ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
কত দিন বাদে শোভন বাড়ি এসেছে। দিন কোথায়? বরং বলা যায় কতগুলো বছর বাদে। লেখাপড়ায় সে বরাবরই ভালো ছিল। ভালো চাকরিও জুটে গেল। তারপরে তো সেই সাগর পারে উড়ে যাওয়া। যাওয়ার আগে তার জ্যাঠা শিবতোষ আর বাবা স্মরজিৎ জোর করে তার বিয়েটাও দিয়ে দিয়েছিল, ‘বিদেশে যখন যাচ্ছেই তখন এ কাজটা সেরেই যাও। নইলে পরে আর সময় পাবে না।’ এখন তো শোভন দুই ছেলে মেয়ের বাবা। সৌম্যজিৎ আর শ্রেয়া।
রাতে খেতে বসে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, তাউ কোথায়? সকালের পর তো আর দেখাই হল না।’ সিদ্ধার্থ তার জ্যেঠু শিবতোষকে তাউ বলে ডাকে। শিবতোষও তাকে আদর করে বলে তাউ।
ইতি বলল, ‘দাদা আর কোথায় যাবে? বাড়িতেই আছে।’
শোভনের সামনে বসে তার জ্যাঠতুতো দাদা সিদ্ধার্থ। দুই ভাই একসঙ্গে বসে কড়াইশুঁটির কচুরি খাচিছল। সে বলল, ‘বাবার সাথে তোর দেখা হয়নি নাকি?’
‘সেই সকালে একবার যখন প্রণাম করলাম, তখন। তারপর তো—’
‘হাঁ, তারপর তো বাবা চেম্বারে চলে যায়।’
‘আর দুটি কচুরি নেবে?’ তার বৌদি কৌশিকী জিজ্ঞেস করে।
শোভন হাঁ হাঁ করে ওঠে, ‘বৌদি এবার আমার পেট একেবারে ফটাস হয়ে যাবে।’
‘আরে ওদেশে বার্গার পিৎজা পেতে পারিস, কিন্তু এ জিনিস পাবি না। চালিয়ে যা। আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেসও করছে না। আমি রামচন্দ্রের কষ্টটা বুঝি। বনবাসে থাকাকালীন সীতা হয়ত লক্ষ্মণের পাতেই ভালোটা মন্দটা তুলে দিত। শ্রীরামচন্দ্র হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন।’
শোভনের বৌ ঝরণা হাসতে হাসতে বললো, ‘দাদা, ঘাবড়িয়ো না। আমি তো আছি। তোমার পাতে দেবার জন্য।’
শোভনের মনে পড়ে তার তাউ এভাবেই সাথে একসঙ্গে বসে খাওয়াটাই পছন্দ করত। খেতে বসে সকলকে হাসাত। ছোট্ট শোভনকে যেন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। নিজের ছেলেকে হয়ত কখন উঁচু গলায় কিছু বলেও দিতেন কিন্তু ভাইপোর বেলায় তার আদরের শেষ ছিল না। তাকে খেপাবার জন্য কি কান্ডটাই না করতেন। খাবার শেষে সিদ্ধার্থের মা চন্দনা হয়ত সবার সামনে পায়েসের বাটি রেখে দিল, অমনি শিবতোষ টুক করে শোভনের পায়েসটা নিজের দিকে টেনে নিত। শোভন অমনি জেঠির কাছে নালিশ জুড়ে দিত, ‘বড়মা, দেখ, তাউ আমার পায়েস নিয়ে নিয়েছে।’
‘এটা তোর নাকি? এটা তো তোর জেঠি আমার থালার সামনেই রেখে গেল।’
‘তোমার পায়েসের বাটি তো তোমার সামনেই রয়েছে। ওটা আমার।’
‘আরে তাউ, বুঝলি না? একটা চেখে দেখার, আরেকটা খেয়ে দেখার।’
শেষ পর্যন্ত মুশকিল আসানের শরণাপন্ন হওয়া।
‘বড়মা দেখো না। তাউ আমার পায়েস খেয়ে নিচ্ছে।’
চন্দনা এগিয়ে এসে শোভনের বাটিটা তার সামনে করে দিয়ে স্বামীকে বকত, ‘কি যে তোমার ছেলেমানুষি! বুঝি না বাপু।’
পঁয়তাল্লিশের শিবতোষ স্কুলের ছেলেদের মত দুই কানের দুই পাশে হাত তুলে জিভ বের করে ভাইপোকে ভ্যাঙাত, ‘নালিশ করে বালিশ পায়। চোখের জলে ভেসে যায়!’
‘আমি কাঁদছি কোথায়?’ ছোট্ট শোভন প্রতিবাদ করে উঠত। ততক্ষণে সে তার প্রাপ্য কাজ পাখির মত ছিনিয়ে নিয়েছে।
আজ এই বয়সে শোভনের সেই ছেলেবেলার কত কথাই না মনে পড়ছে।
শিবতোষ নিজে ডাক্তার হলেও সে বড়দের সাথে যেন ঠিক মেলামেশা করতে পারত না। বাড়িতে অতিথিরা এলে তাদের ছেলেমেয়েদের ছবির বই দেখাত বা তাদের সঙ্গেই গল্প করত। মানুষ অনেক সময়েই সবার সামনে নিজের সন্তানকে সেভাবে আদর করতে পারে না। হয়ত একটু লজ্জা বোধ হয়। এই যেমন বাড়িতে কেউ এলে, যখন তাদের সামনে মিষ্টি ইত্যাদি দেয়া হয় তখন সে নিজের ছেলেকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু অন্যের ছোট ছেলে যদি হাত বাড়িয়ে টুক করে কিছু তুলে নেয় এবং তার বাপ মা তাকে বলে, ‘ওটা কি হচ্ছে?’ তখন তিনিই বলে ওঠেন, ‘আহা থাক না। ওদের জন্যই তো আনা।’ বরং বাচ্চাটাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আরেকটা পান্তুয়া দিই?’
চাষি নিজের জমিতে সেচ করার জন্য জমির চারিদিকে আল দিতে থাকে। যাতে জল এদিক ওদিক বয়ে না যায়। কিন্তু যখন সারা গাঁ বৃষ্টির জলে ভেসে যায় তখন সে কোথায় আগল দেবে? নিজের সন্তানকে ভালবাসার সময় শিবতোষের যে সঙ্কোচ ছিল, ভাইপোর বেলায় সে সব যেন আদরের জোয়ারে ভেসে যেত।
শিবতোষের ঠাকুরদা পূর্ববঙ্গ থেকে সুদূর জয়পুরে এসে বাসা বেঁধে ছিলেন। শিবতোষ এমবিবিএস পাশ করে এখানেই প্র্যাকটিস শুরু করে। স্মরজিৎও এ তল্লাটে চাকরি পেয়ে গেল। ফলে তাদের আর বাড়ির বাইরে পা বাড়াতে হয়নি। শিবতোষের ছেলে সিদ্ধার্থও রাজস্থান ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার। অতএব এদের সংসার ভালই চলে যাচিছল।
শোভনের মনে পড়ছে —একবার ধুলান্ড়ির (হোলি) ক’দিন আগে সে আর সিদ্ধার্থ তার বাবার সাথে রং মিষ্টি এসব কিনতে বেরিয়ে গেছিল। ঠিক তার পর দিনই স্কুলে একটা অ্যানিম্যালদের পোস্টার জমা করার কথা ছিল। ঐ বন্য প্রাণী সংরক্ষণের বিষয় ইত্যাদি নিয়ে। আবির রং এসব নিয়ে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই দেখে তার মা ইতি ইতিমধ্যে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বসে আছে। ছেলেকে দেখেই ইতির গলায় বজ্র নির্ঘোষ, ‘তোর ডায়রিতে লেখা আছে যে কাল স্কুলে অ্যানিম্যালদের পোস্টার জমা করতে হবে। আর তুই বাবার সঙ্গে এসব ছাই পাঁশ কিনতে চলে গেছিলি?’
কাকীর রণচণ্ডী রূপ দেখে তো সিদ্ধার্থ পগার পার। নিজেদের ঘরে ঢুকে বই নিয়ে বসে পড়ল। ইতির মন্ত্রোচ্চারণ অব্যাহত চলতে থাকে, ‘এ ছেলের ভবিষ্যৎ যে কী হবে তা ভাবলে ভয় হয়।’
শোভনের বড়মা চ¨না এগিয়ে এসে জা-কে বলে, ‘হয়েছে বাপু, আর ছেলেটাকে বকিস না তো। তোর এই সারাক্ষণ পড়া আর পড়া।’
‘আমার আর কী দিদিভাই? এবার ইউনিট টেস্টে রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ঢুকবে।’
ইতিমধ্যে শিবতোষ চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরেছেন। হট্টগোল শুনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হয়েছেটা কী?’
সব শুনে হেসে বললেন, ‘ইতি, আমার ড্রইং শিটটা এনে দাও। আমি সব এঁকে দিচ্ছি।’
তাই হল। হাসতে হাসতে শিবতোষ বললেন, ‘এভাবে মাথায় মুগুর মেরে কি ছেলেগুলোকে এ্যানিম্যাল লাভার বানাবে নাকি? যত্ত সব। ব্যাগের ভারে তো বাচ্চাগুলোর শিরদাঁড়া বেঁকে যাচ্ছে।’
কোন দিন সকাল বেলায় এই শিবতোষ হয়ত বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে সেভিং করছে, ইতিমধ্যে শোভন সেখানে এসেছে। তাকে দেখতে পেয়ে শিবতোষ তার পেছনে লাগতো, ‘তাউ, আয় তোর গালে সাবানটা লাগিয়ে দিই। তোরও দাড়ি বেড়ে গেছে।’
‘তাউ, আমার বাস এসে যাবে। আমার স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।’ এই বলে চেঁচাতে চেঁচাতে শোভন বাড়িময় ছুটে বেড়াত আর তার পেছনে পেছনে তার জ্যাঠা।
বা, কখনো শোভনের খেলার টয় কারটা বুড়ো খোকা শিবতোষ বালিশের নিচে লুকিয়ে দিত। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যখন সে তার জ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করত, ‘তাউ, আমার কারটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’
শিবতোষ বলত, ‘আমি কেন লুকিয়ে রাখব? এক কাজ কর তুই আমার কারটা নিয়ে চালা। ওটা তো বড় গাড়ি। আমি বরং তোর কারটা খুঁজে নিয়ে চালাবো।’
এর পর কি আর কিছু লুকানো থাকে?
সেই শিবতোষই আবার এক একদিন মন মরা হয়ে পড়ত। শোভন তখন একটু উঁচু ক্লাসে। সে চন্দনাকে জিজ্ঞেস করত, ‘বড়মা, তাউ-এর কী হয়েছে? জ্বর টর হয়েছে?’
‘কী আর বলি বাছা। ঐ আজ ওনার একটা গল্প ফেরত এসেছে। তাই মন মরা হয়ে রয়েছে। যেমন হয়েছে সব পত্রিকাগুলো। আরে বাবা একটু পড়ে তো দেখবি। বুঝি না বাপু। আর তোর তাউয়ের কথা আর বলিস না। কোন গল্পের একশো টাকা পেলে এমন খুশি হয় মনে হয় যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে। আর ফেরৎ এলো তো সারাদিন মুখ ভার করে থাকা।’
সেদিন শোভন জেনেছিল তার ডাক্তার জ্যাঠা শুধু যে আঁকতে পারেন, তাই নয়, তিনি গল্প ইত্যাদিও লিখতে পারেন। বরং সেগুলো বড় ছোট নানা পত্রিকায় ছাপাও হয়ে থাকে।
আরেকটু বড় হতে সে ভাবতো এই জন্যই বোধহয় তার তাউ ছোটদের সঙ্গেই মিশতে ভালোবাসত। বড়দের সেই একই কথা বার্তা— কে কত টাকায় নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে বা বাড়ি কিনছে বা বাড়ি করতে কার কত আন্দাজ খর্চা হয়েছে। কে দু’বছর যেতে না যেতেই গাড়ি পালটেছে। ক্রিকেটের বিষয়ে এমন করে এক্সপার্ট কমেন্ট যেন তারা এক একজন ওস্তাদ ক্রিকেটার। অনায়াসেই সচিন তেণ্ডুলকারের হাত ধরে তাকে ব্যাটিং করা শেখাতে পারে। বা জোর গলায় ঐ রাজনীতির কিচির মিচির। এর বদলে তিনি বাচ্চাদের গল্প শোনাতেই ভালবাসতেন। মুঠো করে কাগজের বল বানিয়ে টেবিলে বসে বসে স্কেল বা খুন্তি দিয়ে ব্যাট বল খেলতেন।
এই স্বভাবের জন্যই তার জ্যাঠা চট করে কোন বিয়ে বাড়ি, বার্থ-ডে পার্টি ইত্যাদিতে যেতে চাইত না। এ নিয়ে চন্দনাকে কী কম ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়েছে? অথচ আশেপাশের গাঁয়ে কৃষক সভার অনুষ্ঠানে গিয়ে রুগীও দেখত, আবার তাদের পরিবেশন করে খাইয়েও আসত। এসব কথা যতদিনে শোভন উপলব্ধি করতে পেরেছে, ততদিনে তো তার সাগর পাড়ি দেবার সময় হয়ে গেছে।
আজ যেন শোভনের বার বার মনে হচেছ তাউ যদি তাদের সঙ্গে বসে খেত তো কী মজাটাই না হত। কচুরি খেতে খেতে গত তিরিশ বত্রিশ বছরের ছবি গুলো যেন তার মনের স্ক্রিনে অনবরত চলতে থাকে। খাওয়া শেষ করে সে উঠে দাঁড়িয়ে কৌশিকীকে জিজ্ঞেস করে, ‘বৌদি, তাউ কি খেয়ে নিয়েছে?’
‘না। তা কেন? তোমার আগেই খেতে পারেন নাকি? আছেন কোথাও। বাবা পরে আমাদের সঙ্গেই বসবেন।’
ঝরণা বারান্দা থেকে উঁকি মেরে বলল, ‘নিচে অমলদের ঘরে নেই তো? একটু আগে মনে হল ওনার হাসির আওয়াজ পেলাম।’
সিদ্ধার্থ ভাইকে বলল, ‘তুই নিজে নিচে গিয়ে দেখ না তোর তাউ কী করছে?’
নিচে এসে অমল ইমনের ঘরে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা সব গেল কোথায়? কারোকে দেখা যাচেছ না কেন? সবাই হাওয়া?
ততক্ষণে তার চোখের সম্মুখে সে যে দৃশ্য দেখতে পেল তাতে যেন তার মুখে হাসির ঝড় উঠতে গিয়েও থেমে গেল। শোভনের মনে হল তার জেঠু শিবতোষের মাথার চুলে পাক ধরলেও, চোখে চশমা লাগলেও তার বুকের মাঝে যেন এক চঞ্চল শিশু ভোলানাথ বাস করে। এক উচ্ছল নদীর মত সে ধেয়ে যেতে চায়। ভোরে জাগা পাখিদের মত সে গান গেয়ে উড়ে যেতে চায়। এক চির শিশু।
অমলের পড়ার টেবিলের নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে শিবতোষ বেরিয়ে এলো। তার দু’চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা।
ইতিমধ্যে তার নাতি নাতনির দল পালঙের নিচ থেকে, বারান্দা থেকে ছুটে এসে তাকে ঘিরে হাত তালি দিয়ে চিৎকার জুড়ে দিল, ‘দাদু, আমাকে ধর দেখি। দাদু আমাকে ধরতে পারে না। হো হো।’
দাদু নাতি নাতনিরা মিলে চোর পুলিশ খেলছে।
‘তবে রে দাঁড়া, সব কটাকে দেখাচিছ মজা।’ বলতে বলতে শিবতোষ উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছুটে গেলেন অমল, ইমন, সৌম্যজিৎ আর শ্রেয়াদের ধরতে।
হাসতে হাসতে ছোট বোম্বেটের দল ছুটে পালালো।
ইতিমধ্যে চোখ বাঁধা থাকার দরুণ শোভনের গায়ে হাত পড়তেই শিবতোষ দুই হাত দিয়ে তাকেই জড়িয়ে ধরলেন, ‘ধরে ফেললাম তোকে এবার। কোথায় পালাবি?/কাঁদলে পরে জেনে রাখিস লোককে হাসাবি!’ কিন্তু পুরো কথাটা বলতে গিয়ে শিবতোষ যেন থমকে গেলেন। এটা তো কোন বাচ্চা নয়।
ওদিকে নাতি নাতনির দল হো হো করে চিৎকার জুড়েছে, ‘কাঁদছে দাদু, ধরতে মোদের পারলো না তো বলে/হাতের মুঠোয় আসা পাখি উড়েই গেল চলে!’ সবাই মিলে শিবতোষকে দুয়ো দিতে লাগলো।
‘তার মানে?’ বলতে বলতে শিবতোষ নিজের চোখে ঢাকা কাপড়টা খুলে নিল। ও মা! সামনে তো দাঁড়িয়ে তার আদরের সেই তাউ! সে বলল, ‘আরে তুই কখন নিচে এলি?’
শিবতোষ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন।
এতক্ষণে শোভন তার সেই পুরনো তাউকে পেয়ে গেছে। সে তার জ্যেঠুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘আমার সাথে বুঝি আর চোর পুলিশ খেলবে না?’