ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন, ‘মানুষ হইতে হবে’— এই তার পণ’’, স্কুলে আমাদের এই কবিতা পড়ানো হয়েছে। মুখস্থ করে আবৃত্তি করেছি। মাস্টারমশাইরা পিঠ চাপড়ে বলেছেন, ভালো ছেলে হবার চেষ্টা কর। ওঁদের আশীর্বাদে ভালো ছেলে হবার আনন্দে মনটা ভরে যেত! পরীক্ষার সময় কয়েকদিন রাত জেগে পড়াশোনা করতাম, পাছে অন্যরা টের পায়! ভালোভাবে পাশ করতেই হবে। কয়েকজন মুসলিম বন্ধু ছিল। একসাথে ঠাকুর দেখা, মহরম, সরস্বতী পুজো করার সমস্যা ছিল না। আবৃত্তি, প্রার্থনা সঙ্গীত সবই ছিল একসাথে। সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই যেমন অন্য কোনও শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে ক্লাস নিতেন, মৌলবি স্যারও ঠিক তেমনি ক্লাস নিতেন। আমরা ওরা এরকম ভাবনাচিন্তার কোনো অবকাশ ছিল না।
‘আদর্শ ছেলে’ শিরোনামাঙ্কিত কালোত্তীর্ণ কবিতাটি কুসুমকুমারী দাশের লেখা এবং এই কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুকুল’ শিশু-সাহিত্য পত্রিকায় ১৩০২ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে (ডিসেম্বর- জানুয়ারি ১৮৯৫-১৮৯৬)। জেনেছিলাম তাঁর জন্ম : ৬ই জানুয়ারি ১৮৭৫; মৃত্যু : ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলায় বাখরগঞ্জ জেলার বরিশাল শহরে বিদ্যানুরাগী পরিবারে। পিতা চন্দ্রনাথ দাশ এবং মা ধনমণি। বরিশালের গৈলা গ্রামের খাজাঞ্চি বাড়ির দুই ছেলে কালীমোহন ও চন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজে সেটা ছিল ‘অপরাধ’, ফলে গ্রামে থাকা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। দুই ভাই সপরিবারে বরিশাল শহরে চলে আসেন। চন্দ্রনাথ সরকারি দপ্তরের চাকরিতে যোগ দেন। কুসুমকুমারী তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। দুই ভাইই ছিলেন বিপত্নীক। কালীমোহন ভাইয়ের মাতৃহারা সন্তানদের মাতৃস্নেহে প্রতিপালন করেছিলেন।
কালীমোহন বরিশালের ব্রাহ্মসমাজ সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। কালীমোহনের সেবাব্রত ও প্রেমপরায়ণ হৃদয়াবেগের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী কুসুমকুমারী। তিনি স্বভাব কবিত্বের গুণ পেয়েছিলেন পিতা চন্দ্রনাথের কাছ থেকে। চন্দ্রনাথ ছিলেন স্বভাব কবি। হাসির কবিতা লিখে কুন্তলীন পুরস্কার জিতেছিলেন। হাসির গান, ক্ষেপার গান নামে দুটি গীতি সংকলন ও সাময়িক চিত্র নামে তাঁর একটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়।
বরিশাল শহরে সেই সময়ে স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ সুযোগ না থাকায় শিক্ষার জন্য চন্দ্রনাথ কন্যাদের কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। কুসুমকুমারী কলকাতায় বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পেয়েছিলেন। দশম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় তাঁর বিবাহ হয়, সেজন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। স্বামী সত্যানন্দ সুশিক্ষিত উদার মনের মানুষ ছিলেন। কুসুমকুমারীর প্রতিভা ও আত্মিক বিকাশে সবসময় পাশে থেকেছেন। স্ত্রীকে লেখালেখির জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। বিবাহের পাঁচ বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান ‘মিলু’র জন্ম হয়।
মিলু তাঁর মায়ের কাছ থেকে সাহিত্য পাঠ ও আলোচনায় উৎসাহ পেতেন। দেশবিদেশের কবি সাহিত্যিকদের কী ভালো, সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁদের কী অবদান— এসব কুসুমকুমারী ছেলেদের কাছে গল্প করতেন। নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র, দেবেন্দ্রচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবিদের কাব্যগ্রন্থ থেকে সুন্দর সুন্দর অংশ আবৃত্তি করে শোনাতেন। মার কণ্ঠে এসব আবৃত্তি শুনতে মিলুর খুব ভালো লাগতো। মায়ের কবিতা লেখার সহজাত ক্ষমতা দেখে ছোট্ট মিলু অবাক হয়ে যেত। সংসারের কাজকর্মে মা খুব ব্যস্ত। হঠাৎ ‘ব্রহ্মাবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক এসে বলেছেন এক্ষুনি একটা কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। কুসুমকুমারী খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি কবিতা লিখে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
দুপুর বেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর একটু অবসর, কুসুমকুমারী কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পাঠ করছেন, পাড়ার অনেকে এসে বসেছেন মাদুর পেতে, সেই পাঠ শোনার জন্য। এই পাঠচক্রে, ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার পাঠ শুনে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক কথা জানতে পারত বাড়ির ছেলেমেয়েরাও। মিলু-র এক মামাতো ভাই পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে বহুবার কারাবরণ করেছেন। অনুশীলন দলে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁর বরিশালে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছিল।
মিলুর বয়স যখন দু’বছর, গুরুতর লিভারের অসুখে আক্রান্ত হয়েছিল। চিকিৎসক হাওয়া-বদল করতে বলেছিলেন। কুসুমকুমারীর বয়স তখন মাত্র ২৫-২৬ বছর। স্বামী চন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কিছুদিন লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, দিল্লী বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়ে মিলুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে ফিরেছিলেন। ব্যাপারটা পরিবারের অভিভাবকরা মোটেও ভালো চোখে দেখেননি। মিলুর বোন বড় হয়ে লিখেছেন, ‘‘পুরনো চিঠিপত্র থেকে জানতে পারি মা’র এই প্রচেষ্টাকে পরিবার-পরিজন সকলেই আত্মঘাতী বলে মনে করেছিলেন। তবুও বিচলিত হননি মা।’’
মিলু বড় বয়সে লিখেছেন, ‘‘ভয় পেতাম, কোন পড়শীর বাড়ি থেকে ডাক আসতে পারে, কারও মারাত্মক রোগ হয়েছে, হয়তো কোন দুঃস্থ পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের আশ্রয় থেকে, হয়তো কোন নিম্নশ্রেণীর লোকের মৃত্যু হয়েছে, হয়তো কোন অনাথ স্ত্রীলোক বিশেষ কারণে বিপণ্ণ, হয়তো কোন প্রতিবেশীর ঘরে ছেলেপিলে হবে, ...মার কাছে খবর এসে পৌঁছলেই তিনি চলে যাবেন— সারা রাত বাড়িতেই ফিরবেন না হয়তো আর, জেগে বা ঘুমিয়ে একাই পড়ে থাকতে হবে আমাদের।’’
এমনই ছিলেন কুসুমকুমারী। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে ইতিহাসে লেখা হয়েছে। দুর্গাপুজোর সেই সময়ে বেদনার্ত হৃদয়ে কুসুমকুমারী লিখেছিলেন : ‘‘জগৎ-জননী আজ আসিছেন ঘরে, কোথা বাড়ি কোথা ঘর পথে ও প্রান্তরে, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন জন আজি পাতিয়াছে তার ধুলার আসন—’’
তাঁর বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন ‘মুকুল’ পত্রিকায়। জগদীশ চন্দ্র বসু ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই উচ্চাঙ্গের বাংলা শিশু পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়। প্রথমদিকে সম্পাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তিনি এই পত্রিকায় সেকালের শ্রেষ্ঠ লেখক-কবিদের রচনার সন্নিবেশ ঘটাতেন। বোঝা যায় তৎকালীন বাংলার সারস্বতসমাজে কবি হিসেবে কুসুমকুমারীর স্থান কতটা উঁচুতে ছিল। তাঁর কবিতা রচনার ক্ষমতা যতটা ছিল, কবিতা প্রকাশ করার আগ্রহ ছিল কম। তিনি যদি লেখার জন্য আরও সময় দিতেন অনেকে লিখতে পারতেন। তবুও যা লিখেছেন তাও আমরা জানতে পারতাম না, যদি না বরিশালের ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তী নিরন্তর তাগিদ দিতেন। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকাতেই তাঁর কবিতা বেশি প্রকাশিত হয়েছে, এছাড়া ‘প্রবাসী’ ও ‘মুকুল’ পত্রিকায়। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় (বৈশাখ, ১৩২৬) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় মিলুর প্রথম মুoিত কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’।
আশ্চর্য! কবিতাটির শেষে, কবির নামের জায়গায় লেখা হয়েছিল শুধু ‘শ্রী’। পরে পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় মুদ্রিত বার্ষিক সূচিপত্রে ঘোষিত হয় ‘শ্রী জীবনানন্দ দাস বিএ’ নামটি।
ঘরে শিশু সন্তান রেখে রাত্রিবেলা প্রতিবেশীর সমস্যা-সংকটে গিয়ে দাঁড়াবার মতো মহিলা আজ পাওয়া যাবে কিনা আমাদের ভাবতে হয়। ব্রাহ্ম সমাজের আচার্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত কুসুমকুমারী ঈশ্বরের আরাধনা নয়, ছেলেদের বলেছিলেন, ‘মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন’। আমরা সত্যিই কি মানুষ হতে পেরেছি! সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই! আর মিলু তথা জীবনানন্দ ১২৫ পূর্ণ করলেন। তাঁকেও প্রণাম জানাই।
জীবনানন্দ দাশ— প্রভাতকুমার দাস। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী। ১৯৯৯ উত্তরসূরি, পৌষ-ফাল্গুন, ১৩৬১। ‘কুসুমকুমারী দাসের কবিতা’, সুমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত, ভারবি।