ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
শীতলপুর গ্রামের মদনহাটের জগন্নাথ মন্দিরে আজ সাজ সাজ রব। আজ যে রথ যাত্রার প্রথম রথের রশি ধরে টানার জন্য— অন্তত একটু ছুঁয়ে থাকার জন্য, সবাই কতই না অধীর হয়ে পড়বে। আঙুল দিয়ে একটু ছুঁতে পারলেও পুণ্যি একেবারে হাতের মুঠোয়।
কিন্তু ঐ প্রতিবছরই যা হয়। একে আষাঢ় মাস, তায় আবার শীতলপুর হল চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পুব বাংলার অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে। সাগরের পড়শি। তা, সেখানে বর্ষা শুধু আষাঢ়-শ্রাবণেই নয়, তারপরেও হয়। তাছাড়া, রথের মেলার দিনে তো বরুণ দেবতা বোধহয় স্বয়ং নিজে একবারটি নেমে আসেন। রথের রশি টানার জন্য। তাই—
‘ওরে অ ননী, বৃষ্টি যে নেমে এলো।’ কল্যাণীর মা ব্রজবালা সাবধান করে দেয় তার ডাকাবুকো মেয়েকে।
‘আমি তো বাপু নিজের ‘জুঁই’ নিয়েই যাচ্ছি। কেন অযথা চিন্তা করছ?’ বছর আট দশেকের কল্যাণী পাকা গিন্নীর মত বলে ওঠে। জুঁই হল তাল পাতায় বোনা মাথা আর পিঠ ঢাকতে পারে এমন এক লম্বা ‘টোকা’। এরকম টোকা মাথায় দিয়ে আসাম, খাসি-জয়ন্তিয়া পাহাড় বা চট্টগ্রাম— এসব বৃষ্টিবহুল এলাকার মানুষেরা নিশ্চিন্ত মনে বৃষ্টির মধ্যেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। চাষিরা খেতের কাজ করে।
ইতিমধ্যে কল্যাণীর বান্ধবী শশিবালা বাইরে থেকে ডাক দিল, ‘কল্যাণী, আর কত দেরি করবি লো? আমি কিন্তু এবার মদনহাটে চললাম।’
‘ওরে শশি দাঁড়া। এই এলাম রে।’ বলতে বলতে কল্যাণী বাইরে বেরিয়ে এলো। ইতিমধ্যে বাইরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। শশিবালার সাথে ছিল তার দাদা গোবিন্দ। তিন জনে পড়ি কি মরি করে দিল দৌড়। পিছন থেকে ব্রজবালা বলতেই থাকলো, ‘ওরে দস্যির দল, একটু দাঁড়িয়ে যা। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পড়বি যে।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা? ততক্ষণে তিনজনে পৌঁছে গেছে মদনহাটের রথ তলায়। ইতিমধ্যে রথ টানা আরম্ভ হয়ে গেছে। বৃষ্টি একটু ধরেছে। রশি ধরে এগিয়ে চলেছে আশেপাশের কয়েক গাঁয়ের লোক। সবারই মনের ইচ্ছে, ‘ওরে, একটু সর না বাপু। আমাকেও একবার ঠাকুরের রশিটায় হাত দিতে দে।’
আশেপাশে দোকানিরা মাথায় টোকা দিয়ে বা একটা কলা পাতার আড়াল করে বা মাথার ওপর একটা চাদর টেনে পশরা সাজিয়ে বসে আছে। বিক্রি হচেছ চুড়ি, টিপ, শাঁখা, সিঁদুর, সাজের জিনিস, পান, সুপারি, বাতাসা, মুড়কি, খাজা, গজা— এই সব।
এরই মাঝে একদল মানুষকে দেখে কল্যাণী অবাক হয়ে গেল। এরা আবার কারা? সবার নাক চ্যাপ্টা, গায়ের রং ফর্সা কিন্তু একটু হলদেটে, চোখ ছোট। মেয়েদের কানে, নাকে, গলায় অদ্ভুত সব গয়না। বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো কেমন যেন পোশাক গায়ে দিয়ে এসেছে। ততক্ষণে ওদের মেয়েরা এক অদ্ভুত ভাষায় গান গাইতে লাগলো।
ঘোর কাটতেই কল্যাণী চমকে ওঠে। ওমা, শশি আর বাঁশি দা কই? তার পাশে তো নেই। সে যখন ঐ পাহাড়িয়া লোকেদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাদের গান শুনছিল তখনই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সে চিৎকার করে ডাক দিল, ‘ওগো শশি! বাঁশি দা—!’ গোবিন্দ চমৎকার বাঁশি বাজাতে পারত, বাঁশি বানাতেও পারত। তাই শীতলপুরের সবাই তাকে এ নামেই ডাকত।
কিন্তু ঐ ভিড়ের হট্টগোলে তার ডাক কার কানে পৌঁছবে? আরও দু-এক বার ডাক দিয়ে তার গলা যেন শুকিয়ে এলো। আগু পিছু লোকেদের ঠেলাঠেলিতে তার হাত থেকে রথের রশি কখন গেছে খসে। সে ছিটকে পড়েছে ভিড়ের মাঝে। তার চোখ দুটো জ্বালা করছে। কিন্তু সারা শীতলপুর জুড়ে যে মেয়ের ডানপিটে বলে অত সুনাম আছে তার চোখে কি অত সহজেই জল আসে?
তবু—! কল্যাণী হাত তুলে নিজের গালটা মুছতে গেল। অমনি কে যেন তার হাত ধরে বলল, ‘বেটি তু হারায়ে গেছিস? কার সঙ্গে এয়েছিলি?’
‘ঐ তো শশি আর বাঁশিদা।’ কল্যাণী এমন ভাবে কথাগুলো বললো যেন ঐ অপরিচিত পাহাড়ি মেয়ে মানুষটি তাদের দুজনকেই চেনে। সেই অপরিচিতা হেসে বললো, ‘ঘাবড়াসনি। আমি তোরে সঙ্গে করে বাসায় পৌঁছে দেব। তোর বাড়ি কুথায়?’
ওদিকে ছাড়াছাড়ি হবার পর ভয়ে আতঙ্কে শশি একটা পাকুড় গাছের তলে বসে কাঁদছিল। আর তার দাদা গোবিন্দ ‘ননী, ননী!’ চিৎকার করতে করতে একবার মন্দির অব্দি যাচেছ, আবার ফিরে আসছে রথ তলায়। সমস্ত মদনহাট তার দুবার চক্কর দেয়া হয়ে গেল।
পথে যেতে যেতে নিজের কোচর থেকে সেই বুড়ি কালো আঙুরের মত দেখতে কয়েকটা ডুমো ডুমো পাকা ফলসা কল্যাণীকে দিয়ে বললে, ‘নে খেয়ে নে। সেই কখন বাড়ি থেকে তো বেরিয়েছিস।’ তারপর তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, ‘তুয়ার নাম কী রে বেটি?’
আবার বললো, ‘তুই আমারে জুম্মা মাসি বলে ডাকিস।’
যতক্ষণে কল্যাণীকে নিয়ে তার জুম্মা মাসি বাড়ি পৌঁছল ততক্ষণে তো সেখানে হৈ চৈ পড়ে গেছে। কারণ গোবিন্দ সেখানে এসে জানিয়েছে, ‘রথের রশি টানার সময় ননী যে কোথায় হারিয়ে গেল, তারা আর খুঁজে পেল না।’
কল্যাণীর ঠাকুমা দাওয়ায় বসে তার বাবাকে ডেকে বলছেন, ‘বলি অ নারানে, আমার নাতনিটা গেল কোথায়? যা বাছা, তাড়াতাড়ি মদনহাটে যা। সব্বাইকে জিজ্ঞেস করে দেখ।’
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্রজবালা বললে, ‘মেলায় তো শুনেছি আজকাল পুলিশ থাকে। তাদেরকে একবার—’
চট্টগ্রামের পূবেই তো সে যুগের বার্মা। আজকের মায়ানমার। অর্থাৎ মগের মুলুক। লোকেরা বলাবলি করত সে দেশের ছেলেধরারা নাকি মেয়েদের চুরি করে ওদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিত। ফলে বাড়িতে একটা কান্নাকাটির রোল পড়ে যাবে, সে আর এমন কথা কী?
যাক, কল্যাণীকে দেখতে পেয়েই ঠাকুমা তাকে বুকে টেনে নিলেন, ‘কোথায় ছিলি?’
মা এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল, এবার ঘন ঘন চোখ মুছতে লাগলো। তাড়াতাড়ি জুম্মা বুড়িকে ডেকে মুড়ি, নারকেল আর দুটি নাড়ু দিল খেতে।
এভাবেই আরম্ভ হল জুম্মা বুড়ির কল্যাণীদের বাসায় আসা-যাওয়া। সে এলে ব্রজবালা তাকে খেতে দেয়। কল্যাণী স্কুলে গেছে শুনলে তাকে দেখবে বলে সে চুপচাপ দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করত। সে যেন কল্যাণীর মুখের মধ্যে আর কারো ছবি খুঁজে পেত।
আড়ালে কল্যাণী একদিন ব্রজবালাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, জুম্মা বুড়ি কানে অত ভারি ভারি দুল পরে কেন? দেখছ না ওর কান কেটে ঝুলে পড়েছে। আর গায়ের ঐ পুরনো চাদরটাই বা পরে থাকে কেন?’
কুটনো কাটতে কাটতে ব্রজবালা হেসে বললো, ‘ওরা চাকমা আদিবাসী তো। ওরা ঐরকমই ভারি ভারি গয়না পরে। কানের লতি যায় কেটে। আর ঐ চাদরটাকে বলে ‘রিয়াপাছরা’। এমনিতে ওদের মেয়েরা জামার মত যে গায়ে দেয় তাকে বলে ‘হাদি’। আর কোমরের নিচে পরে ঘাগরার মত ‘পিনোম’।
কথায় কথায় একদিন কল্যাণী জুম্মা বুড়িকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কোথায় থাকো, মাসি?’
‘ঐ তো পাহাড়ের মুড়ায়।’ হাসতে গিয়ে জুম্মার চোখ দুটো যেন আরও ছোট হয়ে যায়। দাঁতের ওপর লেগে থাকে মুখের পান আর সুপারি। মুখের বলি রেখাগুলো হয়ে ওঠে আরও স্পষ্ট।
উত্তর দিক থেকে হাঁটা দিতে দিতে হিমালয় যেন সাগরে ডুব দেবার জন্যই পুব মুখো হয়ে এই চট্টগ্রামের পুব দক্ষিণে নেমে এসেছে। অদূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী শুধোয়, ‘তুমি ঐ পাহাড়ের চুড়োয় একলা থাকো? ভয় করে না?’
‘ভয় করলে কি চলে, বেটি? গাছের ডালে পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি একটা ঘরে আমি থাকি। আর আমাকে পাহারা দেয়—’
‘পাহারা দেয়? কে? কে পাহাড়া দেয়?’
‘তারে দেখবি? তা, আয় না একদিন আমার বাসায়। আসবি?’
‘হ্যাঁ, যাবো।’ আবার কি ভেবে প্রশ্ন করে, ‘তোমরা কী খাও গো?’
‘কেন? পাহাড়ে কী আর ফলের অভাব আছে? কাউফল, ফলসা, বর্ষার সময় বড় মনগুলা (বৈঁচি)। গরমে বুনো আম, কলা, জাম— কত কিছু।’
‘তুমি ভাত খাও না?’ সোজা প্রশ্ন, কিন্তু তার উত্তরের সন্ধানে সমস্ত পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যায়।
‘বাত কুথা পাবো?’ জুম্মা বুড়ি যেন উদাস হয়ে পড়ে। একটু থেমে হেসে বলে, ‘যেদিন তোমার মা বা আর কেউ দেয় সেদিন ভাত খাই।’
যাবার সময় চুপি চুপি সে কল্যাণীকে বললো, ‘খুকি, কাল আমার বাসায় আসবি তো?’
‘কাল? আচ্ছা। কিন্তু আমি তো তোমার বাসার পথ চিনিনা।’
‘ঐ পুব পাহাড়ের নিচে যে মসজিদ আছে, তার পাশ দিয়ে গেছে রেল গাড়ির রাস্তা। সেটা ধরে চলে যাবি। তারপর জঙ্গল শুরু হলে ভয় পাস না যেন। চড়াই বেয়ে উঠে যাবি। আমি তোকে দেখতে পেলেই নিচে নেমে আসব।’
কিন্তু কল্যাণী একলা যায় কী করে? অগত্যে আবার সেই শশি আর বাঁশিদার দ্বারস্থ হওয়া। যাই হোক, তারা এক কথাতেই অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রস্তুত।’
দুই সখীর সিনিয়ার পার্টনার গোবিন্দ চিন্তান্বিত হয়ে শুধালো, ‘যেতে আসতে তিন চার ঘণ্টা তো লাগবেই। বাড়িতে কী বলে যাবি?’
শশিই পথ বাৎলে দিল, ‘মাসিকে বলিস— তুই আর আমি ঢেঁকিশাক তুলতে যাচ্ছি। বাড়ি ফিরে নারকোল কোড়া দিয়ে খাবো।
তাই হল।
ব্রজবালা মেয়েকে সাবধান করে দিলেন, ‘দেরি করিস না। নইলে ঢেঁকিশাক আমি রাঁধবো কখন? দুপুর গড়িয়ে গেলে আমি হেঁশেল আগলে বসে থাকতে পারবো না বাপু।’
পরদিন—
রেল লাইনের পাশ দিয়ে এবড়ো খেবড়ো পথ বেয়ে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স পাহাড়ে উঠতে লাগলো। গভীর জঙ্গল। চারিদিকে ঘন গাছপালা। দিন দুপুরে যেন সাঁঝ নেমেছে। গোবিন্দ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘ওরে ফেরার সময় আমরা যদি পথ খুঁজে না পাই? দাঁড়া, গাছের পাতা ফেলে ফেলে তা দিয়েই পথে চিহ্ন দিয়ে দিয়ে যাই।’
আরও ওপরে পাহাড়ের গায়ে বাঁশবন। হলদে এবং চওড়া বাঁশ। কিন্তু কী হালকা। এ দিয়েই তো চাকমারা তাদের বাড়ি বানায়। মাটি থেকে প্রায় ছ’ ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্ম। তার ওপরে বাঁশ আর খড়ের ছাউনি দেয়া এক কামরার বাড়ি। তারই মাঝখানে তাদের হেঁশেল। যাদের অবস্থা ভালো তাদের বাসার সামনে ধান কোটার ঢেঁকি। দাওয়ায় ঝোলে চোঙা। তাতে মাছ বা সবজি ভরে আগুনে পুড়িয়ে রকমারি রান্না হয়।
‘এটা কী গাছ গো?’ আঙুল তুলে কল্যাণী জিজ্ঞেস করল। পাহাড়ের গায়ে সাদা ফলসুদ্ধ একটা ছোট গাছ।
মাথা চুলকে খানিকক্ষণ ভেবে গোবি¨ উত্তর দিল, ‘ওটা তো বাঘ আঁচড়া।’
‘এ ফল কি খাওয়া যায়?’ কল্যাণীর জিজ্ঞাসা।
‘জানিনা, বাপু। তোর মাসিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করিস।’
হঠাৎ কী একটা পাখি কটকট করে ডেকে উঠতেই শশি আর ননী দুই সখী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে, ‘উরে বাবারে! ও মাগো!’
তাদের বাঁশিদা তো হেসেই অস্থির, ‘ওরে ওটা কোন বাঘ নয়। নেহাত ভালোমানুষ একটা পক্ষী।’
‘এখানে বাঘ আছে নাকি, বাঁশিদা?’ প্রশ্নের শেষ নেই।
‘বন জঙ্গল হল বাঘের বাড়ি। এমন দুটো কচি মেয়েকে দেখতে পেলে বাঘ মামা কি আর লোভ সামলাতে পারবে?’
‘ওরে বাবারে!’ শশি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘আমি ফিরে যাচ্ছি।’
‘একলা যেতে হবে কিন্তু।’
শশির মুখ কাঁদো কাঁদো।
গোবিন্দর মুখের দিকে চেয়ে কল্যাণী বুঝল সে তাদের খেপাচেছ। সে চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, ‘তা কেন? বাঘ মামা এই তাগড়া ভাগ্নে কে ছেড়ে ভাগ্নিদেরই বা খাবে কেন?’
কিন্তু কোথায় জুম্মা মাসি? সে যে বলেছিল পাহাড় থেকে নেমে আসবে।
আর তখনই ঘন গাছের আড়াল থেকে ভেসে এলো, ‘ওমা, তুরা এয়েছিস! আয়, আয় সোনা বিটি আমার।’
পায়ে পায়ে ছুটে এসে জুম্মা বুড়ি কল্যাণীকে বুকে জড়িয়ে ধরল, ‘ওরে আমার মাহী ফিরে এসেছে আমার কাছে। হেই জগন্নাথ।’
‘মাহী! মাহী কে গো মাসি?’
জুম্মা বুড়ি যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মুখের হাসি যেন মেঘের আড়ালে জ্যোৎস্নার মত হঠাৎ ঢাকা পড়ে গেল। তারা চার জনে তখন পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে।
আকাশের দিকে চেয়ে জুম্মা বলে উঠল, ‘মাহী আমার বেটির নাম।’ তার দুই চোখে যেন শীতলপুরের কর্ণফুলি নদীর জল চিক চিক করে উঠল।
‘মাসি, কাঁদছ কেন? আমি তো তোমার কাছে এসেছি।’
‘বেটি, কাঁদি কেন? তুর মত আমারো একটা মেয়া ছিল। মাহী। তুর মতই চঞ্চল। ডাকাবুকো। তাই তো তোর বাড়ি যাই। শুধু তুকে দেখতে।’
‘কেন তার কী হল?’
‘একদিন সাঁঝের বেলা দারুণ বিষ্টি হচিছল। সে তখন জঙ্গলে গেছিল ফল আনতে। কিন্তু আর ফিরল না। পাহাড়ে পাহাড়ে আমি কুতো ঢুঁঢলাম। কিন্তু কোথাও তারে পেলাম না।’
সবাই নিঃশব্দে পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ জুম্মা বুড়ির নজর বাকি দুজনের ওপর পড়ে, ‘এরা দুজন কারা বটে?’
‘ঐ তো শশি। আর ও হল, বাঁশি দাদা। ওদের সাথেই তো সেদিন মদনহাটের রথের মেলায় গেছিলাম।’
জুম্মা বুড়ির বাড়ি বলতে তো ঐ পাহাড়ের কোলে গাছের ডালে পাতা ঘেরা ছাউনি। উপরে থাকে জুম্মা বুড়ি আর নিচে— বাঁশের পাটাতনের নিচে কালো সালো কি একটা জন্তু গুটিসুটি মেরে বসেছিল।
‘ও মাসি, ওটা কী গো?’
‘ঐ তো আমার দেখভাল করে। রাতে আমি ওপরে শুতে গেলে ও এইখানে থেকে আমাকে পাহারা দেয়।’
‘ওটা তো বেশ বড় সড় কুকুর।’
‘না গো বাছারা। কুকুর নয়, ওটা তো একটা ভালুক বটে।’
‘এ্যাঁ!’ তিন জনের গলা থেকে এক যোগে আর্তনাদ।
‘আরে ভয় পেয়ো না। যেদিন আমার মাহী হারিয়ে গেল সেদিনই তো ওকে আমি খুঁজে পেলাম। তখন তো ও এতটুকু বাচ্চা। ও ওর মাকে খুঁজছিল। আমি খুঁজছিলাম আমার মেয়েকে। আমিই ওকে বুকে করে নিয়ে এলাম। সেই থেকে ওকে আঁকড়েই তো বেঁচে আছি।’
ভালুকটাও এগিয়ে এসে জুম্মা বুড়ির কাছে খানিক আদর খেয়ে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ওরা তিন জনে নিশ্চিন্ত হল। তারপর চকমকি পাথর ঠুকে শুকনো পাতায় আগুন ধেিয় জুম্মা তিনটে ভুট্টা পুড়িয়ে নিল। তা দিয়েই হল অতিথি অ্যাপায়ন।
সুয্যি ঠাকুর ততক্ষণে পশ্চিমের যাত্রা শুরু করেছেন। কল্যাণীকে বলতেই হল, ‘অ মাসি, এবার আমরা যাই গো।’
কিন্তু জুম্মা বুড়ি যে তাকে ছাড়ে না। পাহাড়ের ‘মুড়া’ থেকে তাদের দেখিয়ে বলে, ‘এই পাহাড়ের উপর থেকে সুয্যি ঠাকুর তোদের গাঁয়ের দিকে নেমে যায়। তারপর সাগরের জলে লাল আবির গুলে দিয়ে রাতের মত শুতে চলে যায় আপন আস্তানায়। সে নাকি ঐ সাগরের পেটের ভেতর কী এক আলো ঝলমল প্রাসাদ আছে, তার ভেতরে।’
সেদিন তো কল্যাণীরা ফিরে এলো। ঢেঁকিশাক আর আনা হয়নি। বেলা তখন পড়ো পড়ো। তারপর তো কল্যাণী বড় হল। স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে পড়তে গেল। নারায়ণ আর ব্রজবালা তার বিয়ে দিলেন।
বিয়ের পরদিন যখন সে বরের সঙ্গে চলে যাচ্ছে— শাঁখ উলুর মাঝে আত্মীয় স্বজনেরা কাঁদছে, জুম্মা বুড়িও এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দু-চোখে তার বোরগাঙ (চাকমা ভাষায়) অর্থাৎ কর্ণফুলির ধারা।
কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে মন্তব্য করে, ‘ওহ, ও আবার কাঁদে কেন? নিজের পেটে তো আর ধরেনি, বাপু।’
আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কেউ আবার বলে, ‘হুঁ, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।’
নৌকোতে ওঠার সময় কল্যাণীও জুম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল।
‘আবার কবে আসবি বিটি?’ জুম্মা বুড়ি তার মাথায় হাত বলিয়ে শুধাল।
‘উনি বলেছেন ঐ পুজোর পরেই নিয়ে আসবেন।’
‘পুজোতে আসবি নে?’
‘শ্বশুর বাড়ির দেশে যে পুজো হয়, মাসি। নতুন বৌকে পুজোর সময় কি কেউ বাপের বাড়ি আসতে দেয়?’
‘আমি রোজ এই বোরগাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে দিন গুনবো।’
তাই হল। জুম্মা বুড়ি শীতলপুরের দিকে এলেই কর্ণফুলির কূলে এসে দাঁড়াত। চেয়ে চেয়ে দেখত— ঘাটে যে নৌকো এসে ভিড়ল তা থেকে কি তার বেটি নামছে?
সেটা ছিল ১৯৪৬ সাল। দেশ ভাগের কথা আকাশে বাতাসে। মায়ের বুক চিরে স্বাধীনতা পেতে চলেছি আমরা। পুজো শেষ না হতেই নোয়াখালির বুকে বয়ে গেল ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্ত গঙ্গা। ঠিক কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন। এক মাসের আগে এই ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গা থামেনি। শুধু তাই বা কেন? তার জের আজও কাটেনি। সে আগুন আজও নেভেনি।
নারায়ণ, ব্রজবালা এবং তাদের আত্মীয় স্বজনেরা দলে দলে গ্রাম ছেড়ে পালাতে লাগলো পশ্চিমে কলকাতার দিকে। পায়ে হেঁটে, নৌকোতে, রেল গাড়িতে। বামুন পাড়া, কায়েত পাড়া, কৈবর্ত পাড়ার মাটিতে ঘুরে বেরায় শেয়াল, আকাশে ওড়ে শকুন।
এরই মাঝে জুম্মা বুড়ি কিন্তু সুযোগ পেলেই চলে আসত কর্ণফুলীর তীরে। নির্মেঘ আকাশের দিকে চেয়ে থাকত। তার দুই চোখ কাকে যেন শুধাত— আজও আমার বিটি ননী এলো না কেন গো?
পাঠক, গল্পটি একটি শ্রদ্ধার্ঘ
কার উদ্দেশ্যে ভেবে দেখুন— লেখক