ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
কিশোর সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ কবি, দীর্ঘ ৬৬ বছর ধরে প্রকাশিত কিশোর-তরুণদের মাসিক সংবাদ-সাহিত্য পত্রিকা ‘অভিনব-অগ্রণী’র বর্ষীয়ান প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দিলীপ কুমার বাগের জীবনাবসান হল। সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে গত ২৮শে জানুয়ারি দ্বিপ্রহরে উত্তরপাড়ার এক বেসরকারি নার্সিংহোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐ দিন সকালে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। মৃত্যুকাল বিপত্নীক দিলীপবাবু রেখে গেলেন তাঁর চার কন্যা, তিন জামাতাকে, এক দৌহিত্র, দুই দৌহিত্রী সহ অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীকে।
‘অভিনব-অগ্রণী’ ও ‘সত্যলোক’ আয়োজিত দীর্ঘদিনের মাসিক যৌথ-সাহিত্য-সভার তিনি ছিলেন অন্যতম আহ্বায়ক। তাঁর মৃত্যুতে সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান শহর শ্রীরামপুরে শোকের ছায়া নেমে আসে। দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টি দিতে দিলীপবাবু তাঁর মহামূল্যবান চক্ষু দুটি মৃত্যুকালে শ্রীরামপুর চক্ষু ব্যাংকে দিয়ে গেলেন। ঐ দিন বিকাল চারটে নাগাদ তাঁর মরদেহ শ্রীরামপুরে ৪৬/আই, বড়বাগানে তাঁর বাসভবনে আনা হলে সেখানে ‘অভিনব-অগ্রণী’ ও ‘সত্যলোক’ যৌথ সাহিত্য সভা, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মাল্যার্পণ করে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান হয়। এরপর চাতরা কালিবাবুর শ্মশানঘাটে তাঁর নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে যায়। তাঁর এই চিরতরে চলে যাওয়ায় বঙ্গ সংস্কৃতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল।
প্রয়াত দিলীপ বাবুর শেষ স্থায়ী ঠিকানা শ্রীরামপুর হলেও তাঁর জন্ম হাওড়ায়, ৫৩, গোপাল ব্যানার্জী লেনে ১৯৪১ সালের ২৮শে জুন। তাঁর পিতামাতার নাম যথাক্রমে সন্তোষ কুমার বাগ ও শ্রীমতী স্বর্ণলতা বাগ। হাওড়ার বিবেকান্দ ইন্সটিটিউশন, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে সাধারণ শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ভারত সরকারের কারিগরী বিভাগ থেকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। এরপর কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট-এ নকশাকারক পদে চাকরিতে নিয়োজিত হন। জীবনের শেষ দিকটায় দিলীপবাবু শারীরিক দিক থেকে বেশ কিছুটা অক্ষম হওয়ায় অনেকটাই গৃহবন্দী জীবনযাপন করছিলেন। এমনকী তাঁর সাধের পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও অন্যের ওপর বেশ কিছুটা নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বিদ্যালয় জীবন থেকেই দিলীপবাবু নিজেকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চায় ব্রতী করেছিলেন। হাওড়া-হুগলির জনমানসে সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যসেবী ও শিশু-কিশোরদের সংগঠনের সংগঠক হিসাবে দিলীপবাবুর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যের বিচিত্র অঙ্গনে তাঁর যেমন ছিল যথেচ্ছ বিচরণ, তেমনই আবার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেও ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের সক্রিয় যোগাযোগ। ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার অগণিত পাঠকপাঠিকার কাছে তাঁর সময়োপযোগী বার্তাবহ লেখা ‘আজকের লিমেরিক’ বেশ সমাদৃত হয়। আবার লেখার সাথে অঙ্কনেও তাঁর যেমন ছিল পারদর্শিতা, তেমনই জনপ্রিয়তা।
নিজের লেখার চেয়ে অন্যকে লিখতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেই তিনি বেশি খুশি হতেন। শিশুসাহিত্যকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘নিখিল ভারত শিশু সাহিত্য সম্মেলন’-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রাজ্য কমিটির কর্ম পরিষদ সদস্য ও হুগলি জেলার নেতৃস্থানীয় অগ্রণী সংগঠক, সব পেয়েছির আসরের সাংস্কৃতিক কর্মশালার স্থায়ী আমন্ত্রিত প্রশিক্ষক, ক্যালকাটা জার্নালিস্ট ক্লাবের সদস্য, দশদিগন্ত ছড়া আকাডেমির সভাপতি ইত্যাদি অসংখ্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ একসময় অলংকৃত করেছেন তিনি।
তাঁর লেখা পুস্তকাদির সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। প্রকাশিত পুস্তকের মধ্যে ‘মিষ্টি ছড়া’, ‘মিঠে কড়া নানান ছড়া’, ‘ভোরের অপেক্ষায়’, ‘আজকের লিমেরিক’, ‘বুবুনের রাজ্য’, ‘ভাষার কাহিনী’, ‘বুবুন বড় হলো’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কবি নিমাই মান্না ও স্বপন কুমার ঘোষের সাথে তাঁর প্রকাশিত যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘বৃত্তের বাইরে তিনজন’ ও অশোক রঞ্জন চক্রবর্তীর সাথে যৌথ নাটিকা ‘হত্যাকারী ও মি: সাধুবাবা’ও বেশ জনপ্রিয় হয়। তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘ছোটদের ছড়ার মেলা’, ‘বাংলা শিশু কিশোর সাহিত্য’, ‘হাওড়া জেলা লিটল ম্যাগাজিন ডিরেক্টরি’, ‘ঘুরে এলাম ১ ও ২’ এবং ‘৩২ গল্প সংকলন’ উল্লেখযোগ্য।
দিলীপবাবু তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী সাহিত্য সাধনার জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি পুরস্কারের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ না করলেই নয়। শ্রেষ্ঠ সম্পাদনার জন্য ‘তেপান্তর’ ও ‘গৌরী ঘটক স্মৃতি পুরস্কার’ ও শিশু সাহিত্যে আজীবন অবদানের জন্য ‘স্বপনবুড়ো স্মৃতি পুরস্কার’, ‘হরেন ঘটক স্মৃতি পুরস্কার’, ‘সত্যজিৎ রায় নিরুপম সম্মান’, ‘বকুল বীথি’ ও ‘অশোক পাঠ স্মৃতি পুরস্কার’ আর জীবনের একেবারে অন্তিম পর্বে ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার জন্য তাঁর আজীবন প্রয়াসকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ছোটদের কথা শারদ সম্মান’ ইত্যাদি।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তাঁর সম্মান-গৌরবের মুকুটে এই স্বর্ণপদক তাঁকে বেশ আনন্দ দেয়। ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে সম্মাননা জ্ঞাপন করে বর্ধমান থেকে প্রকাশিত ছোটদের জনপ্রিয় সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘ছোটদের কথা’। শ্রীরামপুর ‘অভিনব-অগ্রণী’র সম্পাদকীয় কার্যালয়ে (৪৬/আই, বড়বাগান লেন, শ্রীরামপুর) এক অনাড়ম্বর মহতী অনুষ্ঠানে ‘ছোটদের কথা’র পক্ষে দিলীপবাবুর হাতে এই স্মারক-সম্মান, উত্তরীয়, উপহার সামগ্রী ও মিষ্টান্ন তুলে দিয়েছিলেন পত্রিকার প্রাণপুরুষ শ্রী ধীরেন সুর ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা বিশিষ্ট শিক্ষিকা তথা পত্রিকার বর্তমান সম্পাদিকা শ্রীমতী বিপাশা চট্টোপাধ্যায়। উল্লেখ্য, দিলীপবাবুর অসুস্থতার জন্য ২০২৪ সালের এই শারদ-সম্মান তাঁর হাতে এতদিন তাঁদের পক্ষে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঐ দিন বর্ধমান থেকে দিলীপবাবুর শ্রীরামপুরের বাসভবনে এসে দিলীপবাবুর হাতে সেই সম্মান তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা। সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে দিলীপ বাবু আবেগবিহ্বল কণ্ঠে বলেছিলেন, শিশুকিশোর সাহিত্যে তাঁর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁর এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কে জানতো, এর মাত্র কয়েকদিন পরেই এভাবে তাঁকে চলে যেতে হবে।
সর্বোপরি, দিলীপ কুমার বাগ ছিলেন স্মরণীয় বিগত প্রায় অর্ধশতবর্ষের জনপ্রিয় বাঙালি কিশোর সাহিত্যিক ও সংগঠকদের অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব। আজকের লিমেরিক নিয়ে তাঁর নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁকে কিশোর সাহিত্যে এক অনন্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মানুষ হিসাবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। স্থানীয় সহযোগী পত্রিকা ‘সত্যলোক’ ও তাঁর সম্পাদিত ‘অভিনব অগ্রণী’র মাসিক যৌথ-সাহিত্য-সভায় এই নিরহংকার, মানবদরদী মানুষটিই থাকতেন মূল আকর্ষণ হয়ে। সুস্থ ও সুন্দর এক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঙিনায় আজীবন তাঁর আপোষহীন লড়াই চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাঙলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যে জনপ্রিয় এই কবি সংগঠক দিলীপ কুমার বাগের নাম ও তাঁর জীবন-কৃতি কিশোর সাহিত্যানুরাগী সকলের মনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।