ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
চৈত্রমাসের খাঁ খাঁ করা দুপুর। বাড়ির সকলে কাজকর্ম শেষে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। সারা সকাল খেলা করেও ক্লান্ত নয় বিলে। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ মা বন্ধ করে রেখেছেন ছেলেকে রাস্তার ধারের ঘরখানিতে। সবাই বিশ্রাম নিলেও বিলের দুরন্তপনার শেষ নেই। এমন সময় ঘরখানির নিচে রাস্তায় এক ভিখারীর গলা শোনা গেল। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত ভিখারীর কাতর স্বর জাগ্রত করতে পারলো না বাড়ির সদস্যদের। ছোট্ট বিলে কিন্তু সব দেখছিল রাস্তার ধারের বড় জানলাটির পাশে দাঁড়িয়ে। অতটুকু ছেলের অন্তর ভিজে উঠল। কিন্তু বেরোবার উপায় নেই। মা যে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। কতই বা বয়েস তখন বিলের পাঁচ-ছয় বৎসর এর অধিক নয়। ঘরের মধ্যে দেবার মতো কিছু না পেয়ে বিলে অর্থাৎ নরেনের চোখ পড়ল ঘরের একমাত্র আলনাটিতে। আলনায় সুসজ্জিত মায়ের কয়েকটি শাড়ী। সেখান থেকেই মূল্যবান একটি গরদের শাড়ী বিলে জানলা দিয়ে গলিয়ে দিল দীনদুঃখী ভিখারীর হাতে। সবার অজান্তে মূল্যবান বস্ত্র পেয়ে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে চলে যান ভিখারীটি।
এত বড় হৃদয় যে ছোট্ট ছেলেটির তার আরেক নাম নরেন্দ্রনাথ। ছোট থেকেই বাড়িতে আসা সাধুসন্ন্যাসী ও জগৎজননী স্থির করে রেখেছেন যে এই ছোট ছেলেটির দ্বারাই একদিন বিশ্বজয় সম্ভব হবে। তাই না তার সাথে প্রথম দেখা হয় গুরু শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের। সালটা তখন ১৮৮৯ সালে। গুরুর কাছে তিনি শিখেছিলেন শিব জ্ঞানে জীবসেবার পথ। অস্থির চঞ্চল বালক নরেন্দ্রনাথকে বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার প্রথম সোপান ঠাকুর রামকৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরেই। অল্পবয়সে পিতৃহারা নরেন শ্রীরামকৃষ্ণের পরম আদরের ধন। তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েই তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর তাঁরই পরিচালনায় বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মঠ গড়ে ওঠে ও তিনি হয়ে ওঠেন স্বামী বিবেকানন্দ। আমেরিকার চিকাগো শহরে ১৮৯৩ সালে যে সর্বধর্ম মহাসম্মেলন হয় তাতে এক নবীন বাঙালী যুবা সন্ন্যাসী তার তেজদৃপ্ত ভাষণের দ্বারাই জগৎসভায় ভারতবর্ষের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন। এই বাঙালী যুবকই বীরসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ যিনি প্রথম সম্ভাষণে আমেরিকাবাসীর মন জয় করেছিলেন— ‘‘আমেরিকাবাসী আমার ভগিনী ও ভ্রাতৃমণ্ডলী’’ বলে।
গুরুর কাছে তিনি পাঠ পেয়েছিলেন বৈরাগ্যের। তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে জানালেন— ‘‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’’ আরও বললেন— ‘‘ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই... বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।’’
পরিব্রাজক বিবেকানন্দ সদা ধ্বনিত করে গেছেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতা এবং তাঁর নরনারায়ণ সেবার বীজটি পোঁতা হয়ে গিয়েছিল শৈশবেই।