ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
সপ্তম শ্রেণি, বর্ধমান বিদ্যার্থী ভবন গার্লস হাই স্কুল
উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের দত্ত পরিবারে জন্ম হয় স্বামী বিবেকানন্দের। তখন অবশ্য তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন না। বাড়ির সেই ছোট্ট ছেলেটির নাম রাখা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভালোবেসে সবাই তাকে ডাকত ‘বিলে’। বিলের দাদু দুর্গাচরণ দত্ত ফারসি এবং সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন এবং তার সাথে ছিল তুখোড় আইনজ্ঞ। কিন্তু মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তার ছেলে বিশ্বনাথ দত্তের জন্ম হলে, তিনি সংসার ত্যাগ করেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বিশ্বনাথ দত্ত ফারসি এবং ইংরেজি ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর ফারসি কবি হাফিজের গল্প পড়তে খুবই ভালো লাগত। তাঁকে সবাই সম্মান করতেন। তিনি ছিলেন কলকাতার হাইকোর্টের একজন দক্ষ আইনজীবি। এছাড়াও তিনি একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন। তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সমান ভাবে দান বা সাহায্য করতেন।
বিলের মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন তাঁর বাবার সুযোগ্য স্ত্রী। তিনি প্রখর বুদ্ধিমতী ছিলেন। সবাই তাঁকে সম্মান করে চলত এবং সব বিষয়ে তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিত। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুব ভালো। রামায়ণ এবং মহাভারতের অনেক অংশ তার মুখস্ত ছিল। তিনিও বিলের বাবার মত গরিব দুঃখীদের সাহায্য করতেন। এরকম মা-বাবার কোলে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম হয় বিলের।
সব বাচ্চার জীবনে তার মায়ের প্রভাব সবথেকে বেশি। স্বামী বিবেকানন্দও অনেক পরে জানিয়েছিলেন যে কীভাবে তার মা তাকে প্রথম ইংরেজি শব্দগুলো শিখিয়েছিল। মায়ের কাছেই তিনি প্রথম বাংলা শব্দ লিখতে শেখেন।
তিনি বলেছিলেন যে কীভাবে মা তাকে তাঁর কোলে বসিয়ে প্রথম রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প বলেছিল। রামায়ণের গল্প তার এত ভালো লেগেছিল যে সে রাম-সীতা একটা ছোটো মাটির মূর্তি কিনে তাকে ফুল দিয়ে পুজো করত। মাঝে মাঝে তিনি শিবেরও পুজো করতেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন রামভক্ত। পাড়ায় যদি কোথাও রামায়ণ পাঠের আসর বসত সেখানে বিলের দেখা মিলতই।
ছোট্ট বিলের ধ্যান ধ্যান খেলতে ভালো লাগত। মাঝে মাঝে সে ধ্যান করতে গিয়ে এত মগ্ন হয়ে যেত সে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তার কোনো হুঁশ থাকত না। একদিন সে ধ্যান করতে গিয়ে এতটাই ধ্যানমগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে কারোর কথায় সে উত্তর দিচ্ছিল না, তারপর দরজা ভেঙে তাকে ঠেলা দিয়ে তাঁর হুঁশ ফেরানো হয়।
ভবঘুরে সাধুদের প্রতি তার খুব আগ্রহ ছিল। বাড়ির দরজার সামনে যদি কোনো সাধু এসে দাঁড়াত তাহলে বাড়ি থেকে যা খুশি তাই দিয়ে দিত। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাঁর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হত। যখনই সে চোখ বুজত তখন তাঁর ভ্রু দুটির মাঝে একটি ঝলমলে বিন্দু দেখা দিত যা রঙ পালটিয়েই যেত। আর তার কিছুক্ষণ পরে সে বড়ো আকার ধারণ করে ছোট্ট বিলেকে সাদা আলোয় ধুইয়ে দিত এবং এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ছোট্ট বিলে ঘুমিয়ে পড়ত। সে ভাবত যে এমনটি বুঝি, সবার সাথেই হয়। কিন্তু সে জানত না যে এটি তার ভবিষ্যতের বিশালত্বের নির্দেশ দিত। তাই বলে এই নয় যে বিলে একটি গম্ভীর প্রকৃতির ছোট ছেলে ছিল। সে ছিল একটি দুষ্টু ছেলে। মাঝে মাঝে তাকে সামলানো এত কঠিন হয়ে যেত যে তার পিছনে দুটি দাসী বহাল করতেই হত। মাঝে মাঝে রেগে তার মা তাকে বলতেন যে— ‘আমি শিবের মতো একটি ছেলে চাইলাম, কিন্তু শিব নিজে না এসে, একটা ভূতকে পাঠিয়ে দিলেন।’
ছোট্ট বিলে দিদি-বোনদের বিরক্ত করতে গেলে যখন দিদিরা তাকে তাড়া দিত তখন সে খোলা নর্দমায় নেমে দিদিদের মুখ ভ্যাঙ্গাত, কারণ সে জানত যে দিদিরা নর্দমায় নামবে না। ছয় বছর বয়সে যখন বিলেকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হল তখন নানারকম বন্ধুবান্ধবদের সাথে থেকে বিলে কিছু অভব্য শব্দ বলতে শিখল, যা তার বাবা মায়ের মোটেও পছন্দ হয় না। তাই তাকে সেই বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে বাড়িতে শিক্ষক রাখা হল। তারপর বিলে পড়াশোনায় মন দিল। যখন সবাই বর্ণ শেখে তখন বিলে লিখতে আর পড়তেও শিখে গেছে। মাত্র সাত বছর বয়সে তার সংস্কৃত ব্যাকরণ বইয়ের ‘মুগ্ধবোধ’ এবং রামায়ণ ও মহাভারতের অনেকটা করে অংশ মুখস্ত ছিল।
সাত বছর বয়সে বিলেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গঠিত মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিছু দিনের মধ্যে স্কুলের মাস্টারমশাইয়েরা তার বুদ্ধি টের পেল। কিন্তু অনেকদিন বাদে তার বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায় যে বেশিরভাগ সময় তাকে ডেস্কেই দেখা যেত না।
স্কুলে বন্ধুদের কাছে বিলে একজন প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে। সবাই তাকে তাদের নেতা বলে মেনে নেয়। তাদের প্রিয় খেলা ছিল ‘রাজার বিচার সভা’। সবার মধ্যে রাজা ক্লাসের সবচেয়ে উঁচু স্থানে বসে এবং সেটা রাজার সিংহাসন। বিলেই সেখানে বসত। সেখানে কারুর ওঠার অনুমতি ছিল না। বিলে সেখানে বসে তার মন্ত্রী, সেনাপতি ঠিক করত। আর কেউ যদি রাজার কথা না শুনত তখন সে কটমট করে তার দিকে তাকাত। টিফিনের সময়ে তাড়াতাড়ি টিফিন শেষ করে নরেন অর্থাৎ আমাদের বিলে ছুটত মাঠে। সেখানে প্রত্যেকদিন সে বিভিন্ন ধরণের খেলা খেলত। এবং মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে নতুন খেলাও বানাত। তার আরও একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল। মাঝে মাঝেই সে পড়ানোর সময় বন্ধুদের সাথে গল্প করত। একদিন গল্প করতে করতে হঠাৎ মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘‘আমি কী পড়াচ্ছিলাম বলত?’’ তখন সবাই চুপ করে বসে ছিল কিন্তু বিলে উত্তর দিয়ে দিতে পারল। তাকে যতগুলোই প্রশ্ন করা হচ্ছিল সবকিছুর উত্তর সে ঠিক ঠিকই দিচ্ছিল। এটাই হল তার এক অদ্ভুত শক্তি। সে এক সাথে একাধিক কাজ করতে পারত।
বিলের একঘেয়েমি মোটেও পছন্দ ছিল না, তাই সে উঠোনে একটা আখড়া খুলেছিল। যেখানে তার বন্ধুরা নিয়মিত শরীরচর্চা করত। সেটা অনেকদিনই চলল যতদিন না তার ভাইয়ের হাত ভেঙে গেল। তারপর সে পড়শীর বাড়িতে আখড়ায় গিয়ে সেখানে তলোয়ার চালানো, নৌকা চালানো শিখল। এবং খেলাধূলায় সে একবার প্রথম হয়েছিল। এরপর নরেন যত বড় হল তত তার স্বভাব পাল্টাতে লাগল। প্রত্যেকদিন সে রাতে ধ্যান করত। এছাড়াও খবরের কাগজ পড়ত। এবং বিভিন্ন আলোচনা সভায়ও যেত। যখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত তখন সে তার বাবার সাথে রায়পুরে গেছিল। সেখানে কোনো স্কুল ছিল না। তাই সে অনেকদিন তার বাবার সাথে থাকতে পেরেছিলেন। তার বাবা তখন তাকে বলেছিলেন পড়াশোনা করা শুধু অন্যের জ্ঞান মুখস্ত করা নয়। পড়াশোনা করা মানে হল মন খুলে উদার হতে হবে। আশেপাশে যা ঘটছে সব দেখতে হবে। তাই তখন তার বাবা তাকে আলোচনা সভায় নিয়ে যেতেন। নরেন্দ্রনাথের তর্ক-বিতর্ক করার ক্ষমতা দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত। তার বাবা ও বন্ধুরা মিলে যে আলোচনা করত তা সে বসে শুনত। আর মাঝে মাঝে সেই আলোচনায় যোগও দিত। তখন সে চাইত যে সবাই যেন তার কথাগুলো শোনে এবং কেউ যদি তার কথা না শুনত সে রেগে যেত এবং সামনাসামনি সেটা প্রকাশও করত। এর জন্য তার বাবা মাঝে মাঝে খুব রেগেও যেতেন। কিন্তু তার পরে তিনি গর্ববোধ করতেন যে তার ছেলের আত্মসম্মান বোধ আছে। এরপর যখন তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন তখন নরেনের স্কুলে ভর্তি হতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা নরেনকে এত ভালোবাসতেন যে তাকে আবার তাদের স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। এরপর নরেন তিন বছরের পড়া এক বছরে শেষ করলেন এবং তারপর কলেজে উঠে গেলেন। এবং তারপর নরেন্দ্রনাথ অনেক বড়ো ব্যক্তি হয়ে গেলেন এবং পরিচিত হলেন স্বামী বিবেকানন্দ নামে। তারপর তিনি অনেক মহৎ কাজ করলেন। এই হলো ছোট্ট দুষ্টু ছেলের কথা যার নাম বিলে এবং স্কুলের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর গল্প এখানেই শেষ হল।
শিশু নিকেতন, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫, বিবেকানন্দের জন্মদিনে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত।