ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
গাভীকে খড়-ঘাস, খইল-ডাল খাওয়াতে যে খরচ হয়, সত্যবান আদক তার দ্বিগুণ দামের দুধ দুয়ে নেয়। এঁড়ে বাছুরটা মায়ের দুধ ঠিকমতো খেতে পায় না। সকালে-বিকালে চার লিটার দুধ দুইলে যথেষ্ট। সত্যবান আর তার স্ত্রী ফুলবালা সকালে-বিকালে গাভীর পাঁচ লিটার দুধ দুয়ে নেয়।
সত্যবান আদক সরকারি ভূমি দপ্তরে চাকরি করে। সে অত্যন্ত কৃপণ, অসামাজিক আর আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। সে কোনও প্রতিবেশীকে একশো টাকাও ধার দেয় না। তার অর্থের অহংকার খুব। তবে কোনও প্রতিবেশী তার অহংকারকে গ্রাহ্য করে না।
বকনা হলে বাছুরটা ফুলবালার খুব যত্ন পেত। বাছুরটাকে দুধ খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলত। এঁড়ে হওয়ার জন্য বাছুরটাকে অনাদরে বড় হতে হচ্ছে। গাভী সুযোগ পেলেই জিভ দিয়ে চেটে চেটে বাছুরটাকে খুব আদর করে। রোগা বাছুরটাকে দেখলে তার খুব দুঃখ হয়। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
দুধ দুয়ে নেওয়ার সময় গাভী দু-দিন সত্যবানকে লাথি মেরেছিল। এখন তাই গাভীর পিছনের দু-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে, বাঁট শুকনো করে দুধ দুয়ে নেয়।
গোয়ালে গাভীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। গোয়ালের এক ধারে বাছুরকে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়। একদিন দুপুরে গাভী গলার দড়ি ছিঁড়ে ফেলে। বাঁশের বেড়া শিং দিয়ে সরিয়ে দেয়। বাছুরের কাছে আসে। বাছুর দুধ খেতে শুরু করে। গোয়ালে খুটখাট শব্দ শুনে ফুলবালা আসে। বাছুরকে দুধ খাওয়াতে দেখে ফুলবালা গাভীকে গালাগাল দেয়। সে ক্রোধে উন্মাদিনীর মতো হয়ে, গোয়াল পরিষ্কার করার ঝাঁটা দিয়ে গাভীকে পেটায়। তারপর দুধ দুইবার জন্য সে বালতি নিতে ঘরে আসে।
গাভী মনের দুঃখে বাছুরকে সঙ্গে নিয়ে গোয়াল থেকে বেরিয়ে আসে। পূর্বদিকের একটা রাস্তা ধরে সে হাঁটতে থাকে। সে মনে মনে স্থির করে নেয় যে, সত্যবান আদকের গোয়ালে সে আর ফিরবে না।
কখনও গৃহস্থ বাড়ির পাশ দিয়ে, কখনও বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে গাভী আর বাছুর নতুন একটা মাঠে আসে। তারা একটা বাবলাগাছের নীচে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাছুরটাকে একবার দেখে নিয়ে গাভী মাঠের দিকে তাকায়। বিরাট মাট। জমির আলে আলে বাবলা, নিম, অর্জুন, খেজুর, তাল ইত্যাদি গাছ। ফসল শূন্য মাঠে সবুজ ঘাস। অদূরে কিছু গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে।
মাঠে মাঠে চরে বেড়ানোর অনেক অভিজ্ঞতা আছে গাভীর। মাঠের মাঝখানে উঁচু পাড় দেখে, বাছুরকে সঙ্গে নিয়ে গাভী জলের সন্ধানে এগিয়ে আসে। তার অনুমান সত্যি হয়।
উঁচু পাড় ঘেরা একটা পুকুর। পুকুরে নামার ঢালু জায়গা আছে। অনেক গোষ্পদের চিহ্ন দেখে গাভী বুঝতে পারে যে, মাঠে চরতে চরতে পিপাসা পেলে গরু-ছাগল এই পুকুরে নেমে জলপান করে।
গাভী আর বাছুর দু’জনেই পুকুরে নেমে জলপান করে। তারা জমিতে উঠে কিছুক্ষণ আরামে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তারা মনোযোগ দিয়ে সবুজ ঘাস খেতে শুরু করে।
সূর্য ডুবে গেলে মাঠের গরু-ছাগল যে যার গোয়ালে ফিরে যায়। গাভী মুখ তুলে তাদের চলে যাওয়া দেখে। তার গোয়ালে ফেরার তাড়া নেই। যেদিক থেকে তারা এসেছে, সেদিকে একটু তাকিয়ে থাকে।
গাভীর গায়ের রঙ লাল হলেও বাছুরের গায়ের রঙ সাদা। বাছুরটা মাঝে মাঝে গাভীর দুধ খায়, মাঝে মাঝে মুখ নামিয়ে কিছু ঘাস খায়। মাত্র ছ-মাসের বাছুর সে।
পুকুরপাড়ের বড় বাবলাগাছের ডালে অনেক শালিখপাখি এসে জটলা করে। পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত গেলে পুব আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সন্ধে হলেও তাই অন্ধকার ঘনায় না।
পুকুরের কাছের জমিতে শুয়ে গাভী বিশ্রাম নেয়। সে চোখ বন্ধ করে জাবর কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়ে। তার কোলের কাছে বাছুরটাও শুয়ে ঘুমুতে থাকে।
মাঝ রাতে একটা শেয়াল এসে বাছুরের গা শুঁকতে থাকে। বাছুরের ঘুম ভেঙে যায়। সহজাত বোধে সে জানে যে, শেয়াল তার শত্রু। একবার ‘ব্যাঁ’ শব্দ করে সে উঠে দাঁড়ায়।
গাভীর ঘুম ভেঙে যায়। ত্বরিতে সে উঠে দাঁড়ায় শিং বাগিয়ে একবার ‘ফোঁ’ শব্দ করতেই শেয়ালটা ছুটে পালিয়ে যায়।
জায়গাটাকে নিরাপদ বলে মনে হয় না গাভীর। গাভী ঠিক বুঝতে পারে যে, তারা পশ্চিমদিক থেকে এসেছিল। তাই বাছুরকে সঙ্গে নিয়ে সে পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটার পর তারা একটা প্রশস্ত পিচ-ঢালাই রাস্তায় ওঠে। নির্জন রাস্তা। তারা নির্বিঘ্নে হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে একটা-দুটো কুকুর ডেকে ওঠে।
গাভী আর বাছুর তিনখানা গ্রাম আর দু-খানা মাঠ পার হয়ে আসে। সকাল হলে তারা একটা তৃণভূমিতে চরতে থাকে। মাঠের এদিকে ওদিকে তিনখানা পুকুর। তাদের জলপানের কোনও অসুবিধা হয় না। বাছুরের যখনই ইচেছ হয়, মায়ের দুধ পান করে।
একটু বেলা হলে মাঠে অনেক গরু, ছাগল আর ভেড়া চরতে আসে। দুপুরে গৃহস্থরা যে যার গরু, ছাগল আর ভেড়া তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। গাভী আর বাছুর একটা বাবলাগাছের ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নেয়। বিকালে আবার তারা অন্যান্য গরু- ছাগলের সঙ্গে চরে বেড়ায়।
তিন দিন মাঠে-ঘাটে থাকার পর গাভী ভাবে যে, এভাবে মাঠে-ঘাটে থাকায় সুখ নেই। কোনও গৃহস্থের গোয়ালে থাকাই নিরাপদ। বাছুরকে সঙ্গে নিয়ে গাভী রাঙাবেলে গ্রামের সন্তোষ প্রামাণিকের উঠোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। সন্তোষ প্রামাণিক লাঠি নিয়ে তাদেরকে তাড়া করে।
চার গৃহস্থের বাড়ি থেকে তাড়া খেয়ে গাভী আর বাছুর বিদুর বাগানির উঠোনের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিদুরের বারো বছর বয়সের ছেলে কঙ্কন বাছুরটাকে দেখে খুব খুশি হয়। বাবা-মার মুখে সে শুনেছে যে, আগে তাদেরও বলদ ছিল, গাভী-বাছুর ছিল। এখন গাভীও নেই, গোয়ালও নেই। তার ইচেছ হলে, সে মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের বাছুরকে ধরে একটু আদর করে।
বিদুর বাগানি রাঙাবেলের ডাকঘরের পোস্টম্যান। তার দু-বিঘা জমি আছে। জমিতে সে ধান আর মুগকলাই চাষ করে। কঙ্কন ক্লাস সিক্সে পড়ে। চাষের সময় সে বাবা-মার সঙ্গে জমিতে কাজ করে। গাছপালা, পশুপাখির প্রতি তার সহজাত ভালোবাসা- মমতা। পথে-ঘাটে বাচ্চা কুকুর-বিড়াল দেখলেই সে কোলে তুলে নিয়ে একটু আদর করে। প্রমীলার বকাবকির ভয়ে সে কোনওদিন বাড়িতে কুকুরছানা নিয়ে আসতে পারে না।
—রে রে? ঝুনুসোনা! মানাভানা।
বলতে বলতে কঙ্কন বাছুরের কাছে আসে। সে মাটিতে উবু হয়ে বসে। বাছুরের গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে।
বাছুরকে আদর করতে দেখে গাভী কঙ্কনের পিঠ চেটে দেয়। পিঠে সুড়সুড়ি অনুভব করে কঙ্কন খিলখিল করে হাসে। সে যত তার পিঠ সরিয়ে নেয়, গাভী তত সরে এসে তার পিঠ চাটে।
প্রমীলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠোনে আসে। গাভী আর কঙ্কনের রকম দেখে সে হাসে; কঙ্কনকে জিজ্ঞাসা করে, কাদের বাছুরকে ধরে আদর করছিস?
—আমি চিনি না। আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, একটু আদর করছি।
ভালো করে দেখে প্রমীলা বলে, এ গাই-বাছুর আমাদের রাঙাবেলের কারও নয়।
বাছুর আর গাভীকে আদর করা হয়ে গেলে, কঙ্কন ঘরে আসে। অঙ্ক কষে।
আধ ঘণ্টা পরে। প্রমীলা সংসারের কাজ সেরে বাইরে আসে। গাভী আর বাছুরকে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে; সে অবাক হয়ে বলে, কাদের তোরা! এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?
একটু থেমে, চিন্তা করে প্রমীলা বলে, বুঝেছি। তোরা পথ হারিয়ে ফেলেছিস!
প্রমীলার মুখের দিকে তাকিয়ে গাভী একবার ডাকে, হাম্বা!
প্রমীলা যেন ‘মা’ ডাক শুনতে পায়। স্নেহ-মায়ায় তার অন্তর বিগলিত হয়। সে গাভীর কাছে আসে, গাভীর গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে।
প্রমীলা কার সঙ্গে কথা বলছে, জানার কৌতূহল নিয়ে কঙ্কন আবার বাইরে আসে। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, মা! তুমিও গাভীকে আদর করছ?
কী সুন্দর গাই-বাছুর। দেখলে মায়া হয়!
—মা! গাভীকে জল খেতে দেব?
—দে!
কঙ্কন বালতিতে করে জল নিয়ে আসে। গাভী আর বাছুর সাগ্রহে জলপান করে। কঙ্কন সোৎসাহে এক ঝুড়ি ঘাস কেটে নিয়ে এসে গাভী আর বাছুরকে খেতে দেয়।
—সন্ধে হয়ে আসছে। গাই আর বাছুর কোথা যাবে? কারও বাগানে ঢুকলে, মারবে।
মনে মনে এই ভেবে প্রমীলা উঠোনের পিয়ারা গাছে গাভীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। বাছুরটা গাভীর কাছে থাকে।
চিঠিপত্র বিলি করে সন্ধের মুখে বিদুর বাড়ি ফেরে। সে উঠোনের পিয়ারা গাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা গাভীকে দেখে খুব বিস্মিত হয়। প্রমীলার মুখে সব কথা অবগত হয়ে সে একটু চিন্তিত হয়। এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে সে রাঙাবেলের পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে আসে।
পঞ্চায়েত সদস্য তাকে আশ্বস্ত করতে বলে, আমরা তোমার পাশে আছি। কেউ তোমাদেরকে চুরির দায়ে ফেলতে পারবে না। যতদিন না গাভীর মালিক এসে গাভীকে নিয়ে যায়; ততদিন তোমরা পালন করো। দুধ খাও।
বিদুর বাড়ি ফিরলে প্রমীলা দুধ দোহন করে। দু-লিটার দুধ দেয় গাভী।
বিদুরের বাড়ির সকলে মিলে গাভী আর বাছুরের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। গাভী আর বাছুরকে খড়, ঘাস, সবুজ শাক, খইল, ডাল, ভাতের ফেন ইত্যাদি খেতে দেয়।
রাঙাবেলেতে প্রবোধ মল্লিকের পনীর কারখানা। প্রমীলা পনীর কারখানায় দুধ বিক্রি করে। সে দু-বেলা দু-বালতি ছানার জল নিয়ে এসে গাভী-বাছুরকে খাওয়ায়।
সাত দিন, তারপর এক মাস, তারপর এক বছর অতিবাহিত হয়। বিদুরের বাড়িতে কেউ এসে গাভীর খোঁজ করে না। গাভী আর বাছুরের সুস্বাস্থ্য হয়েছে। সত্যবান আদক এসেও গাভীকে চিনতে পারবে না।
গাভী সকালে-বিকালে ছ-লিটার দুধ দেয়। প্রমীলা পাঁচ লিটার দুধ বিক্রি করে। সকলের খাওয়ার জন্য বাড়িতে এক লিটার দুধ রাখে।
প্রতিবেশিনীরা বিদুরের প্রশংসা করে বলে, তুমি ভাগ্যবান। তাই ভগবতী নিজে তোমার বাড়িতে এসেছে।
বিদুরের বাড়ির সকলে গাভী আর বাছুরের খুব যত্ন নেয়। গাভীর দুধ বিক্রির টাকায় ধীরে ধীরে তাদের সংসারের সমৃদ্ধি ঘটতে থাকে।