ছোটোদের কথা
ছোটোদের কথা
আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে চতুর্দিকে। অনেক দূর আকাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মস্ত চাঁদখানা। একটু পরেই জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়বে, ঠান্ডা আলোয় মাখামাখি হয়ে যাবে সবকিছু। নদী, পাহাড়, বনজঙ্গল সব, স-ব ধুয়ে যাবে সেই আলোর বন্যায়। ছেলেটা অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আর মনে মনে ভাঁজিয়ে নিচ্ছে তার পরিকল্পনা। যেমন সাহস তেমনই জেদ ছেলেটার। কাউকে কিছু না বলে একা-একাই চলে এসেছে নদীর ধারে। কেউ কোথাও নেই। চুপিচুপি নৌকায় উঠে বসে সে অপেক্ষা করছে কখন সেই সুযোগটা আসবে।
কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কে রে তুই?’
সে বলবে, ‘আমি মাঝির ছেলে।’
‘কী নাম তোর?’
‘ডমরু। ডমরু ধর।’
‘তার মানে তোর বাবা নৌকা চালায়, তাইতো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমিও তো নৌকা চালাতে জানি। আমাদের টিয়ামুখী নদীতে কতবার পারাপার করেছি!’
তা, সত্যি কথাই বটে! বছর বারোর ছেলেটার কোনও কিছুকে ভয় নেই। বর্ষাকালের অমন যে টইটম্বুর নদী, ডমরু একা-একাই লগি ঠেলতে ঠেলতে নৌকা নিয়ে চলে যাবে ওপারে। ফিরেও আসবে ঠিক। বাবা কতবার বারণ করেছে, ‘আমি সঙ্গে না থাকলে যাস না, স্রোতের স্বভাব রিত্র বোঝা ভারী কঠিন, একটু বেসামাল হলেই আর রক্ষে নেই।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে? নৌকা তো আছেই, তাছাড়াও ভরা নদীতে সাঁতার কাটতেও সে ওস্তাদ। ঘাটে দাঁড়িয়ে মা হাঁক পাড়ে, ‘যাস না ডমরু, অত দূর জলে যাস না।’ ছেলের কোনও হুঁশই নেই। বাবা ধমক দেয়, মা সর্বক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, এই বুঝি কোনও বিপদ-আপদ ডেকে আনল। তা, ভয় পাওয়ারই কথা। ছেলে আবার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এমন সব খেলায় মেতে ওঠে যে মায়ের বুক দুরুদুরু। কেউ সাজে রাজা, কেউ সাজে ইংরেজ। প্রকাশ্য সভা ডেকে সেই রাজার বিচার করা হয়, কারণ রাজা নাকি সকলের শত্রু। আবার দেশের শত্রু বলে ইংরেজকেও দেওয়া হয় শাস্তি। ছেলেদের খেলার এমন ধরন দেখে মা-বাবা তো ভয় পাবেই। কে জানে, কোথায় লুকিয়ে আছে রাজার চর!
কী সাহস ডমরুর! আজ মনে মনে সে শপথ করেছে, যদি সত্যিই ইংরেজদের পুলিশবাহিনী এই ঘাটে এসে হাজির হয় তাহলে কিছুতেই তাদেরকে নৌকায় ওঠার সুযোগ দেবে না। হ্যাঁ, সেই চেষ্টা তাকে করতেই হবে। সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। ঘৃণার আগুন। প্রতিশোধের আগুন।
অনেকদিন ধরেই ডমরু শুনে আসছে, দেশের রাজারা হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। কেন শত্রু? তার কারণ, ওই রাজাদের অত্যাচারের শেষ নেই। প্রজারা গরিব মানুষ। চাষবাস করে, পরের জমিতে খেটে কিংবা মাছ ধরে দিন কাটে তাদের। ভাল করে খেতে পরতে পায় না, অনেককেই ভীষণ দুঃখকষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অথচ রাজাদের সেদিকে নজর নেই। নিজেদের আমোদ-আহ্লাদ নিয়েই তারা ব্যস্ত। আর সবসময় জুলুম করে প্রজাদের ওপরে।
ঠিক সময়ে খাজনা দিতে হবে। আরও বেশি বেশি খাজনা দিতে হবে। চাষবাস হয়নি তো কী, খাজনা চাই-ই চাই। কোনও বকেয়া চলবে না। রাজার লোকজন আছে, পাইক আছে, পেয়াদা আছে। এতটুকু বেচাল হলেই তারা ছুটে আসবে। কোনও ওজোর-আপত্তি শুনবে না, বেঁধে নিয়ে যাবে রাজার কাছে। নিষ্ঠুরভাবে মারধর করবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে দেবে।
এমনটাই চলছে অনেকদিন ধরে।
কিন্তু গরিব মানুষগুলো আর কত অত্যাচার সহ্য করে? আর কতদিন এভাবে মার খেতে হবে? শেষমেশ তারা ঠিক করল, এবার প্রতিবাদ করা দরকার। রুখে দাঁড়ানো দরকার। সকলে মিলে একজোট হয়ে মোকাবিলা করতে হবে এই অত্যাচারের।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে তারা সভা করল, মজবুত সংগঠন গড়ে তুলল। চাষিদেরকে বোঝাতে লাগল, এত অত্যাচার সহ্য করে এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। আমাদের নালিশ শোনার জন্যে কে আছে? রাজা? দূর, রাজাই তো আমাদের শত্রু, রাজার জন্যেই তো আজ আমাদের এই অবস্থা। দেশটা শাসন করছে ইংরেজ সরকার, তারা মদত দিচ্ছে রাজাদেরকে। কাজে-কাজেই রাজারা তো নিজেদের আখের গুছোতে ব্যস্ত হবেই। তাহলে! তাহলে এখন রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে সকলকে তৈরি হতে হবে।
তাদের গ্রাম আনন্দপুর। ভারী শান্ত আর নিরিবিলি গ্রামখানা। একপাশে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘন সবুজ বন, অন্যদিকে কুলকুলু বয়ে চলেছে টিয়ামুখী নদী। বর্ষায় থই-থই জল দেখলে মনে হয় যেন আস্ত একটা সমুদ্র। চাষের সময় ভরা ফসলের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। সেই আনন্দপুরের বুকেই এমন কান্ড!
গ্রামের লোকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘আমরা রাজাকে এক পয়সাও খাজনা দেবো না, দেখাই যাক, আরও কত অত্যাচার করতে পারে আমাদের রাজা।’
কেউ খাজনা দেবে না। কেউ রাজার হুকুম তামিল করবে না। পেয়াদা এসে ভয় দেখালেও কেউ গ্রাহ্য করবে না। ওদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে। সুযোগ পেলে বরং ঝাঁপিয়ে পড়বে পাল্টা মারার জন্যে। মার খাবে। মারবেও।
এমন অরাজকতা দেখে রাজা বুঝল ভারী বিপদ যাহোক। ইংরেজদেরকে তোষামোদ আর প্রজাদেরকে পীড়ন— দিনগুলো তো বেশ কাটছিল সুখে-স্বাচ্ছন্দে। এখন যদি প্রজারা বিদ্রোহ করে তাহলে শেষমেশ রাজত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হবে। শূন্য হয়ে যাবে রাজকোষ। আমোদপ্রমোদ বলতে কিছু থাকবে না। এমন বিপদের আভাস পেয়ে রাজা শরণাপন্ন হল সরকারের, সাহায্যের জন্যে তড়িঘড়ি খবর পাঠাল সদরে।
দেশীয় রাজা যদি ব্রিটিশের অনুগত হয় তাহলে তাকে তো রক্ষা করতেই হবে। সরকারের পুলিশবাাfহিনী তাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির। বিদ্রোহীদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে তারা ঘাঁটি গাড়ল আনন্দপুরে। কী দশাসই চেহারা পুলিশগুলোর! পায়ে ভারী ভারী বুট, কাঁধে ব¨ুক, মুখে দুধে-আলতার ছোপ। যেন যুদ্ধ করার ভঙ্গিতে তারা এসে ঢুকল গ্রামে। ভাবখানা এমনই, কেউ সামনে এসে দাঁড়ালেই হল, ব¨ুকের নল তাক করে সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেবে তাকে।
ডমরু নিজের চোখে ওদেরকে দেখেছে, বাবার মুখ থেকেও শুনেছে অনেক কিছু। বাবা সারাদিন নদীতেই থাকে। নৌকা চালায়, যাত্রী নিয়ে খেয়া পারাপার করে। লালমুখো ইংরেজ পুলিশগুলো সেই নৌকায় চেপে গ্রামে এসেছে। ওপারে সাহেব-পুলিশদের সদর দপ্তর, কাজে কাজেই এই জলপথ ছাড়া অন্য উপায় নেই। ওদেরকে দেখে তো বাবার বুক দুরুদুরু।
‘কী সব চেহারা পুলিশগুলোর! হাতে বন্দুক, পায়ে বুটজুতো। ইংরিজীতে কত কথা বলছিল। নৌকা থেকে নেমেই তারা বন্দুক উঁচিয়ে ছুটল গাঁয়ের দিকে।’
‘তারপর?’ অবাকচোখে ডমরু জিজ্ঞেস করে।
‘তারপর আবার কী, খানিকক্ষণ পরেই শুনতে পেলাম গুড়ুম-গুড়ুম আওয়াজ। ওরা গুলি চালাতে আরম্ভ করেছে।’
এই গুলির আওয়াজ ডমরুও শুনেছে। তাদের গ্রামের এখানে-ওখানে মাঝেমাঝেই হই-চই চিৎকার উঠছে। কান্নাকাটির শব্দও শোনা যাচ্ছে। কোথাও-বা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে আগুন। তার মানে অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে পুলিশরা। ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষজন। ডমরুর রক্ত গরম হয়ে ওঠে। রাজাকে রক্ষা করার জন্যে সরকার পাঠিয়েছে পুলিশ। কেন? না, প্রজাদেরকে জব্দ করবে বলে। তার মানে রাজা যত অন্যায়ই করুক, তার কোনও বিচার হবে না, দোষ চাপানো হবে শুধু প্রজাদের ঘাড়েই। কতখানি সাহস ওদের! সারাদিন ধরে কী তাণ্ডবই না চালাল ওরা! লাঠিসোঁটা নিয়ে কেউ এগিয়ে গেলেই একেবারে গুলি চালিয়ে দিচ্ছে। কাউকে বা মাটিতে ফেলে বুটজুতো দিয়ে পিষছে। তাদের অপরাধ? তারা যে রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেইজন্যেই শাস্তি পেতে হবে। কত নিরীহ মানুষ বুক চিতিয়ে পড়ে রইল পুলিশের ব¨ুকের সামনে। রক্তে ভিজে গেল আনন্দপুরের মাটি।
তাই বলে গ্রামের মানুষগুলো যে শুধুই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে তা অবশ্য নয়। ইংরেজ-পুলিশদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করার জন্যে তারাও আজ মরিয়া। শুধু কি আনন্দপুরের মানুষ? আরও কত আছে। কত কত লোক ছুটে আসছে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে। তাদের সকলেরই অভিযোগ ওই রাজার বিরুদ্ধেই। কেউ লাঠি-সড়কি নিয়ে, কারও-বা হাতে টাঙি-বল্লম। ডমরু নিজের চোখে দেখেছে, তাদের গ্রামের দশরথকাকাকে একজন পুলিশ মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারছিল। ঠিক তখনই কোথা থেকে দু’জন লোক ছুটে এসে বাঁশের মোটা লাঠি দিয়ে সেই পুলিশটাকে এমন ঘায়েল করল যে একেবারে ধরাশায়ী। বোধহয় মরেই গেল বেচারি। আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ডমরুর, কিন্তু ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল তখন।
বিকেলবেলায় বাড়ির দরজায় বাবার নাম ধরে নীচুগলায় ডাকাডাকি শুনে কীরকম আশ্চর্য লাগল। তাদের গ্রামের নবীনদা, ভরতজেঠু, কমলকাকা। চাষিদেরকে নিয়ে সভা করে, গ্রামে গ্রামে ঘোরা, সব ব্যাপারেই ওদেরকে দেখেছে ডমরু। কিন্তু এখন বাবার সঙ্গে কী দরকার?
‘পুলিশগুলো তাড়া খেয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। মনে হয় ঘাপটি মেরে বসে আছে কোথাও, সুযোগ পেলেই পালাবে।’
‘যাবে কোন দিকে?’
‘সেটাই তো কথা। সদরে যেতে হলে নদী পার হওয়া ছাড়া উপায় কী!’
‘হুঁ! তা ঠিক।’
‘এই একটা মস্ত সুযোগ। ঘাটে গিয়ে ওরা যদি নৌকা না পায় তাহলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে, সেই সময় ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে অন্তত জনা কয়েককে তো জলে ডুবিয়ে মারতে পারি।’
আড়ালে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে শুনছে ডমরু। মনে মনে ভাবছে, সত্যিই একটা বড় সুযোগ বই কী! পুলিশবাহিনী যদি ঘাটে গিয়ে হাজির হয় আর ওপারে যাওয়ার নৌকা না পায় তাহলে তখন ওদেরকে ঘায়েল করা অনেকখানি সহজ হবে। ভরতজেঠু যাওয়ার সময় বাবাকে বলে গেল, ‘তুমি আজ রাত্তিরে কিছুতেই ঘর থেকে বের হয়ো না। পুলিশগুলো নিশ্চয়ই ঘাটে দাঁড়িয়ে খুব হাঁকডাক করবে। আমরা সন্ধে থেকেই দল বেঁধে এখানে-ওখানে লুকিয়ে থাকব। সামনাসামনি যাওয়াটা ঠিক হবে না, ওদের হাতে এখনও অনেক গুলি-বন্দুক রয়েছে। এখন যদি এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারি। তারপর দেখা যাক কী হয়!’
কথাগুলো শোনার পর থেকেই ডমরুর মাথায় একটা অন্য ভাবনা ঘাই মারছে। ইংরেজ-পুলিশগুলো না হয় চুপিচুপি পালিয়ে যাওয়ার জন্যে রাতের অন্ধকারে নদীর ঘাটে গেল, তারপর সেখানে যদি নৌকাটাকে দেখে তাহলে হয়তো প্রাণ বাঁচাতে নিজেরাই খেয়া চালিয়ে ওপারে পৌঁছে যাবে, মাঝির দরকারই পড়বে না তাহলে!
নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোকে ঠিকঠাক সাজিয়ে নিয়েছে ডমরু। যা করার সে একাই করবে, কাউকে কিছু জানাবে না।
সন্ধে হতে না-হতেই চুপিচুপি ঘাটে চলে এসেছে ডমরু। আজ বাবা কিছুতেই এ-তল্লাটে আসবে না, সে জানে। মাঝির ছেলে ডমরু আস্তে আস্তে রশি খুলে দিল। ধীরগতিতে জল কেটে কেটে নৌকা এগিয়ে চলল মাঝনদীর দিকে। ব্যস, আর চিন্তা নেই। এবার আসুক না পুলিশগুলো, ঘাটে দাঁড়িয়ে মাথা কুটলেও তারা নৌকা পাবে না।
রাত ক্রমশ বাড়ছে। ঘাট থেকে অনেকখানি দূরে নৌকায় একা একা বসে ঠায় প্রহর গুনছে ডমরু। মাঝ আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদের আলো। ডমরুর এতটুকু ভয়ডর নেই। তার নজর শুধু ঘাটের দিকে।
হ্যাঁ, যেমনটি ভাবা হয়েছিল ঠিক তাই-ই, ইংরেজ-পুলিশগুলো গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়ে বোধহয় লুকিয়ে ছিল ঝোপে-জঙ্গলে, রাত্তির খানিকটা বাড়তেই তারা একে একে জড়ো হচ্ছে নদীর ঘাটে। ওরা তো জানত, নৌকা আছে, ডাকলেই মাঝিকে পাওয়া যাবে, ওপারে পৌঁছানোর কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু এখন যে চক্ষু চড়কগাছ। ঘাটের নৌকা মাঝনদীতে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটা ছেলে লগি হাতে সেই নৌকায় বসে রয়েছে।
‘এই, নৌকাটা এখানে নিয়ে আয়, আমরা ওপারে যাব।’
কোনও জবাব নেই।
‘কীরে, কথাটা কানে যাচ্ছে না? এই ছেলে, নৌকাটা ঘাটে ভেড়া বলছি। তাড়াতাড়ি আন।’
‘হ্যাঁ, তোমাদের কথা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু নৌকা এখন ঘাটে যাবে না।’
‘বটে! কে রে তুই? এত সাহস?’
‘আমি মাঝির ছেলে। নৌকা এখন এখানেই থাকবে, কোত্থাও যাবে না।’
কথাটা শুনে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে পুলিশের।
‘তোমরা শয়তান। তোমাদেরকে পার করার জন্যে নৌকাও ঘাটে যাবে না আর আমার বাবাও আসবে না।’
পুলিশগুলো এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটা ভারী বেগতিক। তাদেরকে যেমন করেই হোক তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। খেয়া ছাড়া এই ভরা নদী পেরিয়ে সদরে যাওয়ার অন্য কোনও রাস্তাও নেই। ওদিকে গ্রামের লোকজন ভীষণ খেপে আছে, হাতের কাছে পেলে একেবারে কচুকাটা করে ছাড়বে। এমন বিপদের সময় এ যেন এক উটকো ঝামেলা।
শেষমেশ পুলিশদের একজন গলার সুর নরম করে বলল, ‘নৌকাটা একবার ঘাটে নিয়ে এসো বাবা! কথা শোনো। আমাদেরকে ওপারে পৌঁছে দিলেই বকশিস পাবে তুমি।’
শুনে ডমরু চিৎকার করে বলল, ‘তোমাদেরকে চিনি না ভেবেছ? তোমরা তো খুনি। আমাদের গ্রামের কত লোককে তোমরা মেরেছ। শয়তান কোথাকার! তোমাদের পারও করব না, আর বকশিসও চাই না।’
পুলিশরা তো অবাক। বলে কী ছেলেটা? এত সাহস! তারা ফের অনুনয়ের সুরে বলল, ‘ওসব একদম বাজে কথা। তোমাকে অনেক কিছু দেবো, শুধু আমাদেরকে ওপারে পৌঁছে দিয়ে এসো।’
ডমরু সাড়াশব্দ দিল না, চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারছে, যত সময় নষ্ট হয় ততই পুলিশগুলোর ছটফটানি বাড়ে। ওদিকে গ্রামের ভেতর থেকে ততক্ষণে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে, ‘পালাল! পালাল! ধর ওদেরকে।’ তার মানে পুলিশগুলো এবার বেকায়দায় পড়ল বলে। নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ডমরু স্পষ্ট বুঝতে পারছে, লাঠি-বল্লম হাতে গ্রামের মানুষজন ছুটে আসছে ঘাটের দিকে।
পুলিশের একজন এবার জলের কাছে দাঁড়িয়ে বন্দুক উঁচিয়ে বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলল, ‘এ্যাই নৌকাটা ঘাটে আনবি কী না! কথার অবাধ্য হলে কিন্তু গুলি চালাব।’
প্রত্যুত্তরে ডমরুও চেঁচিয়ে বলল, ‘বলেছি তো, নিরীহ মানুষদেরকে খুন করে যারা পালাতে চাইছে তাদেরকে এতটুকু উপকার করা বারণ আছে। গুলি চালাতে হয় চালাও।’
কথাটা শুনে পুলিশদের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। এত স্পর্ধা ওই একরত্তি ছেলের! এত বেহায়াপনা! প্রথমে নাহয় ছেলেমানুষ বলে খানিকটা সহ্য করা যাচ্ছিল, কিন্তু এখন যে তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। ওই ছেলের জন্যে। তাহলে মরুক! মরুক! শাস্তি ওর কপালে ঝুলছে।
পুলিশদের চোখে-মুখে যেন আগুনের হল্কা।
লাঠি-বল্লম নিয়ে গ্রামের লোকজন ঘাটের কাছাকাছি এসে পড়েছে। তারা তখনও কিছু জানে না। অবস্থা বেগতিক বুঝে পুলিশের দল ফের গা ঢাকা দিয়েছে অন্ধকার বনেবাদাড়ে।
আর ওদিকে তখন ভরা জ্যোৎস্না বুকে নিয়ে ডমরুর দেহটা দোল খাচ্ছে টিয়ামুখীর জলে।