ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
জয়পুর তো কী হয়েছে? রাহুলদের ফ্ল্যাটে যেন কাশ বনের জঙ্গল শরতের হাওয়ায় গোল খেতে লাগলো। খুশির এমনিই একটা বাতাস গেল বয়ে। সাত সকালে চা খেতে খেতেই নন্দিতার ঘোষণা, ‘তোদের ছোটমাসি মেসো আসছে। পুজোতে জয়পুর বেড়াতে।’
সমস্বরে দুই ভাই বোন রাহুল আর মানালি জিজ্ঞেস করলো, ‘আর জয় আর জুঁই?’
‘বনানী আর কৃষ্ণেন্দু কি ওদের ছেড়ে আসবে নাকি? চার জনেই আসছে। এ বছর এখানকার পুজো দেখবে।’
নীলমণি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বৌ ছেলে মেয়েদের কথা শুনছিল। মুখ তুলে বললো, ‘তাহলে তো আগের দিন গিয়ে বাইশ গোদামের বাঙালি বাজার থেকে মাছ টাছ এনে রাখতে হবে। কবে যেন পৌঁছবে?’
‘পঞ্চমীর দিন। অবশ্য আজকাল তো শুনি কোলকাতার ছেলে মেয়েরাই মাছ খায় না। কারো মাছে গন্ধ লাগে, কারো গলায় কাঁটা ফোটে। সব্বাই সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত শুধু বিরিয়ানি পেলে আর কিছু চায় না। কে জানে, জয় জুঁইও খায় কিনা?’
নীলমণির মা নয়নতারা দেবীর বয়স হয়েছে। গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতে তার অনেক সময় লাগে। নন্দিতাকে বললেন, ‘কুটুম বাড়ির লোক আসছে। একটু তো গোছগাছ করে রাখতে হবে। তার ওপর আবার রান্নাবান্না আছে। তোমার ওপর দিয়ে বাপু বেশ ধকল যাবে। এ ক’দিন ঘর দোর পরিষ্কার করতেই কি কম হ্যাপা পোয়ালে? তা আর কী করা যাবে? মায়ের পেটের বোন বলে কথা।’
তারপর ছেলেকে বললেন, ‘ওদের জন্য এখানকার পেঁয়াজ কচুরি এনে রাখিস। ওদিককার লোকেরা তো এ জিনিষ কখনও খায়নি।’
মানালি দাদার দিকে চেয়ে বললো, ‘আর মির্চি বড়া?’
নয়নতারা বলেন, ‘ওরা অত ঝাল কি খেতে পারবে? আজকাল আমারই ঝাল লাগে।’
‘সে সব দেখা যাবে। আসল সমস্যা হল এখানকার টিকটিকি।’ নন্দিতা বেশ চিন্তিত।
‘মানে?’ নীলমণি যেন একটু বিরক্ত হল, ‘আমরা কি টিকটিকি পুষে রেখেছি নাকি?’
‘সে যাই বলো তুমি। ছোটবেলা থেকেই টিকটিকিতে বনানীর ভীষণ ভয়।’
এরপর আর কি? ঘরে ঘরে শুরু হল সাফাই অভিযান। রান্নাঘরের ডিবে ডাবা সব ঝক ঝক করতে লাগলো, বাথরুমে নতুন লিকুইড সোপের শিশি, হ্যাঙ্গারে নতুন তোয়ালে, প্রতিটি বিছানার চাদর পাল্টে ফেলা হল। এছাড়া বনানীরা যে ঘরে শোবে সে ঘরে পাতার জন্য রাজস্থানী প্রিন্টের নরম চাদর বের করে রাখা হল। একেবারে সাজ সাজ রব।
শেষ পর্যন্ত চতুর্থীর মাঝরাত্রি পেরিয়ে ওদের ট্রেন এলো। হাওড়া যোধপুর এক্সপ্রেসের আর দোষ কি? ট্রেন টাইমিংই যখন মাঝরাত্রি নাগাদ, তখন ঘণ্টা খানেক দেরী হলে তাকে তো দোষ দেওয়া যায় না। ট্রেন বেচারীকে এতটা পথ আসতে হয়েছে। নীলমণিরই যা একটু ভোগান্তি হল। ঢুলতে ঢুলতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে মশার কামড় খেতে খেতে বসে থাকতে হল। রাহুল অবশ্য সঙ্গে যেতে চেয়েছিল কিন্তু নীলমণিই তাকে বারণ করে দেয়, ‘ওরাও তো চার জন আছে। বসবে কোথায়? তুই বরং বাড়িতেই থাক।’
বাসায় ঢুকতে ঢুকতেই রাত দুপুরে একেবারে হৈ হৈ পড়ে গেল, ‘ওমা, জয় তুই কত বড় হয়ে গেছিস!’
‘দুষ্টুমিতেও বেশ বড় হয়ে গেছে। একদিন বাড়িতে না বলেই বন্ধুদের সঙ্গে আলিপুর চিড়িয়াখানা বেড়াতে চলে গেছিল।’ যথারীতি মায়ের অনুযোগ।
কৃষ্ণেন্দু গম্ভীর ভাবে বলে উঠল, ‘এ্যাডমিশান টেস্ট দিতে গেছিল।’
‘তার মানে?’ নন্দিতা যেন একটু অবাকই হল।
‘কয়েক মাস থেকে জু-এর হনুমানের খাঁচাটা খালি ছিল। তা সেই সিটটা যদি জয় পেয়ে যায় তাহলে তো লেখাপড়ার ল্যাঠাই যায় চুকে।’
‘বাবা, তুমি না!’ জয় আর জুঁই একযোগে প্রতিবাদ জানায়। সব বাবাদের এই এক দোষ। লেগ পুল করা।
এর মধ্যেই নন্দিতা বোনকে জড়িয়ে ধরেছে, ‘ওহ, তোকে দেখে কে বলবে যে তোর ছেলে মেয়ে এত বড়টি হয়ে গেছে? সেই একই রকম রয়ে গেছিস।’
ইতিমধ্যে কমপ্লেক্সের পেছনের পাড়ার বাড়িটা থেকে তাদের গরুটা ডেকে উঠল, ‘হাম্বা!’
মসজিদের পাশের ছাদ থেকে মোরগ দুটো ডেকে উঠল, ‘কোঁকড় কোঁ! সুবহ হুই, অব জাগো!’
নীলমণি বলে উঠল, ‘তাহলে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক, কী বল?’
সকাল থেকে যথারীতি শুরু হয়ে গেল ‘পাধারো ম্হারে দেশ’-এর আয়োজন।
সকালে এক প্রস্থ চায়ের একটু পরেই জলখাবারের আয়োজন। পেঁয়াজ কচুরি, জিলিপি এবং— না, থাক আর বলবো না। তোমাদের জিভে জল আসবে। নীলমণি ছোট ভায়রাকে বললো, ‘আমাদের সিয়ারামের রসগোল্লাটা খেয়ে দেখো। ময়দার ফোড়ন নেই। তোমাদের ওখানকার বিখ্যাত সব দোকানের টক্করে। হাঃ হাঃ!’
দুপুরে খাওয়ার সময়ে নয়নতারা ‘ওকি এখনই হাত গুটিয়ে নিলে কেন? এটা খাও, সেটা খাও’ করতে লাগলেন। তারপর কৃষ্ণেন্দুকে বললেন, ‘তোমাদের ওখানকার মত মাছ এখানে পাওয়া যায় না ঠিকই, তবু নীলু অত দূর থেকে নিয়ে এলো, আরেক পিস মাছ নাও বাবা।’
খাওয়া দাওয়ার পর দুই ভায়রাভাই বিছানায় ঢুকল। ছেলে মেয়েদের, ‘ওরে তোরা একটু শুয়ে নে। ট্রেনের একটা ধকল তো গেছেই’ বলতে বলতে তাদের নাকে বিসমিল্লা খানের সানাই বাজতে লাগলো।
চার ভাই বোন মিলে একটা ঘরে এ ওর সাথে খুনসুটি করতে করতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
নয়নতারা একটা বই নিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঢুলতে লাগলেন।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুই বোনে মিলে ছেলেবেলার গল্প থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন এবং এর ওর খবর নিতে লাগলো। নন্দিতা বললো, ‘মনে আছে আমি যখন পড়তে বসতাম তখন তুই চুপি চুপি এসে আমার চুল চেয়ারের সাথে বেঁধে দিতিস?’
বনানী হাসতে হাসতে দিদিকে জড়িয়ে ধরল। তারপরেই সেই চিরন্তন প্রশ্ন, ‘হ্যাঁ রে দিদি, তোর ঐ মাথা ব্যাথাটার জন্য ডাক্তার দেখিয়েছিলি?’ আবার, ‘এখানে বাড়ির কাজের লোকজন ঠিক মত পাওয়া যায় তো?’ এই সব।
আসল নাটকটা জমে উঠল বিকেলের পর, সন্ধ্যে নাগাদ। যখন বিকেলের চায়ের আসর বেশ জমে উঠেছে। নীলমণি বলছিল, ‘কাল ষষ্ঠী। কাল বিকেলেই বেরিয়ে সার্বজনীনের ঠাকুর দেখে আসা যাবে। সপ্তমী অষ্টমীতেই দূরের ঠাকুরগুলো দেখে আসবো। নবমীতে তো আবার সব জায়গাতেই গরবা নাচের ভিড় জমে যায়।’
‘কী যে তারস্বরে বাজনা বাজায়, কানে তালা লেগে যায় একেবারে।’ নয়নতারা চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে বলে উঠলেন।
আর ঠিক তখনই নন্দিতার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল জানলার পাশের দেয়ালের দিকে, ‘ঐ দেখ, আবার এসেছে।’
সবার চোখ গেল সেই দিকেই।
মুহূর্তে বনানীর দুই চোখ যেন দুটো দই বড়ার মত বিশাল হয়ে উঠল।
‘চুপ করে বসে আছ কেন? ওটাকে ভাগাবার জন্য কিছু একটা কর।’ নন্দিতা পতিদেবকে বলে উঠল।
‘আরে বাবা, শান্তিতে একটু চা’টাও তো খেতে দেবে।’ নীলমণি যেন ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্বই দিল না। তারপরেই শালীর দিকে চেয়ে বললো, ‘ওরে ওটা জুরাসিক পার্কের কোন ডাইনোসর নয়। নেহাৎই একটা ভালমানুষ টিকটিকি। বলতে পারিস ষোলো আনা অহিংসক। ওটাকে ভয় পেলে বেচারী লজ্জা পাবে।’
‘অহিংসক? বটে। তুমি ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে ওটার পুজো করো গে। টিভির পেছনে, পর্দার আড়ালে, এমনকি রান্নাঘর পর্যন্ত নোংরা ছড়িয়ে রাখে।’ নন্দিতা গরগর করে উঠলো।
চার ভাই বোনে ড্রইং স্পেসের সোফার ওপর জমিয়ে বসে আড্ডা দিচিছল। রাহুল বলে উঠল, ‘তাছাড়া মা, বলতে গেলে টিকটিকি তো আমাদের সবার পূর্ব পুরুষ।’
‘তার মানে? এটা আবার ডারউইন সাহেবের নতুন থিওরী নাকি?’
‘তা না। ওরা সেই জুরাসিক যুগ না তারও আগে থেকে একই রকম ভাবে টিকে আছে।’
কৃষ্ণেন্দু মুচকি হেসে বললো, ‘ও বেচারীও তো তোমাদের গেস্ট। সেই যে বলে না— অতিথি দেবো ভবঃ! হয়ত তোমার হাতের চা খেতে এসেছে।’
‘থামো দিকি। আর ঠাট্টা কোরো না।’ নন্দিতা বেশ বিরক্ত হয়ে ওঠে।
সেই যে সিনেমায় মার্ডার সিনে অভিনেতা একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে, বনানীও সেরকমই চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমাদের চা খাওয়া শেষ হল? ওটাকে তাড়াতে পারছ না?’
‘হ্যাঁ বৌমা, আজ তুমি তোমার ঐ ওষুধটা স্প্রে করতে ভুলে গেছ নাকি?’ নয়নতারা মন্তব্য করলেন।
‘দুপুরেই তো স্প্রে করলাম, মা।’ নন্দিতা অসহায় ভঙ্গীতে বলে ওঠে।
নীলমণি নিতাই গৌরের মত দুই হাত তুলে বলল, ‘তোর দিদি টিকটিকি ভাগাবার জন্য একটা ওষুধ ডিসকভার করেছে। শুকনো লংকা, পেঁয়াজ, রসুন আর কী কী সব জলে ফুটিয়ে একটা সল্যুশান করে রেখেছে। তবে ঐ সল্যুশানের জন্য না হোক তোর দিদিকে দেখলেই টিকটিকিগুলো পালিয়ে যায়।’
ত্রিভঙ্গমুরারীর মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বনানীর জ্ঞান পিপাসা জেগে ওঠে, ‘ঐ সল্যুশানটা আমিও বানিয়ে রাখবো। তুই কি ইউ টিউব থেকে শিখেছিস?’
‘তাছাড়া আর কী? ইউ টিউবই তো আজকের যুগের সর্ব বিদ্যা বিশারদ গুরু বৃহস্পতি।’
‘আগে ওটাকে বিদেয় করো।’ বলতে বলতে নন্দিতা বারান্দা থেকে ফুলঝাড়ুটা এনে মেঝেতে রাখল, ‘নাও এটা তুলে নিয়ে ওদিক থেকে তাড়া দাও।’
‘হায় রে পোড়া কপাল! এক যুগে রথী মহারথীদের যুদ্ধে যাবার আগে রানীরা তাদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে হাতে তলোয়ার তুলে দিত। আর আজ? দিনকাল বড়ই খারাপ পড়েছে, ভায়া।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে চেয়ে নীলমণি বলে উঠল।
ওদিকে বনানী ততক্ষণে চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার একটা পা ডাইনিং টেবিলে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘আগে ওটাকে তাড়াও।’
অগত্যা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে নীলমণিকে উঠতে হল, ‘হে মা দুর্গা! কী যে করি? আমি কি স্পাইডার ম্যান নাকি যে দেয়াল বেয়ে বেয়ে ওটার পিছু নেবো?’
‘লেগে পড়ুন দাদা, দিদি তো অস্ত্র দিয়েই গেছে। তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল! সেই কবে সুকান্ত লিখে গেছে। মনে নেই?’ কৃষ্ণেন্দু ভাবলো এমন একটা দারুণ ঘটনা ঘটতে চলেছে, আমি তার ডিভিও বানাবো না? কাল সকালে হোয়াটস্ অ্যাপে গ্রুপে দিতে পারলে ব্যাপারটা জমে যাবে।
অগত্যা, নীলমণিকে ঝাঁটাটা হাতে তুলে নিতেই হল। গরু তাড়াবার ভঙ্গীতে দেয়ালের দিকে মুখ করে সে হ্যাট হ্যাট করে উঠল। আর তার ছোট ভায়রাভাইয়ের হাতে মোবাইল। ভিডিও হচ্ছে।
কিন্তু টিকটিকি তো আর গরু নয় যে লেজে মোচড় দিলেই তারা সোজা ঘরের পানে দৌড়বে। ইনি গৃহগোধিকা। একটু এঁকে বেঁকে ছুটে ইনি গিয়ে ঢুকলেন পর্দার আড়ালে।
চার ভাই বোনে উঠে দাঁড়ালো। তারা বিনে টিকিটের দর্শক। রাজস্থানের প্রসিদ্ধ দেবতা খাটু শ্যামের ভঙ্গীতে তারা চেয়ে রইল।
এইখানটাতে খাটু শ্যামের গল্পটা একটু বলে নিই।
খাটু শ্যামের বিখ্যাত মন্দির আছে সিকর জেলায়। মহাভারতের সাথে জুড়ে এটা হল রাজস্থানের উপকথা। মধ্যম পান্ডব ভীমের নাতি এবং ঘটোৎকচের ছেলে বর্বরিক ছিল মহাযোদ্ধা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় সে প্রতিজ্ঞা করে বসলো, ‘যে পক্ষ হারতে বসবে, আমি তাদের হয়েই যুদ্ধ করবো।’
এ কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন এ তো ভারী মুশকিল। কৌরবরা যে হারবে সে তো জানারই কথা। তবে কি বর্বরিক ওদের হয়ে নিজের ঠাকুরদার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে? তিনি শেষে একটু ছলনার আশ্রয় নিলেন। এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাকে গিয়ে বললেন, ‘বাপু হে, তুমি যে নিজেকে এত বড় বীর যোদ্ধা মনে করছ, তা এক বাণে ঐ অশ্বত্থ গাছের সমস্ত পাতাগুলো কেটে ঝড়ের মুখে উড়িয়ে দিতে পারবে? না পারলে কিন্তু তোমার মাথাটা কেটে আমাকে দিতে হবে।’
বেচারী বর্বরিক তাই করে দেখাল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ একটা পাতা নিজের পায়ের তলে চেপে রাখলেন। এবং শেষে সেটাই দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি তো সব কটি পাতা উড়িয়ে দিতে পারনি। তাই শর্ত মতো তোমার মাথাটা আমাকে দাও।’
বর্বরিক হাত জোড় করে বললেন, ‘যেহেতু আপনি আমার মাথা চাইছেন তাই আপনি ব্রাহ্মণ হতে পারেন না। আপনি কে?’
শ্রীকৃষ্ণের পরিচয় পেয়ে সে বলল, ‘তাহলে আমাকে বর দিন যাতে আমার মাথাটা অন্তত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা দেখতে পারে।’
শ্রীকৃষ্ণের বরে তাই হল। তার কাটা মুণ্ডুটা রাজস্থানের সিকরে বসে বসে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দেখল। তাই এখানকার লোকেরা তাকে বলে ‘হারে কা সাহারা’। যে পরাজিতের পক্ষে থাকে।
যাক গে।
ইতিমধ্যে কম্যান্ডার জেনারেল নন্দিতা হাঁক পাড়ল, ‘কি জবুথবুর মত দাঁড়িয়ে আছ? কিছু একটা কর। বনানী টিকটিকিকে কতখানি ভয় পায়, জানো? ছোট বেলায় টিকটিকি দেখলে ঠাকুমার পালঙের তলে গিয়ে লুকতো।’
‘কেন তোমাদের ওখানকার টিকটিকি বুঝি খাটের তলে ঢুকতে পারে না? গন্ডারের মত বিশাল নাকি?’ নীলমণি একটা বাক্য বাণ ছাড়লেন।
‘অ নীলু, কিছু একটা কর বাছা। হাজার হোক ওরা আমাদের গেস্ট।’ মা এবার সন্তানকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেন।
অতঃপর নীলমণিকে সম্মুখ সমরে এগোতেই হল।
ওদিকে টিকটিকিটা পর্দার আড়ালে বসে বসে বোধহয় ভাবছিল যে একবার সুযোগ পেলেই আমি বাউন্ড্রীতে যাওয়া বলের মত সাঁ সাঁ করে এক ছুটে পালাবো। কিন্তু বেচারীর দুর্ভাগ্য, তা আর হল না। নীলমণি এগিয়ে এসে প্রথমেই পর্দাটা নেড়ে দিল। সে তখন কী করে? ছুটে পালাতে গিয়ে মারলো এক ঝাঁপ।
অমনি যেন ঘরের মধ্যে তুলকালাম হয়ে গেল।
বনানী ডাইনিং টেবিল থেকে নেমে এসে দেখছিল কী ঘটতে চলেছে। এমন সময় সেই সরীসৃপ এসে পড়ল তার শাড়ির গায়ে।
মুহূর্তে এক আর্ত চিৎকারে ফ্ল্যাটের ব্যালকনির কাঁচগুলো পর্যন্ত ঝন ঝন করে উঠল। বনানী যেন হঠাৎ কোনো রক্তাক্ত লাশ দেখতে পেয়েছে। ‘ও মা! ও দিদি রে! আমি মরে যাবো!’
আর সে ঘরের মধ্যে এমন লাফাতে শুরু করলো যে দেখে মনে হয় শাড়ি পরে নটরাজ তান্ডব নেত্য করছেন।
মানালি চিৎকার করে উঠল, ‘মাসি, কী কচ্ছ? তোমার পায়ের তলে চাপা পড়লে টিকটিকিটা যে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে।’
জয়ও সাবধান করে দিল, ‘মা, থামো। এত ভয় পাবার কী আছে? যত্ত সব।’
কৃষ্ণেন্দু একটু আক্ষেপের সুরে বলে উঠল, ‘আরে কী মুশকিল! হাত বাড়িয়ে ব্যাটাকে ক্যাচ করলেই তো পারতে। পাঁজিতে লেখা আছে— হাতে টিকটিকি পড়লেই হাতে হাতে টাকা।’
টিকটিকিটা কিন্তু বেশ সেয়ানা। সে আবার দেয়ালে উঠে পড়ল।
নন্দিতা স্প্রে করতে করতে তাঁর পেছনে এমন ছুট লাগালো যেন ওটা স্প্রে বটল নয়, একটা এ কে ফিফটি সেভেন মেশিনগান। ‘ওটাকে দরজার দিকে ভাগাও।’
নিলু ঝ্যাঁটা হাতে তার পেছনে দৌড় লাগালো।
নন্দিতা একটু বিরক্ত হয়েই কৃষ্ণেন্দুকে আহ্বান জানালো, ‘ঐ মোবাইলটা রেখে একটু দরজাটা খুলে দাও না।’
‘খুল যা, সিমসিম!’ বলতে বলতে কৃষ্ণেন্দু ফ্ল্যাটের দরজা দিল খুলে।
কিন্তু টিকটিকি ততক্ষণে এবাউট টার্ন করেছে। সে এখন ছুটছে কিচেনর দিকে।
ইতিমধ্যে দৌড়তে গিয়ে সোফায় হোঁচট খেয়ে নীলমণি পপাত ধরণীতল। সে মেঝে থেকেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরে বাবারে! আরে আগে আমায় একটু তোল। কে জানে আবার কোমরের এক্সরে করাতে হবে কিনা!’
নয়নতারা অস্থির হয়ে উঠলেন, ‘অ রাহুল, ওরে তোর বাবাকে একটু সোফায় বসিয়ে দে।’
নন্দিতা ভাবনায় পড়ে গেল, ‘তরকারি টরকারি গুলো সব ঢাকা আছে তো?’
‘সে কী দিদি, তুই যে মাছ, পায়েস সব রান্না করেছিস, তা ঢেকে রাখিসনি? তোর কী কান্ড বাবা!’ বনানী বেশ বিরক্তই হল, ‘যদি কোন বাসনে পড়ে যায়?’
নন্দিতা রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল, ‘না রে, সব ঢাকাই আছে। আমিই কেমন যেন একটু ভেবড়ে গেছিলাম।’
এর পর টেস্ট ম্যাচের মত একটা টি ব্রেক। সবাই একটু চুপ করে বসে রইল। যে যার চিন্তায় মগ্ন। বনানী মাঝে মধ্যেই দেয়ালের দিকে তাকাচেছ। যাক বাবা, টিকটিকিটাকে কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না।
সন্ধ্যে লাগতে নন্দিতা ঘরে ঘরে প্রদীপ দেখিয়ে ঠাকুরের সামনে শাঁখ বাজিয়ে এলো। সকলে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল।
নন্দিতা বললো, ‘এবার তাহলে আমি রাতের রুটিগুলো করে নিই গে।’
‘চ, তাহলে আমি রুটিগুলো বেলে দিই।’ বলতে বলতে বনানী দিদির পিছু পিছু কিচেনে গিয়ে ঢুকল।
পর ক্ষণেই যাত্রা দলের সৈনিকের মত বীর দর্পে দুই বোনের কিচেনে ‘প্রবেশ’।
‘তুই ঐ ডিবেটা থেকে আটা বের করে দে। আমি বরং মেখে দিই।’ নন্দিতা আঙুল তুলে আটার ডিবেটা বোনকে দেখিয়ে দিল।
কিন্তু সেই ডিবেটা খুলতে গিয়ে আরেকটা বিপর্যয় গেল ঘটে। সেই বদমাইশটা এতক্ষণ বসে ছিল ঐ ডিবের আড়ালে। যেই বনানী ওটা তুলতে গেল অমনি তিনি লাফ দিয়ে ডিবের ওপর চড়ে বসলেন। এই বুঝি আবার ঝাঁপ মারে বনানীর গায়ে। আতঙ্কে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঐ দেখ, দিদি। ওটা ওখানে—’
আর তার হাত ফস্কে ডিবেটা পড়ল মাটিতে। ব্যস, ডিবের ঢাকনা খুলে রান্নাঘর হয়ে উঠল আটাময়। দুই বোনে যেন আটা দিয়ে ফাগ খেলেছে। তাদের মুখে চোখে সারা শরীরে আটার ছয়লাপ। তার মধ্যে থেকে চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। অবস্থা দেখে নীলু, কৃষ্ণেন্দু আর চার ছেলে মেয়ে সবাই হা হা করে হেসে উঠল।
এইবার নন্দিতার টিকটিকিটার ওপর সত্যিই ভয়ঙ্কর রাগ হল। সে বলে উঠল, ‘আমি আর রুটি করতে পারবো না। তোমরা যা হয় কিছু একটা এনে খাও গে।’
সব্বাই হায় হায় করে উঠল, ‘আরে আমাদের কী দোষ? টিকটিকির রাগ আমাদের ওপর কেন?’
নয়নতারা বলে উঠলেন, ‘আর আমি? আমি কী করবো? জানোই তো বাপু, আমি ঐ বাজারের শক্ত রুটি খেতে পারিনে।’
নীলমণি বললো, ‘রামের বৌ চুরি করলো রাবণ আর লেজ পুড়ল বেচারী চির কুমার হনুমানের।’
মুখ ঝামটা দিয়ে বললো নন্দিতা, ‘লেজ থাকলে তা পুড়বেই তো।’
এমন সময় টিকটিকিটা রান্নাঘর থেকে টিক টিক করে ডেকে উঠল। বোধহয় বললে, ‘বচ্ছরকার দিনে গেস্টকে ডিনার না খাইয়ে বিদেয় করতে নেই গো।’