ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
প্রতিটি উৎসবের কেন্দ্রে থাকে শিশুদের আনন্দ। উৎসবকে কেন্দ্র করে নির্ভেজাল আনন্দ তো তারাই করতে পারে। বড়দের অল্প বিস্তর মানসিক চাপ থাকে। তবে যারা সারা মাস উপবাস ব্রত পালন করে তাদের একটু আলাদা আনন্দই হয়, কারণ সংযম রক্ষা করতে পারল, এমন একটা আত্মবোধ থেকেই তাদের আনন্দ হয়। এই মাসে আত্মসংযমের কথা বারবার বলা হয়েছে। শিশুরা ধর্মীয় নিয়মকানুন নিয়ে এতটা ভাবে না। যদি অভিভাবকরা তাঁদের গন্ডীবদ্ধ করে না রাখেন।
উৎসবের আনন্দ বললে শৈশবের কথা উঁকি দেয়। ঈদ হোক আর দুর্গাপুজো হোক উৎসবকে কেন্দ্র করে তারা একটা মুক্তির হওয়া লাগায়। তখন তাদেরকে সামনে রেখে বড়রাও আনন্দ পায়।
শহরের ঈদ আর গ্রামের ঈদ আনন্দ লাভের ক্ষেত্রে কত তফাৎ। গ্রামে ঈদের দিন রেডিও নির্ভরতা বিশেষ করে বাংলাদেশের রেডিও স্টেশন থেকে অনুষ্ঠান শুনতো মানুষ। নজরুলের সেই গান হতো, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ইদানিং শহরে ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদ্ভট সংস্কৃতি, সাউন্ড বক্সের আওয়াজ মানুষকে বিরক্ত করে তুলছে।
গ্রামে অভিভাবকের তরফ থেকে তুলনামূলকভাবে শিক্ষার্থীর উপর চাপ কম। তাদের আনন্দ শুরু হয় শবেবরাতে তারাকাটি পোড়ানো ও বোমা ফাটানোর মধ্য দিয়ে। তারপর দিন গোনা শুরু। হিজরি সনের অষ্টম মাস শাবান মাসের শেষ রাত থেকেই শুরু হয় রোজা। চলে নবম মাস অর্থাৎ রমজান মাসের ২৯ বা ৩০ দিন ধরে। ভোরের যে নামাজ তা হল ফজরের নামাজ। তার আগে পর্যন্ত খাওয়া চলতে পারে সেই খাওয়াকে বলে সেহেরি। রোজা শুরু। তারপর সারাদিন নির্জলা উপবাস অর্থাৎ জল পর্যন্ত না খেয়ে থাকা। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দিলে উপবাস ভঙ্গ যাকে বলে রোজা খোলা, ইফতার। এখন ইফতার পার্টির চল, বিশেষ করে শহরে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার উপস্থিতির মাঝে, কোথায় যেন একটা বিচিছন্নতা কাজ করে চলেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেউ কেউ বলছে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। মফঃস্বলেও কোথাও কোথাও হচ্ছে এমন, আয়োজনে ঘাটতি নেই। আমাদের জিভ শুকিয়ে আসে।
খেজুর খেয়ে শুরু হয়, কাকির নামে ফলের আয়োজন। নামি দামি শরবত, কোল্ড ড্রিংকস, বিরিয়ানি। শহুরে জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতায় নামি দামি খাবার তো থাকবেই। কিন্তু আগে বিশেষ করে গ্রামে নুন আদা খেয়ে রোজা খোলা হত। তারপর এক গ্লাস লেবুর শরবত। মুড়ি, ছোলা অথবা পিঠে। কিংবা সিমাই খেয়ে মসজিদে কিংবা ঘরে মাগরিবের নামাজ পড়া। তারপর নামাজিদের জন্য থাকে বিশেষ নামাজ তারাবি। কোথাও কোথাও নামাজের মৌলানা সাহেব গোটা কোরআন পাঠ করেন। একে বলে খতম তারাবি।
প্রথম দিন রোজা রাখার আবদার থাকে অনেক বাচ্চার। রোজা খোলার পর শৈশবের অনাবিল আনন্দ ধর্মীয় ভাবনা থেকে শিশুদের দূরে রাখে। রোজা রাখার এই ব্যাপারটাই রমজান মাসে হয় বলে অনেকে বলে রমজান, বিদেশে বলা হয় ‘রামাদান’। কয়েকদিন রোজা করার পর একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তবে শারীরিকভাবে যারা অসুস্থ তাদের জন্য রোজা বাধ্যতামূলক নয়। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে কেউ কেউ বলেন এটা শরীরের জন্য উপকারী, সজীব কোষগুলো নাকি মৃত কোষকে খেয়ে ফেলে। এসব নিয়ে জাপানের কোন্ বিজ্ঞানী নাকি গবেষণা করেছেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ তো আছেই। বলা হয় এই মাসেই কোরআন নাজেল হয়েছিল। নাজেল অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ ‘ওহি’ প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর নির্দেশ নিজের মুখে উচ্চারণ করেছিলেন। আরবি ভাষায় লেখা এই কোরআন আসলে সুস্থ শান্তিময় জীবন চর্যার নির্দেশাবলি।
আরবের দেশগুলোতে এই সময় প্রচুর দান করা হয়। কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা থেকে ইফতার করানো হয়। চলে নিয়মিত। মসজিদে নিয়মিত এর আয়োজন থাকে।
পরবর্তী দশম মাস শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলেই ঈদ যাকে বলে ‘ঈদুল ফিতর’ পালন। বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখাতে শিশুদের আনন্দ। বিকাল হলেই গ্রামের প্রান্তে গিয়ে ফাঁকা মাঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিংবা ছাদে উঠে দেখার চেষ্টা করে। ঈদের চাঁদ না দেখতে পেলে পরের ২৪ ঘণ্টা তাদেরকে বিষাদ ভোগ করতে হতো। এখন অবশ্য প্লেনে করে গিয়ে আকাশে চাঁদ দেখা হচ্ছে। শিশুরাই প্রশ্ন তোলে ঈদের দিনটা ফিক্সড নয় কেন? হিজরি সাল আসলে চন্দ্র মাস ধরেই চলে। চাঁদ দেখলে শুক্লপক্ষ শুরু, আর না দেখলে কৃষ্ণপক্ষ। পাঁজিপঞ্জি তো এই নিয়মেই চলে। চাঁদ দেখার আনন্দ থেকে শিশুরা যেন বঞ্চিত না হয়। কেউ আবার এখন প্রশ্ন তুলছে ঈদের ছুটি একদিন কেন? কোনো কোনো স্কুলে দুদিনও ছুটি দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক ছুটি জমিয়ে রাখেন।
মসজিদগুলোকে এখন আলো দিয়ে সাজানো হচ্ছে, কোথাও কোথাও ঈদ উপলক্ষে শিশুকিশোররা গেট তৈরি করে। ঈদের দিন সকালে সিমাই, পায়েস হালুয়া খেয়ে তারা বাবার হাত ধরে মাঠের মসজিদে বা ঈদগাহে যায়। নতুন জামা কাপড় আগেই কেনা হয়েছে। মায়েদের প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার স্বাধীনতা বাবাদের মতো এতটা আসেনি সর্বত্র। ঈদের নামাজ হয়ে গেলে কোলাকুলি করে, একে অপরকে ‘ঈদ মোবারক’ জানায়। এখন অবশ্য মোবাইলের স্ট্যাটাস দেওয়ার একটা রীতি চালু হয়েছে।
ঈদের সঙ্গে ‘ফিতর’ কথাটার যোগ আছে এই জন্যই যে এই পবিত্র মাসে গরিবদের দান করা বাধ্যতামূলক। তবে পড়শি গরিব হলে তাকে আগে দিতে হবে। এই দান নামাজের আগের দিন জাকাত হিসাবে দিয়ে শেষ করতে হবে। যাতে দুঃস্থ মানুষেরা কেনাকাটার সুযোগ পায়।
ইসলামে পাঁচটি স্তম্ভের একটি হল জাকাত। আক্ষরিক অর্থে জাকাত হলো, ‘যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশি হয়’। বেশি জিনিস দিয়ে দেওয়াই ভালো। সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করে তার উপর জাকাত দিতে হয়। কম করে সম্পত্তির শতকরা আড়াই ভাগ দান দিতেই হবে। কেউ তার বেশিও দান করে থাকেন। উদ্বৃত্ত অংশের একটা পরিমাণ সঠিকভাবে দিলে সাম্যের ব্যাপারটা অনেকটা সহজ ভাবেই এসে যেত, কিন্তু কঞ্জুস্ লোকেরও অভাব নেই।