প্রতিভা ছিল যার দ্বারা সে একাধিক বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারত।
নরেন ছিল সবার নয়ণের মণি। উঁচু-নীচু, ধনী-গরীব, অন্ধ-আতুর সকলের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল। সে এমন মজার সব কথা বলত যা শুনে গম্ভীর মানুষও না হেসে পারত না।
নরেন একঘেয়েমি পছন্দ করত না। সে তার বন্ধুদের সাথে একটি নাটকের দল গড়ে ফেলেছিল। মহড়া চলত তার বাড়ির ঠাকুর দালানে। কিছুদিন বাদে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে সে এক পড়শীর আখড়ায় যোগ দিয়ে তলোয়ার চালানো, লাঠিখেলা, নৌকাচালানো সহ বহু খেলা শেখে। সে যখন এসব নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন সে বাড়ির সকলকে ম্যাজিক লণ্ঠনের ছবি দেখাত।
ছোটো থেকেই নরেনের এক বিশেষ দিক পরিলক্ষিত হয়। তার নির্ভয়, সত্যবাদী ও কুসংস্কারহীন চরিত্র তাকে এক মহামানবে উন্নীত করে তোলে। শৈশবে দুষ্টু ছেলেটার কোনো অসৎ অভিসন্ধি ছিল না। সে কখনও কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত হতো না। বয়স বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে তার প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। সে নিয়মিত নানা প্রকার বই, পত্রিকা পড়ে।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তার বাবা রায়পুরে স্থানান্তরিত হন। সেখানে বিদ্যালয় না থাকায় পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। তবে সে তার বাবার কাছে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও দেশ, সমাজ, স্বাধীনতা প্রভৃতি সম্বন্ধে নানা জ্ঞানার্জন করে। ধীরে ধীরে তার বিচার-বুদ্ধি ও আত্মসম্মানবোধের উন্মেষ ঘটে। দুই বছর পর তারা পুনরায় কলকাতায় ফিরে এলে নরেন আবার স্কুলে ভর্তি হয়। তিন বছরের পড়া এক বছরের মধ্যে শেষ করে এবং কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
এরপরে তো সকলের আদরের নরেন হয়ে উঠলেন এক মহামানব। বিশ্বের দরবারে নিজ পরিচয়ে হয়ে উঠলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
শিশু নিকেতন, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫, বিবেকানন্দের জন্মদিনে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত।