ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
বিলটু আর ওর যমজ বোন মিলি। ওরা ঠিক করেছিল এবছর দোল খেলবে না। দরজা-জানলা এঁটে ঘরে বসে বসে দুজনে তুলিতে রং চুবিয়ে ছবি আঁকবে। বুঝতে পারছি, তোমরা ভাবছ এ বাবা, দোলের দিনে কেউ ঘরে বসে থাকে? রং মেখে ভূত সাজার মজাই আলাদা। একে অপরকে রং মাখানোর মজা কি রঙিন ছবি এঁকে পাওয়া যায়? ছবি আঁকার মজা একরকম। আর, রং খেলার মজা আর একরকম। আরে বাবা, এ তো সবাই জানো। তোমরাও জানো— বিলটু মিলিও জানে। সাধ করে কী আর ওরা এবছর রং খেলবে না বলেছিল? রং খেলবে না ভাবতেই ওদের চোখে জল টলটল করছিল। তবু ঠিক করেছিল দোলের দিন বাইরে বেরোবে না। কারুর সাথে রং খেলবে না।
তোমরা তো সবাই নিজের চোখেই দেখেছ— গত বছর রং খেলার পরই বিলটু মিলি কেমন ভুগে ছিল। চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিল। হাতে পায়ে, সারা শরীর জুড়ে ফুসকুড়ি চুলকোতে চুলকোতে নাজেহাল। ওষুধ খেয়ে মলম লাগিয়ে উপশম হতে অনেক দিন লেগেছিল। তবে বিলটু মিলির রং খেলতে না-পারার দুঃখ বুঝতে পেরে ওদের বাবা-মা একটা উপায় ভেবে রেখেছিলে। ওদের চমক দেবেন বলে আগে কিছু বলেননি।
দোলের মাসখানেক আগে থেকে ওদের বাবা কিলো কিলো গাঁদা ফুল, লাল জবা ফুল, নীল জবা ফুল কিনে এনে ছাদে বিছিয়ে শুকোতে লাগলেন। আর, পনেরো দিন আগে থাকতে পলাশ, শিমুল ফুলও শুকনো করতে লাগলেন।
বিলটু মিলি যতই বলে— মা, ও মা, এত ফুল শুকিয়ে কী হবে গো? মা হাসতে হাসতে বলেন— আমি কী ছাই জানি? তোদের বাবা জানে।
ওরা ওদের বাবাকে বলে— এত ফুল শুকিয়ে কী হবে বাবা? বাবা কেবল বলেন— একটা জিনিস করব।
—কী জিনিস বাবা?
—যখন করব তখন দেখতে পাবে। এখন বলে দিলে যে মজাটাই মাঠে মারা যাবে। চমকটা আর চমক থাকবে না। ওরা ভেবেই পায় না, কী হতে চলেছে?
তবে দোলের সাত দিন আগে থেকে ওরা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল বটে। বাবা ওইসব শুকনো ফুল ময়দার সাথে মিশিয়ে আবির তৈরি করলেন। মা-ও ময়দার সাথে হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে হলুদ আবির তৈরি করলেন।
—এগুলো দিয়ে কী হবে?
বিলটু মিলি বাবা-মাকে শুধাল।
বাবা হেসে বললেন— সময় হলে দেখতে পাবে। ও, একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি।
তোমাদের একটা কাজ করতে হবে।
—কী কাজ? বিল্টু বলে।
—ও বাবা, কী কাজ করতে হবে? মিলি বলে।
—তোমরা তোমাদের খেলুড়ে সাথিদের দোলের দিন সকালবেলায় আমাদের বাড়িতে আসতে বলবে। তোমাদের মা-ও ওদের বাড়ি বাড়ি বলে আসবে। এবার দোলের দিনে আমরা সবাইকে আমাদের বাড়িতে আটক করে রাখব। কাউকে বাইরে রং খেলতে দেব না।
বিলটু বলল— এমন শুনেল ওরা আসবে কেন? মিলি বলল— ঠিকই তো, ওরা আসবে কেন?
মা বললেন— আসবে আসবে। আমি বুঝিয়ে বলব। দেখবি সবাই কেমন হই হই করে চলে আসে! সকালবেলায় লুচি আলুরদম বোঁদে। তারপর দুপুরে পাঁঠার মাংস, ভাত, চাটনি, পাঁপড় ভাজা। বিকেলে মঠ ফুটকড়াই খাবে সবাই।
—তাহলে তো সকলেই আসবে— বিলটু মিলি দুজনেই বলল। কী মজা, কী মজা বলতে বলতে হাততালিও দিতে লাগল।
দোলের আগের দিন দু-ভাইবোন অবাক। বাবা বাজার থেকে কিলো পাঁচ ছয় বিট নিয়ে এলেন। সাথে বেশ কিছু পিচকারি। মঠ ফুটকড়াই কদমা। ভেজিটেবিল চপ করতে বিট লাগে। বিটগুলো দিয়ে কি মা চপ তৈরি করবে? কে জানে। দু-ভাইবোনের মাথায় কিছুই ঢোকে না। বিলটু মিলির মুখের দিকে চায়। আর মিলি বিলটুর মুখের দিকে। ওদের মাকে কিছু শুধালে ওদের মা কেবল মুচকি মুচকি হাসেন। কিছুই বলেন না। ওরা দেখল রাতের বেলা মা আর বাবা মিলে বিটগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে বড়ো মাজলায় জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখলেন। মাজলা কাকে বলে জানো তো? গরু মোষকে খাবার দেবার মাটির জায়গা।
আজ দোল। খুব সকালেই বিলটু মিলি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। নানান ভাবনা ওদের মাথায় চড়কির মতো ঘুরে ঘুরে মরছে!
—দেখ দাদা, —মিলি বলে —বিট-ভেজা জলটা কেমন লাল হয়ে গেছে!
বিলটু বলে— ও মা তাইতো! বিটগুলো তুলে নিয়ে ওই জলটা দিয়ে রং খেললে ভারি মজা হবে।
—মজা হবেই তো। হলুদ গুঁড়ো জলে গুলে হবে হলুদ রং। এইসব রঙিন জল দিয়ে তোমরা এবার রং খেলবে। আর, ওই যে আবির তৈরি করে রেখেছি— সেগুলো যত খুশি মাখবে। মাখাবে।
বাবা মায়ের কথা শুনে বিলটু মিলি অবাক হয়ে থ বনে গেল!
ফের বাবা বললেন— বলেছিলাম না চমকে দেব, কেমন চমক দিলাম?
কিছু পরেই ওদের খেলুড়ে সাথিরা এসে হাজির। সকলের হাতেই একটা করে পিচকারি দেয়া হল। জলখাবার খেয়েই সবাই হই হই করে রং খেলায় মেতে উঠল। তারপর আগের কথা মতো দুপুরে ভুরিভোজ। বিকেলে মঠ ফুটকড়াই কদমা খেল। তারপর বিলটু মিলি আর সবাই বাবা-মায়ের পায়ে আবির দিল।
দোলের দিনটা বেশ মজা করেই কেটে গেল। সবাই মিলে আওয়াজ তুলল— আসছে বছর আবার হবে।