ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি॥
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি॥
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি॥
১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মত্যাগী সংগ্রামে শহিদ রফিক, বরকত, জব্বর, শফিউর, সালামদের আত্মত্যাগ বিগত ৫ দশক ধরে মনের গভীরে স্পর্শ করে যেতো। মাতৃভাষার দুনির্বার আকর্ষণে মনের মণিকোঠায় আসন করে নিয়েছিল এই ভাষা শহিদেরা। এই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে যখন বাংলাভাষা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষায় পরিণত হল সেদিন থেকেই মনের গভীরে বাসনা জাগে স্বাধীন বাংলাদেশে ২১শে ফেব্রুয়ারীর শহিদ দিবসে অমর শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবার।
এরপর ১৯৯৯ এর ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর অধিবেশনে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের শহিদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ এখন থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে। সরকারী, বেসরকারী সর্বস্তরে দেশে দেশে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। মাতৃভাষার উন্নয়নে কর্মসূচী নেবে। যেমন ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীর আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত শ্রমিকদের স্মরণে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে পালিত হয় মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে। ইউনেস্কোর ঘোষণা মতে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব আঙিনায়। এই অভিষেকে বাঙালী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। এই সময়ই ২১শে ফেব্রুয়ারীর ঐতিহাসিক এবং এখন আন্তর্জাতিক দিবসে বাংলাদেশের মানুষের মহামিলনে নিজেকে সামিল করার প্রবল বাসনা জাগে। অবশেষে ২০০১-এ সেই সুযোগ এবং সৌভাগ্য হয়।
১৯শে ফেব্রুয়ারী বিকেলে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বিমান যখন ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করে তখন আমি এবং সম্পাদিকা কল্পনা সুর মনে মনে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করি। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের এক অদ্ভুত অনুভূতি।
যোগাযোগ হয় বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কারক নাট্য সম্প্রদায়ের কর্ণধার এবং কেন্দ্রীয় খেলাঘর শিশু সংস্থার সভাপতি শংকর সাওজালের সঙ্গে। শংকরের স্কুলজীবন কেটেছে বর্ধমান শহরে। পরিচয় দিতেই দাদা বৌদি হিসেবে অতি সহজেই আপন করে নিল আমাদের। কর্মজীবনে বিরাট বিজ্ঞাপনী সংস্থার উচ্চপদে আসীন। শিল্প সংস্কৃতির জগতে বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। পথে শিশু কিশোররা অটোগ্রাফের খাতা বের করে সামনে দাঁড়ায়। স্ত্রী, এক কন্যা ও এক পুত্রের সংসার। কিন্তু বাইরে অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং স্নেহধন্য তরুণ-তরুণী। অসম্ভব কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আক্ষরিক অর্থেই ছোট ভাইয়ের মতো শংকর আমাদের সঙ্গ দিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারী অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ করে দিয়েছিল। ২১শে সকাল ৯টা নাগাদ শংকর আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিয়ে গেল কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের উদ্দেশ্যে। ২০শে রাত ১২টার সময় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী নেত্রী এবং ভিআইপিগণ শহিদ বেদীতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের পর শুরু হয় বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধার্ঘের পালা। লক্ষ লক্ষ মানুষ পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে শহিদ বেদীর দিকে ফুলে ফুলে শ্রদ্ধা জানায় অমর শহিদদের উদ্দেশ্যে। কণ্ঠে তাদের সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।’ বুকে কালো ব্যাজ। মেয়েদের পরনে অ আ ক খ বর্ণমালা খচিত শাড়ি। শিশু-কিশোর, স্কুল-কলেজের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবি সব একাকার। মাতৃভাষার জন্য গভীর দরদ এবং গর্ববোধ, কিছুটা বা অহংকার সকলের চোখে মুখে। প্রায় ঘণ্টা দুইয়েক লাইনে দাঁড়িয়ে তাও শংকরের চেষ্টায় লাইনের অনেকটা এগিয়ে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের ভাইবোনদের সঙ্গে মিশে প্রায় ১টা নাগাদ মূল শহিদ বেদীর পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ঘোষণা হল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে এসেছেন ছোটদের কথা’র সম্পাদক দম্পতি ধীরেন্দ্রনাথ সুর এবং কল্পনা সুর। এখন শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ দিচ্ছেন ধীরেন্দ্রনাথ সুর ও কল্পনা সুর। এই মুহূর্তের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম। শহিদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করে নিজেদের ধন্য মনে হতে লাগল। মনে হল ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ কানে বাজতে লাগল কবির বাণী— ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। ও আমার সোনার বাংলা...।’
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বর, সালাম। বাংলাভাষা এবং বাঙালীর জাতিসত্তার সঙ্গে হাজার হাজার বছর তোমরা অমর হয়ে থাকবে। শুধু বাংলা এবং বাঙালীর মধ্যেই নয় আগামী বিশ্বে দেশে দেশে সমস্ত মাতৃভাষা প্রেমীরা স্মরণ করবে মাতৃভাষার জন্য তোমাদের মহান আত্মত্যাগ।
ছোটদের কথা, বর্ষ-২৯, সংখ্যা-৪, মার্চ ২০০১ থেকে পুনর্মুদ্রিত