ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
সবে মাত্র সরস্বতী পুজো গেল। শীতের ঠান্ডাভাব এখন অনেক কম। রোদটা বেশ চড়বড়িয়ে উঠছে। ভোর বা সকালের দিকে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকলেও রোদ ওঠার পর বেশ গরম। পুরোদমে নতুন ক্লাসের পড়া চলছে। টুবাইয়ের এখন ক্লাস সেভেন। অফিস যাওয়ার সময় দেবতোষ টুবাইকে স্কুলে নামিয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর মনিকা নিয়ে আসে। কখনও দেবতোষের বাবা ভুপেনবাবুও নিয়ে আসে।
আজও অফিস যাওয়ার পথে টুবাইকে স্কুলে নামিয়ে অফিস চলে গেল দেবতোষ। তখনও টুবাই বেশ চনমনে ছিল। কিন্তু অফিস থেকে ঘরে ফিরে দেবতোষ বুঝতে পারল টুবাইয়ের কিছু একটা হয়েছে। মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মনিকা সামনে বসে থাকলেও টুবাইয়ের যে পড়াতে মন নেই সেটা বুঝতে পারছে না।
দেবতোষকে দেখতে পেয়ে মনিকা বলল, ছেলের হোম টাস্কটা একটু দেখ। আমি চা আনছি। দেবতোষ এই ঘরে ঢোকার আগে দেখে এল, ভুপেনবাবু বই পড়ছেন।
সেই ছোট্ট থেকে দেবতোষ দেখে আসছে বাবাকে। বাবা বই পড়তে খুব ভালবাসেন। মূলত গল্প বা উপন্যাসের বই। শহরের জেলা গ্রন্থাগারের মেম্বার। দেবতোষের বাবা চাকরি করত টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। তাদের অফিসেও নিজেদের একটা লাইব্রেরী ছিল। বাবা সেখানকারও মেম্বার ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সেই মেম্বারশিপ ছেড়ে জেলা গ্রন্থাগারের মেম্বার হয়েছিলেন। বই পালটাতে গিয়ে ফেরার পথে টুবাইকে নিয়ে আসেন।
দেবতোষ ছেলের কাছে এসে বলল, কী হয়েছে? স্কুলে কিছু হয়েছে নাকি? মুখটা অমন কেন? মা বকেছে? টুবাই মাথা নীচু করে বই দেখছে। কী হল? আমাকে বলবি না? মাকে বলেছি। মা বলেছে ওসব না করে পড়াশোনা করতে। মাকে কী বলেছিস আমি জানবো কেমন করে? আমাকে বল। আজ স্কুল থেকে নোটিশ দিয়েছে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা জমা দিতে হবে। বেশ তো! লেখা জমা দে। মা বকবে।
ঠিক আছে। আমি মাকে বুঝিয়ে বলব। এবার আমাকে বল, তুই কী লিখবি? গল্প? কবিতা নাকি ছড়া।
জানি না। মনিকা চা নিয়ে এসে বলল। কী হল তোমরা দুজনে গল্প করছ! বললাম যে হোম টাস্কটা দেখিয়ে দাও। আর শোনো, ওদের স্কুল থেকে ম্যাগাজিন বের হবে। সেখানে লেখা জমা দিতে বলেছে। আমি বারণ করে দিয়েছি। এখন থেকে আর বাজে সময় নষ্ট করা যাবে না। কয়েকবছর বাদেই মাধ্যমিক। রাজ্যে প্রথম দশে থাকতেই হবে। দেবতোষ মনিকার কথাগুলো শুনল কিন্তু কোনও উত্তর দিল না। সে জানে এখন উত্তর দিতে গেলেই অশান্তি হবে। মনিকার এই এক গোঁ। ছেলেকে সে ডাক্তার করাবেই। তার বাপের বাড়ির দিক থেকে দুজন ডাক্তার আছে। কিন্তু মনিকা এটা বুঝতে চায় না, সবার মাথা এক নয়। সবাই সব কিছু করতে পারে না। এতে যে ছেলেটার ব্রেনে চাপ পড়বে। তাছাড়া মানুষের মধ্যে একটু কল্পনা শক্তি না থাকলে, আবেগ না থাকলে যন্ত্র হয়ে যাবে। মানুষ হবে না। ইতিমধ্যে দু-তিন দিন পার হয়েছে। দেবতোষ মনিকাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করিয়েছে। মনিকাও বলে দিয়েছে, এটাই শেষ। আর এসব করতে দেবে না।
টুবাই এখন বেশ খুশি। নিজের মনে অনেক কিছু ভাবছে, কাগজে কিছু লেখার চেষ্টাও করছে কিন্তু কিছু পারছে না। এর মধ্যে তার ক্লাসের অনেকেই লেখা জমা দিয়েছে। এদিকে লেখা জমা দেবার দিনও কমে আসছে। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতেই টিফিন পিরিয়ড শেষ হল। সবাই যার যার ক্লাসরুমে এসে বসতেই দীপেনবাবু এলেন বাংলার ব্যাকরণ পড়াতে। তিনি চেয়ারে বসেই বললেন, অনেকেই লেখা জমা দিয়েছ কিন্তু দু-একজনের লেখা মৌলিক। বাকিরা ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটঅ্যাপ থেকে নানা ধরণের লেখা কাগজে লিখে দিয়েছ। ওই সমস্ত লেখা সব বাতিল হবে। নিজেরা ভেবে লেখার চেষ্টা কর।
টুবাইয়ের মা টুবাইকে মোবাইলে হাত দিতে দেয় না। ফলে সে এসব জানেও না। কিন্তু সে কী লিখবে সেটাই এখনও ঠিক করতে পারে নি। ফলে তার লেখাও হয় নি। হাতে আর মাত্র সাত দিন বাকি। এর মধ্যে লেখা জমা দিতে হবে।
টুবাই বাড়ি এসে দাদুর কাছে গেল। দাদুকে সব বলল। ভুপেনবাবু টুবাইয়ের কথা শুনে বললেন, বাহ্ এতো ভাল কথা। তুমিও লেখ।
আমি কী লিখব বুঝতে পারছি না। ঠিক। এটা তো না বোঝারই কথা। ছোট থেকে তোমার মা তোমাকে গল্পের বই পড়তে দেয় নি। বইমেলায় নিয়ে যায় নি। এখন হঠাৎ করে তুমি লিখতে চাইলেই কী লিখতে পারবে! লেখার আগে অনেক পড়তে হয়। একটা গল্প লিখতে গেলে প্লট বা বিষয় লাগে। তার পর তাকে কল্পনার রঙে রাঙাতে হয়। তুমি তো অনেক বই পড়। তুমি লিখতে পারবে?
না দাদুভাই। আমি লিখতে পারব না। লেখা একটা আর্ট। লিখব বললেই লেখা যায় না। তবে তোমার যখন লেখার ইচ্ছে হয়েছে, আমি তোমাকে গাইড করব। তোমরা পঁচিশে ডিসেম্বর কোথায় গিয়েছিলে?
ব্যান্ডেল চার্চ, হুগলির ইমামবারা। কিসে করে গিয়েছিলে? বাড়ি থেকে টোটো করে। তারপর ট্রেন করে ব্যান্ডেল স্টেশন। সেখান থেকে বাবা একটা টোটো বুক করে গিয়েছিলাম। বেশ। এতেই হবে। এটাই লিখব? হ্যাঁ। তবে একটা পদ্ধতি মেনে লিখতে হবে। সেই পদ্ধতিটা আমি তোমাকে বলে দেব। এটা যদি লিখতে পার তাহলে সেই লেখাটা হবে ভ্রমণ কাহিনি। একটা ভ্রমণ কাহিনি কীভাবে লিখতে হয় সেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব।
রবিবার দিন দাদুর ঘরে বসে টুবাই লিখে ফেলল একটা ভ্রমণ কাহিনি। ভুপেনবাবু লেখাটা পড়লেন। লেখাতে বেশ কিছু বানান ভুল আছে। সেগুলো দেখিয়ে দিলেন। কিছু কিছু জায়গা বাদ পড়েছে। কিছু জায়গা আগে পিছে লেখা হয়েছে। সেগুলো দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।
পরদিন স্কুলে গিয়েই নিজের লেখাটা জমা দিয়ে দিল টুবাই। মাস কয়েক পর একদিন জানানো হল, স্কুল ম্যাগাজিন ছাপা হয়ে গিয়েছে। স্কুলে চলেও এসেছে। এই কথা শুনে সবাই বেশ উত্তেজিত। কার লেখা আছে কার লেখা নেই, ম্যাগাজিন হাতে পেলেই জানা যাবে।
আজ সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। মদনদা দু-তিন বান্ডিল ম্যাগাজিন রেখে গেল টেবিলের উপরে। দীপেন স্যার ক্লাসে ঢুকে আগে রোল কল করলেন। তারপর বললেন, ম্যাগাজিন দেওয়ার আগে একটা ঘোষণা আছে। স্কুল কমিটি ঠিক করেছে ছাত্রদের এনকারেজ করার জন্য একটা পুরষ্কার দেওয়ার। প্রতি ক্লাসের যার লেখা সব থেকে ভাল হবে তাদেরকেই সেই পুরষ্কার দেওয়া হবে। এটা জেনে অন্যরাও পরের বার ভাল লেখা চেষ্টা করবে। শুধু তাই নয়, চাকরি বা কোনও কাজের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এদের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ লেখক বা কবি হয়ে উঠবে। এবার একজন করে এসে ম্যাগাজিন নিয়ে যাও।
সবাই পেয়েছ? জানতে চাইলেন দীপেন স্যার।
হ্যাঁ স্যার। পেয়েছি। বেশ। এবার তাহলে বলি, এই ক্লাসের থেকে মোট সাতটি লেখা সিলেক্ট হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে ভাল লিখেছে শুভায়ু দত্ত। নিজের নাম শুনে টুবাই নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
স্যার বললেন, শুভায়ু একটা ভ্রমণ কাহিনি লিখেছে। তার লেখায় অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে ব্যান্ডেল চার্চ, হুগলির ইমামবারার ছবি। তোমরা সকলেই পড়বে। সবার লেখাই পড়বে। ঢং। স্কুল শেষের ঘণ্টা বাজল। সে বাইরে এসে দেখল তার দাদু দাঁড়িয়ে আছে। টুবাই একছুটে দাদুকে জড়িয়ে ধরল।