ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
কয়েক দিন ধরে ভীষণ দোটানায় পড়েছেন নচিকেতা। কী করবেন? কী করা উচিৎ? হ্যাঁ না করতে করতেও অবশ্য কথাটা একরকম ফাইনাল হয়েই গেল। তা বলে নচিকেতা এটা মোটেও ভাবেনি যে আজ অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই ওরা এসে হাজির হয়ে যাবে।
নাইট ডিউটি সেরে এসে সে এখনও পর্যন্ত চা টুকুও খায়নি। ব্যাস, মুখ হাত ধুয়ে এসে একটু গা এলিয়ে দিয়েছে মাত্র।
রেলওয়ের এত বড় ইঞ্জিনিয়ার সে। কত দায় দায়িত্ব! অমুক স্টেশনের কাছে রেল লাইনে গন্ডগোল দেখা গেছে, লোক জন নিয়ে রেলের ট্রলি চেপে ছোটে সেখানে। পিছু পিছু ট্রলি ম্যানরা ঐ গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে দৌড়তে থাকে। কাজ হয়ে গেলে মঙ্গল, নয়তো সেখানকার স্টেশনেই খাও, শোও, রাত কাটাও। তাছাড়া আছে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ। কোন ইঞ্জিনে কি সমস্যা তা দেখো, তার চিকিৎসা করে তাকে আবার কাজে পাঠাও। কোন এ্যাক্সিডেন্ট হলে বা সন্ত্রাসবাদীদের কান্ড কারখানা হলে তো আর কথাই নেই। নাওয়া খাওয়া সব ঘুচে যায়।
চা খেয়েই একবার স্নানটা সেরে ফেলবে ভাবতে ভাবতে শার্টটা খুলছিল এমন সময় সুকন্যা এসে জানালো, ‘ওনারা এসে গেছেন।’
‘এ সময়ে আবার কারা হাজির হল?’ নচিকেতা একটু বিরক্তই হয়। কিছু খেয়ে একটু ঘুমোতে পারলে তার প্রাণ বাঁচে!’
‘ঐ যারা গাড়ি কিনবে, তারাই। কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘আচ্ছা, বলে দাও আমি এখনই আসছি।’ নচিকেতা আবার জামাটা পড়তে থাকে। মনের মধ্যে আষাঢ়ে মেঘ— যা করছি, ঠিক করছি কি? কিন্তু কী উপায়? শেষ পর্যন্ত লালীকে বিক্রি করে দেবো? যেদিন প্রথম কারটা দরজায় এসে দাঁড়ালো, বাড়িতে যেন খুশির জোয়ার বয়ে গেল। কত স্বপ্ন, সবার কত আকাঙ্ক্ষা! নচিকেতাকে অফিস থেকে একটু লোনও নিতে হয়েছিল। বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটা তো সাইকেল চেপেই কেটে গেল। এবার আমার ছেলে গাড়ি কিনেছে। এতে চেপেই যাওয়া আসা হবে।’
তারপর এক শীতের ছুটিতে সব্বাইকে নিয়ে ওরা জয়পুরের আমেরের কাছে জলমহলে গেল। দূর দেশ থেকে আসা শীতালী পাখিদের দেখতে। বাবা মা, তাদের মেয়ে টুনি— সবার মুখেই সেদিন খুশির ঝর্ণা। গাড়িতে আসতে আসতে ঠাকুমা ছোট্ট টুনিকে খেপাচ্ছিলেন, ‘এই গাড়িটা আমার বাবার।’
‘না, এটা আমার বাবা এনেছে।’ ছোট্ট মুঠিটা তুলে টুনি প্রতিবাদ করছিল। তাই নিয়ে কত হাসি আর হো হো! ইতিমধ্যে টুনি সেই লাল রঙের গাড়িটার একটা নামও দিয়ে ফেলেছিল— ‘লালী’।
তারপর তো দশ দশটা বছর কেটে গেছে। তার মাঝে এ কার অনেকের বিপদে আপদে কী কম কাজে এসেছে?
সেই একবার শীতের রাত্রে হঠাৎ ফোনে রিং হতে লাগল। ক্লান্ত নচিকেতার তখন আর ইচ্ছে করছিল না যে ফোনটা রিসিভ করে। কিন্তু তিনি আর থামবার নন। ক্রমাগত আহ্বান জানাতেই থাকেন। শেষে সুকন্যাই বলল, ‘দেখো না কী ব্যাপার! কোন জরুরী দরকারও তো হতে পারে।’
‘হ্যালো—!’
ওপার থেকে রুইদাসের গলা, ‘দাদা, ভারী বিপদে পড়ে এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করছি।’
ওরা জয়পুরে নতুন এসেছে। বিশেষ কারোকে চেনে না। নচিকেতা শুধালো, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’
‘বাবার বুকে ভীষণ ব্যথা। দু-তিন বার বমিও করলেন। হস্পিটালাইজ করতে হবে। কিন্তু অন লাইন ক্যাবগুলো সব একসেপ্ট করেও ক্যানসেল করে দিচ্ছে।’
‘ঘাবড়াস না। আসছি।’ রুইদাসের বাড়ি শহর থেকে প্রায় তিরিশ কিমি দূরে। সিকর রোডে। তাই এই সমস্যা।
তারপর তো এই লালীতেই সওয়ার হয়ে সবাই মিলে এ হাসপাতাল, সে হাসপাতালে ছুটতে লাগলো। প্রথম দুটোতে তো এডমিট করতেই চাইল না। রাতে তেমন কোন ডাক্তার সেখানে নেই। শেষে তৃতীয়টাতে তাঁকে ভর্তি করা হল।
ভোরের আলো যখন গোলাপি শহরের গায়ে গোলাপি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন সে বাড়ি ফিরল। দরজা খুলতেই সুকন্যা জিজ্ঞেস করল, ‘কাকাবাবু কেমন আছেন?’
‘আর চিন্তার কিছু নেই। সময় থাকতে তোমাদের লালী তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পেরেছে।’
নচিকেতা সেই লোক দুজনকে নিয়ে এসে বৈঠকখানায় বসালো, ‘একটু চা করতে বলি?’
টুনি রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ওরা কে মা?’
‘ওরা লালীকে কিনে নিয়ে যাবে।’
‘বাবা লালীকে বিক্রি করে দেবে?’ টুনি যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
সুকন্যার বুকের মাঝে যেন কিসের ব্যথা টন টন করতে থাকে। মনে হচ্ছে এই তো ক’দিন আগে এই লাল রঙের গাড়িটা তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। শাশুড়ি তাকে ডেকে বললেন, ‘অ বৌমা, ঠাকুর ঘরের প্রদীপটা জ্বালিয়ে নতুন গাড়ির গায়ে একটু চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে, ধান দুব্বা দাও। শাঁখ বাজাও। কাল বুধবার, কালকেই মোতি ডুংরির গণেশ মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসতে হবে।’
তারপর তো এই লালীতে চেপে এ পাড়ার কত মেয়ের বরেরা এলো। বিয়ের পর ডা. আনন্দ আর ঊষা দেবীর মেয়ে জামাই তো এতে চেপেই জংশন অব্দি গেল।
শুধু নচিকেতা কেন, বাড়ি শুদ্ধ সবারই প্রাণ এই লালী। গাড়ির গায়ে আঁচড়টি লাগলে নচিকেতার বুকে তা শেলের মত লাগত। সমস্ত ভিড় এড়িয়ে কত সাবধানেই না সে এই গাড়ি চালাত। আজও লালীর রং ঝকঝক করছে। পেছন থেকে কেউ প্যাঁ পোঁ করলে, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সে হাত জোড় করে বলত, ‘ভাই সাহেব, আপহী আগে যাইয়ে। সড়ক আপকী হ্যায়।’
সুকন্যা চুপচাপ। সব কিছুর দর্শক মাত্র। সে কোনদিন তার স্বামীর কাছে গাড়ির আবদারও করেনি, আজ বিক্রি করতেও বলেনি।
নচিকেতা খানিক মেকানিকদের কথাতেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। ‘আরে সাব, এবার তো এতে কিছু না কিছু লেগেই থাকবে। আজ ক্লাচ প্লেট, তো কাল সাস্পেন্সান খারাপ হবে। এর পর তো আর দামও পাবেন না।’
আবার কেউ মন্তব্য করে, ‘বুড়ির দাঁত বাঁধিয়ে দিলেই তো আর সে নতুন বৌটি হয়ে যায় না।’
এই সাত পাঁচ শুনতে শুনতেই সে ঠিক করে ফেলল, ‘নাহ, এবার এটিকে বিক্রিই করে ফেলা যাক।’
মানুষ লক্ষ যোজন দূরের চাঁদ দেখতে পারে, কিন্তু সে নিজের হৃদয়টাকে কি ভালো করে দেখতে বুঝতে পারে? সে উপলব্ধিটুকু করতে পারেনি যে এ গাড়ি তার কতখানি আদরের ধন। হয়ত তার মনে এ অভিমানটুকুও ছিল যে কই, বাড়ির কেউ তো আমায় এ গাড়ি বিক্রি করতে বারণ করলো না। যেন কারোর কিছুই এসে যায় না।
সুকন্যা তো চিরকাল চুপ করেই ছিল। সংসারের সব ব্যাপারেই।
নচিকেতা গাড়ির চাবি নিতে আর চায়ের জন্য বলতে ভেতরে এসেছিল। টুনি ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে উঠল, ‘বাবা, তুমি কি লালীকে বিক্রি করে দেবে?’
নচিকেতা কোন উত্তর দিতে পারলো না। কোন বাচ্চার হাত থেকে যদি কেউ তার প্রিয় খেলনাটা কেড়ে নেয় তাহলে তার মুখে চোখে যে অসহায় ভাবটা ফুটে ওঠে সেই ছবিই যেন তার চোখে মুখে।
কথা বার্তার পর্ব চুকে গেল। টাকা পয়সা গোনাগুনি শেষ। শুধু ট্রান্সফার কাগজে দস্তখৎ করা বাকি। ‘রেজিস্ট্রেশান পেপারটা ড্রয়ার থেকে নিয়ে আসি।’ বলে নচিকেতা উঠে দাঁড়াল।
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘একটু চাবিটা দিন। চালিয়ে দেখি।’
ড্রাইভিং সিটে বসে সে স্টার্ট দিল। কার ফার্স্ট গিয়ারে দাঁড় করানো ছিল। এক ঝটকা দিয়ে এগিয়ে গেল।
‘আরে ও কী করছিস?’ সঙ্গের লোকেরা চেঁচিয়ে উঠল।
নচিকেতা থমকে দাঁড়িয়েছে। মুখ ফিরাতেই দেখতে পেলো ড্রইং রুমের দরজার কাছ থেকে দুটি চোখ এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেখানে টলটল করছে এক ব্যথার দীঘি।
মুহূর্তে কী যে ঘটে গেল। নচিকেতা ছুটে বাইরে এসে লালীকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক যেমনটি চাষি বাড়ি ফিরে তার বলদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তেমনি করেই সে সেই লাল রঙের গাড়িটার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে, ‘কী রে লালী, আমাদের ছেড়ে যেতে তোরও কষ্ট হচ্ছে, না? এদের সঙ্গে কি যাবি?’
তার মনে হল সমস্ত গাড়িটা যেন নড়ে উঠল, ‘না, না।’ লালীর হেড লাইট দুটো যেন চিক চিক করে উঠল।
বাচ্চারা নিজের হারানো খেলনা ফিরে পেলে যেমন সবার আগে ডেকে নিজের মাকে বলে, ‘মা, আমি পেয়ে গেছি!’ তেমনি করেই নচিকেতা মেয়েকে ডেকে উঠল, ‘টুনি, মামণি! লালী কোথাও যাবে না। আমাদের সঙ্গেই থাকবে। কেউ একে বিক্রি করতে পারবো না।’