ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
তোমরা তো জানো সবাই প্রতি বছর ৫ই জুন সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতি সংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৫ই জুন পালিত হয় প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সেই বছর পরিবেশ দিবস উদযাপনের বিষয় (theme) ছিল, পৃথিবী একটাই (Only one earth)। অর্থাৎ, আমরা যতই বিভিন্ন দেশকে সীমানা দিয়ে আলাদা আলাদা করে রাখি না কেন, এই পৃথিবী কিন্তু একটাই, এই পৃথিবী আমাদের সবার, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন সামগ্রিক ভাবে একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। তারপর থেকে প্রতি বছরই ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। একেক বছর একেকটি লক্ষ্য স্থির করে দেওয়া হয় এবং একেক বছর একেকটি দেশ এই সারা বিশ্বের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এই দিনটি উদযাপনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।
এই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে এই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের দায়িত্ব নিয়েছে রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে ছবির মতো সু¨র স্বশাসিত দ্বীপ প্রদেশ জেজুতে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের জন্য সারা বিশ্বের ১৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা সমবেত হবেন। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, “Beat Plastic Pollution”, অর্থাৎ প্লাস্টিক দূষণকে পরাজিত করা। তোমরা যারা এখন ছোট, তারা বুঝতে পারছ না, কিন্তু আমরা বড়রা বেশ বুঝতে পারছি গোটা পৃথিবী জুড়ে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কী ভীষণ ভাবে হু হু করে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার বেড়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন এত এত প্লাস্টিকের পাত্র, প্লাস্টিকের প্যাকেট, ব্যাগ, জলের বোতল, আসবাব, এত সব কিছুই ছিল না। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলের বই খাতা নেবার জন্য ছিল অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স, আর কাঁধে ঝোলানো যায় এমন একটি জলের বোতল যেগুলো নিয়ে একটাতেই আমাদের স্বচছন্দে কেটে যেত অন্ততঃ তিন চারটে ক্লাস। লিখবার জন্য ছিল না লক্ষ কোটি ধরণের ইউজ এন্ড থ্রো প্লাস্টিকের পাঁচ টাকা দশ টাকার পেন, একটি দুটি ঝরনা কলম থাকত, তাতেই দোয়াত থেকে কালি ভরে ভরে লেখা হত। মাঝে মাঝে নিভটা পড়ে গিয়ে ভোঁতা হয়ে গেলে পাল্টে নিতে হত এই যা। একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে কিনে দেওয়া হত উইংসন পেন, যাতে কালি ভরতে হত না, পেনের ভিতরেই কালি টেনে নেবার ব্যবস্থা থাকত। মোটামুটি ভাবে চার পাঁচটা পেন দিয়েই গোটা স্কুলবেলা পেরিয়ে যেত। তারপর ধরো দোকান বাজারের কথা। এখনকার মতো এতো প্যাকেটে প্যাকেটে জিনিস মোটেই পাওয়া যেত না, প্রায় বেশির ভাগ জিনিসই দেওয়া হত কাগজের ঠোঙা বা প্যাকেটে। একসাথে বেশি জিনিস কিনতে হলে ব্যবহার হত চটের বা কাপড়ের থলি বা বস্তা। এখনকার মতো দোকানে কিছু কিনলে আনার সুবিধার জন্য, ‘‘একটা ক্যারি দিলেন না?’’ বলে দোকানদারের সঙ্গে চেঁচামেচি করার কোনো ব্যাপার ছিল না। এখনকার মতো দোকানে দোকানে ঝোলানো থাকত না হরেক রকমের চিপস, ম্যাগি, রামেন, চিঁড়ে ভাজা এইসবের মতো চটজলদি মুখরোচক খাবারের রঙবেরঙের প্যাকেট। ছিল না দু পা দূরে দূরে দোকানে দোকানে পুঁচকে থেকে বড় হরেক রকমের কোল্ড ড্রিংকসের প্লাস্টিকের বোতল কিম্বা প্লাস্টিকের মোড়কে নানা স্বাদের লোভনীয় আইসক্রিমের পসরা। যেগুলো আমরা খুব খুশি মনে খাই, তারপর ঐ প্যাকেটগুলো ডাস্টবিনে ফেলে নিশ্চিন্ত হই, কিন্তু ভেবে দেখি কি, ডাস্টবিন থেকে ওগুলো কোথায় যায়! ছোটবেলায় আমরা দেখতাম বাড়িতে জল খাওয়া হয় স্টিলের কিম্বা কাঁসার গ্লাসে, জল রাখা হয় মাটির কলসী বা কুঁজোয়, কখনো কখনো ঢাকা দেওয়া বালতিতে। একটু বড় হতে দেখলাম খাবার টেবিলে রাখা হল স্টীলের জলের জগ। অতিথি এলে সরবত দেবার জন্য কাচের গ্লাস। নেমন্তন্ন বাড়িতে খেতে দেওয়া হত কলা পাতা কিম্বা শালপাতা দিয়ে তৈরি থালায়। থালার শালপাতার জোড়ের ফাঁক দিয়ে ডাল, ঝোল গলে যেত একটু আধটু, তবে এত এত সৌখিন সুন্দর থার্মোকলের থালা, বাটি তখনও দূর অস্ত। মিষ্টি কিনতে হলে মাটির ভাঁড় কিম্বা কাগজের বাক্স। বাইরে চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য মাটির ভাঁড়ই ছিল ভরসা, ক্ষুদে ক্ষুদে প্লাস্টিকের কাপেরা তখনও বাজারে আসেনি। বাড়িতে ঘর ঝাঁট দেওয়া হত ফুল ঝাড়ু, খেজুর পাতার ঝাঁটা কিম্বা নারকেল ঝাঁটা দিয়ে, এখনকার মতো সিন্থেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি নানারকমের ঝাঁটা, ঝাড়ুর তখন কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বেতের তৈরি ঝুড়ি, ধামা, কুলো তখন সব ঘরে ঘরে, এখন তো এদের দেখতেই পাওয়া যায় না বলতে গেলে। তার বদলে রকমারি বাহারি প্লাস্টিকের ঝুড়ি ঘরে ঘরে শোভা পায়।
এইরকম ভাবে তোমরা যদি একটু ভালো করে চারপাশটায় তাকিয়ে দেখো, তাহলে দেখবে আমরা প্রতি দিন যে জিনিসগুলো ব্যবহার করি, তার একটা বিরাট অংশই হল প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। তোমাদের মনে হতে পারে, তাতে অসুবিধা কোথায়! প্লাস্টিকের জিনিস, প্লাস্টিকের থলি কিম্বা ক্যারিব্যাগ এসব ব্যবহার করার তো কত সুবিধা! যখন প্রথম প্রথম প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন আমরা সবাই এই সুবিধার দিকটাই বড় করে দেখেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন এই প্লাস্টিকের সুবিধাগুলো আমাদের রোজকার জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে লাগল তখন আমরা বুঝতে শিখলাম, যে এই প্লাস্টিকের জিনিস আমাদের যতখানি সুবিধা দিয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি আমাদের ক্ষতি করেছে, করছে এবং আগামীতেও করবে, যদি না আমরা এখন থেকেই এর ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক হই। আর তাছাড়া সুবিধাটা আমরা মানুষরা ভোগ করছি, কিন্তু এর ক্ষতি ভোগ করতে হচ্ছে শুধু মানুষকে নয়, এর ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে, দূষিত হচ্ছে জল, বাতাস, মাটি। প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে পৃথিবীর গভীরতম স্থান মারিয়ানা খাত থেকে শুরু করে পৃথিবীর উচ্চতম স্থান এভারেস্টের চূড়াও রেহাই পায়নি এই প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে।
কিন্তু কেন এই ক্ষতি, কিসের জন্য এই প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে আমরা এখন এতো চিন্তা করছি? সংক্ষেপে বিষয়টি জেনে রাখা উচিত আমাদের। প্রথমতঃ প্লাস্টিক জিনিসটি একেবারেই পরিবেশ বান্ধব নয়। এক টুকরো কাগজ বা কাপড় মাটিতে পড়ে থাকলে কিছুদিন পর দেখবে সেগুলো মাটিতে মিশে যায়, পরিবেশে মিশে থাকা ব্যাকটেরিয়ারা তাদের বিশ্লিষ্ট করে তাদের মূল উপাদানগুলিকে আবার পরিবেশে ফিরিয়ে দেয় কিন্তু এই যে আমরা প্রতিদিন বাড়ির ফেলে দেওয়া আবর্জনার সাথে দুধের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট কিম্বা এটা ওটা নানা রকম ফিনফিনে ক্যারিব্যাগ মিউনিসিপ্যালিটির ডাস্টবিনে ফেলে আসি নয়তো পথ চলতে চলতে পথের পাশে ফেলে চলে যাই, সেগুলো কিন্তু এরকম মাটির মধ্যে মিশে যায় না। এদের কিন্তু কোনো ব্যাকটেরিয়া মূল উপাদানে ভেঙে পরিবেশে ফিরিয়ে দিতে পারে না, সেগুলো মাটির নিচে জমতে থাকে নাহয় ওগুলো উড়ে গিয়ে নালা নর্দমা, পুকুর, নদী, সাগরে গিয়ে জমে। জল, মাটি দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে মাটির ওপরে বা জলের নিচে থাকতে থাকতে বাতিল প্লাস্টিকের জিনিসগুলি ক্রমশঃ ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। মাটি, জল কিম্বা বাতাসে মিশে থাকা এই সব মাইক্রোপ্লাস্টিকের গুঁড়ো আমাদের পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খলে যেমন নানা সমস্যার সৃষ্টি করে তেমনি বাতাসে মিশে আমাদের শরীরে ঢুকে সেখানেও নানা রকম রোগের সৃষ্টি করে।
তোমরা এখন নিচু ক্লাস থেকেই বিজ্ঞান বইয়ে পড়ছ আমরা যদি শক্তি উৎপাদনের জন্য এক নাগাড়ে পৃথিবীর মাটির তলায় থাকা জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়াম এইগুলো ব্যবহার করতে থাকি, তাহলে এইগুলো শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আর তখন শক্তির অভাবে মানব সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এখন এমন সব উৎস থেকে শক্তি তৈরি করা হচেছ, যেগুলো কখনো শেষ হবে না, যেমন সূর্যের আলো, বাতাসের বেগ, জোয়ার ভাটার সময় জলের স্রোতের বেগ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসের প্রধান একটি অসুবিধা হল এটি তৈরি করার জন্য একদিকে যেমন ঐ জীবাশ্ম জ্বালানি পেট্রোলিয়াম খরচ করতে হয় তেমনি বাতিল প্লাস্টিকের জিনিসকে গলিয়ে আবার ব্যবহারের জন্য নতুন জিনিস তৈরির সময় কার্বনডাইঅক্সাইড জাতীয় গ্রীন হাউস গ্যাস তৈরি হয় যারা সূর্যের তাপকে ধরে রেখে পরিবেশকে দিন দিন আরও গরম করে তুলছে। দুটোর কোনোটাই আমাদের জন্য ভালো নয়। শুধু তাই নয় প্লাস্টিক গলানোর সময় বা তৈরির সময় যে রাসায়নিক পদার্থগুলি তৈরি হয়, সেগুলি মানুষ, প্রাণী সবাইকার শরীরের জন্য বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর। এছাড়াও এই যে গোটা পৃথিবী জুড়ে একটা বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিকের বর্জ্য পদার্থ দিনের পর দিন জমা হচ্ছে, সেগুলো থেকে যতটা সম্ভব পরিবেশকে পরিচছন্ন রাখার জন্য যে সব ব্যবস্থা করতে হয়, সেগুলোও যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ।
এছাড়া ঐ সব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থের আরও অনেক কিছু ক্ষতিকর প্রভাব আছে, যা তোমরা একটু পড়াশোনা করলেই জানতে পারবে, সব বিস্তারিতভাবে এই অল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের সবাইকার এই প্রিয় পৃথিবীর অস্তিত্ব, আমাদের মানব সভ্যতার অস্তিত্ব আজ সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যে যে কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে, প্লাস্টিক দূষণ তার মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আমাদের পৃথিবীকে, আমাদের পরিবেশকে সুস্থ রাখতে গেলে, আমাদের জল, মাটি, বাতাসকে পরিচছন্ন রাখতে গেলে, আমাদের সবাইকে এই প্লাস্টিক দূষণের কুফল সম্পর্কে সচেতন হতেই হবে। এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেবার জন্য এর আগে ২০১৮ সালেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনে এই একই লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছিল, Beat Plastic Pollution। তারপর গত সাত বছর ধরে নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশেষ করে একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয় এমন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং প্লাস্টিক বর্জ্যরে থেকে তৈরি হওয়া দূষণ কমানোর জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। নানা আইনও চালু করা হয়েছে। তবু এ ব্যাপারে যতটা পথ এগোনো উচিত ছিল, আমরা তার সামান্যই পেরোতে পেরেছি। তাই আবারও এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বেছে নেওয়া হয়েছে, Beat Plastic Pollution। আমরা বড়রা তো আরও বেশি করে সচেতন হবার চেষ্টা করবই, সেই সঙ্গে তোমরা ছোটরাও এখন থেকেই বিষয়টি মনের মধ্যে গেঁথে নাও, প্লাস্টিক আমাদের বন্ধু নয়, প্লাস্টিক আমাদের এক বড় শত্রু। এর কাছ থেকে আমরা যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করব। আর সেই সাথে শপথ নাও যত্রতত্র প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলে আমাদের পরিবেশকে আর ভারাক্রান্ত করব না। পৃথিবীকে সুস্থ রাখার জন্য, নিজেরা সুস্থ থাকার জন্য পরিবেশকে প্লাস্টিক জঞ্জাল থেকে মুক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব।