ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
এক ছিল সদাগর। তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলে সে ব্যবসা করতো। সদাগর মারা গেল। তার একটি মাত্র ছেলে। ছেলের বয়স কম। ছেলে এই বয়সে কি ব্যবসা করবে? মা বললেন— তুই যা, তোর বাবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা কর, তাঁরা যা বলবেন, সেইমত চলবি।
সদাগর পুত্র চললো বাবার তিন বন্ধুর কাছে।
প্রথম বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখে অনেকগুলি কুকুর। বললো— কাকাবাবু একটা কুকুর ছানা আমাকে দেবেন, পুষবো।
পিতৃবন্ধু একটা কুকুর ছানা দিলেন।
দ্বিতীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সদাগর পুত্র দেখলো যে বাড়িতে অনেকগুলি বেড়াল। বললো— কাকাবাবু একটা বেড়াল ছানা আমাকে দেবেন, পুষবো।
পিতৃবন্ধু একটা বিড়াল দিলেন।
তৃতীয় বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখলো তিনি অনেক বেঁজী পুষেছেন। বললো— কাকাবাবু আমাকে একটা বেঁজী দেবেন, পুষবো।
পিতৃবন্ধু একটা বেঁজী দিলেন।
কুকুর, বেড়াল ও বেঁজী নিয়ে সদাগর পুত্র বাড়ি ফিরলো। মা বললো— এ সব কি হবে?
ছেলে বললো— পুষবো।
সদাগর পুত্র কুকুর, বেড়াল, বেঁজীর খুব যত্ন করে। কুকুর আর বেড়াল খুব পোষ মানে। দিন রাত পিছু পিছু পায় পায় ঘোরে। কিন্তু বেঁজী কিছুতেই পোষ মানে না। কেবলই পালানোর চেষ্টা করে। খায় না। গোঁজ হয়ে খাঁচার মধ্যে বসে থাকে। সদাগর পুত্র একদিন বললো— মা, একে নিয়ে কি করি?
মা বললেন— বনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিগে যা—
মায়ের কথামত সদাগর পুত্র বেঁজীকে বনে ছেড়ে দিয়ে এল। বেঁজী এক দৌড়ে বনের মাঝে হারিয়ে গেল।
দিন যায়।
বেঁজীর কথা সদাগর পুত্র ভুলেই গেছে। এমন সময় একদিন বেঁজী এসে হাজির হলো। মুখে একটা হীরের আংটি। বনের মাঝে আংটিটি পেয়ে সে সদাগরের ছেলেকে দিতে এসেছে।
সদাগর পুত্র আংটি নিয়ে দেখে অনেক ধুলো-মাটি লেগে আছে। আংটিটা মেজে ধুয়ে সে আঙ্গুলে পরতে চাইল।
আংটির গায় যেই যে বুরুষ ঘষছে অমনি আংটি কথা বলে উঠল— অমন করে ঘষো না, আমার লাগছে।
সদাগর পুত্র চমকে উঠলো— কে? কে কথা বলছে?
—আমি আংটি। আমায় অমন করে ঘষো না, আমার লাগছে। কি চাও বল, আমি দোব।
—যাই চাইব তুমি দেবে?
—হ্যাঁ দোব।
—আমাদের বাড়িটা ঝকঝকে তকতকে করে দাও। সামনে একটা ভাল ফুলের বাগান করে দাও।
—আজ রাতেই সব ঠিক করে দোব। আমায় আর ঘষো না।
সদাগর পুত্র আংটি আর পালিশ করলো না। জলে ধুয়ে নিয়ে আঙ্গুলে পরলো।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তাদের পুরানো বাড়ি ঝক্ঝক তক্তকে করছে, লাল রং দেওয়া হয়েছে, সামনের মাঠে ফুলের বাগানে সাদা লাল হলুদ ফুলের বাহার। সদাগর পুত্রের চোখ জুড়িয়ে গেল মন খুশি হলো।
রাতারাতি অমন বাড়ি, অমন বাগান দেখে পাড়াপড়শীর চোখ টাটাল। রাজার কানে কথা উঠলো। রাজা তো বাড়ি, বাগান দেখে অবাক হলো, এমন বাগান তো তাঁরও নেই। বললেন— মন্ত্রী খোঁজ নাও তো, কি করে এসব হলো?
ক’দিন পরে মন্ত্রী খবর দিলে— এসব একটা আংটি থেকে হয়েছে মহারাজ, এ আংটি যাদু জানে। যা চাইবে, তা-ই দেবে।
রাজা বললেন— ওই আংটি আমার চাই।
কিন্তু ওই আংটি তো আর চাইলেই পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী কোটালকে ডাকলেন। কোটাল চোরের সর্দারকে ডাকলো। ডাকলো— আংটি চুরি করে এনে দিলে রাজা লাখ টাকা বখশিস দেবেন।
দুপুর রাতে সব যখন নীরব নিঝুম হয়ে গেল, তখন চোরের সর্দার বেরুল আংটি চুরি করতে। সদাগরের বাড়ির পিছনে এস পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে বরাবর এলো শোবার ঘরে। কুকুর শুয়েছিল খাটের নীচেই। চোরের গন্ধ পেয়েই সে লাফিয়ে উঠলো, চীৎকার করে বাড়ি মাথায় করলো। চোর আর পালানোর পথ পেলো না। কুকুর তার পায়ে কামড়ে রক্তারক্তি করে দিল। তবু চোর পালালো। সদাগর পুত্র আর বাড়ির চাকরেরা উঠে আলো জ্বালতে জ্বালতে চোর পালালো।
চোরের সর্দার কোটালের কাছে গিয়ে বললো— বাড়িতে যে কুকুর আছে, তা তো বলেন নি।
কোটাল মন্ত্রীকে বললো সব কথা, মন্ত্রী বললো— ভালই হলো, চোর আজ রাজসভায় গিয়ে নালিশ করবে।
চোর রাজসভায় গিয়ে নালিশ করলো।
রাজা সব শুনে বললেন— চোরের ধর্ম চুরি করা, গৃহস্থের ধর্ম সাবধান হওয়া, আর চোরকে ধরে কোটালের হাতে দেওয়া, চোরকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায়, চোরের রক্তপাত ঘটানো বে-আইনী, সদাগর পুত্রকে কারাগারে বন্ধ কর। চোর তো কিছুই চুরি করেনি, তবে কেন তাকে কুকুরে কামড়াবে? এ অত্যাচার, এ অন্যায়।
সিপাই এসে সদাগর পুত্রকে ধরে নিয়ে গেল। কোটাল তাকে অন্ধকার কারাগারে রেখে চাবি বন্ধ করলো। দরজা বন্ধ করার আগে সদাগর পুত্রের আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে নিলো।
বিড়াল এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে, সে জেলখানার পাঁচিলের উপর উঠে সব দেখলো।
দেখতে দেখতে দিন তো গেল। রাতে জেলখানার পাহারাদার খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে, বিড়াল গিয়ে পড়লো। বালিশের নীচে ছিল জেলখানার চাবি, সন্তর্পণে চুরি করে আনলো চাবিটা। জেলখানার গরাদের ফাঁক দিয়ে চাবিটা এগিয়ে দিল সদাগর পুত্রের কাছে।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে সদাগর পুত্র মনের দুঃখে বসে বসে ঝিমুচ্ছিল, চাবি পেয়েই লাফিয়ে উঠলো, গরাদের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে তালা খুলে ফেললো তারপর বেরিয়ে পড়লো জেলখানা থেকে।
বাড়ি ফেরা হলো না, সদাগর পুত্র রাতের আঁধারে নগর ছেড়ে পালিয়ে গেল বনে। সঙ্গে রইল কুকুর, বিড়াল আর বেঁজী।
বেঁজী দেখলো সদাগর পুত্রের হাতে আংটি নেই কোথায় গেল আংটি? বেড়াল বললো— আংটি রাজা কেড়ে নিয়েছে।
বেঁজী ছুটলো রাজবাড়ি। অনায়াসে রাজার শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। দেখে রাজার আঙ্গুলে সেই আংটি। বেঁজী তখনই আংটি শুদ্ধ রাজার আঙ্গুলটাই কামড়ে নিল, তারপর চলে এল বনে। মুখ থেকে বের করে দিলো আংটি। সদাগর পুত্র আংটি নিয়ে ভিন দেশে চলে গেল, আংটির দৌলতে তার কোন দুঃখই রইল না। তার সঙ্গে রইল বিড়াল, কুকুর আর বেঁজী।
এদিকে আঙ্গুল কাটা রাজার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল, ছেলেরা বাঁধলো— দুষ্টবুদ্ধি রাজা রে, আঙ্গুল কাটা সাজারে—