ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
একদা এক কালে কোনো এক দেশে বিজয়পুর নামক এক সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিল। সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন জগদিন্দ্রদেব। তাঁর তিন ছেলে উত্তম, মধ্যম এবং অধম। তিন ভাই হওয়া সত্ত্বেও তিনজনের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বড়ো ছেলে উত্তম ছিল সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত এবং অত্যন্ত দাম্ভিক। সে তলোয়ার চালাতে ছিল পটু। প্রজারা তাকে ভয় ও সম্মান দুই-ই করত। মধ্যম ছিল দাদার মতোই সাহসী ও সুপণ্ডিত। কিন্তু শাস্ত্রের চেয়ে তার অস্ত্রের ঝোঁক বেশি। সে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বর্শা যুদ্ধে তার জুড়ি মেলা ভার। অধম ছিল সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির। সে বেশি শাস্ত্র পাঠ করত না। এমনকি তীর ধনুক ছাড়া অস্ত্র শিক্ষাতেও ছিল অপটু। কিন্তু সে পিতা, মাতা এবং প্রজাদের অতিশয় ভালোবাসত। তিনজনের প্রকৃতি অন্যরূপ হওয়ায় রাজা বুঝতে পারতেন না কে তাঁর পরে সিংহাসনের অধিকারী হবে।
একদিন তিনি এক উপায় বের করলেন, তিন পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘তোমাদেরকে নিজ নিজ সাহস ও বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। তাই আমি ঠিক করেছি যে তোমরা তিন দিকে বেরিয়ে পড়ো এবং এক বছর পরে ফিরে এসে নিজ নিজ কর্মকান্ডের কথা বলবে’।
তিনজনে বেরিয়ে পড়ল। উত্তম দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে একমাস পর এক রাজ্যে পৌঁছাল। সেখানে সে একটি প্রৌঢ় মুসলিম লোককে খাবার বিক্রি করতে দেখে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাইয়া! দুটি সন্দেশ দাও, খাই’। লোকটি মিষ্টি আনতে আনতে সে কী করবে ভাবছিল হঠাৎ সে শুনল এক বৃদ্ধ গল্প করছে যে তার ভাই শুশনি পাহাড়ের অমূল্য গুপ্তধন আনতে গিয়ে নিহত হয়েছে। উত্তম সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা এই পাহাড়টি কোথায়?’ সেই লোকটি বলল, ‘শুশনি পাহাড়? সে তো কিছু দূরেই অবস্থিত। তবে সেখানে ভুলেও যেও না’। উত্তম তবুও গেল। বৃদ্ধের কথানুযায়ী পাহাড়ে পৌঁছে সে দেখল, পাহাড়ের গায়ে লেখা আছে, ‘সাবধান! সতর্ক থেকো’। উত্তম ঢুকল। হঠাৎ দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। বীর উত্তম সহজে ডরে না। কিছুটা এগিয়ে সে মুখোমুখি হল এক পথের সাথে যেখানে রয়েছে অজস্র কাঁটা। সে এগোতেই আর এক বিপদ এল। কোথা থেকে তীর বর্ষণ হতে লাগল। সে বুঝল তাকে এসব কাটিয়ে উঠতেই হবে। সে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। সে অসংখ্য আঘাত পেল, থামল না। হঠাৎ সে দেখল তীর বর্ষণ বন্ধ হয়েছে এবং কাঁটার পথও নেই। তবে একটি পাথর দেখতে পায় সে। কাছে যেতেই দেখল একটি বাক্স, যেখানে সোনা। সে বুঝল, সে সফল হয়েছে। সেই রাজ্যে ফিরে কিছু মাস থেকে ফেরার যাত্রা শুরু করল।
মধ্যম পশ্চিমে তিনমাস হাঁটার পর উদয়নগর পৌঁছাল। সেখানে সে পৌঁছেই শুনল বহু লোক এক জায়গায় যাচেছ। একজনকে জিজ্ঞাসা করে সে জানল, রাজপ্রাসাদে এক দারু পালোয়ান-এর সাথে কেউ কুস্তিতে এঁটে উঠতে পারছে না। সেই সেখানে গেল এবং নিজ পরিচয় দিয়ে দারুকে কুস্তিতে আহ্বান করল। দারু অত্যন্ত হেসে সায় দিলো। তবে সে জানত না মধ্যম কত ক্ষমতাবান। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই দারুকে প্রবল ভাবে পরাজিত করলো এবং এই কান্ড করে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করল।
এদিকে অধম প্রায় সাত মাস ধরে পূর্ব দিকে যেতেই থাকে। সে পাহাড়, সমুদ্র প্রভৃতি পার করে এক গ্রামে পৌঁছাল। পৌঁছেই সে অবাক। দেখল চারিদিকে শুধু হাহাকার। মানুষের মৃত্যু ঘটছে, বাচ্চারা অনাহারে মারা যাচ্ছে। তাকে রাজ পোশাকে দেখে সবাই তার কাছে এসে সাহায্য চাইছে, এসব তাকে অন্তরে প্রবল রূপে ব্যথিত করল। সে তার সমস্ত গয়না, মুকুট, আংটি দান করল। এতে কিছু মানুষের সাহায্যে লাগল বটে কিন্তু অনাহারের রোগ নিরাময় হয় না। বিকাশ নামে এক ছেলে বলল, ‘এ গ্রামের শেষে এক গাছে অদ্ভুত ফল আছে যেটি খেলে সব রোগ ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু সে গাছের ফলে কেউ লক্ষ্যভেদ করতে অক্ষম কারণ সেটিকে চোখে বেঁধে লক্ষ্য স্থির করতে হবে’। অধম বলল, ‘সেই ফল-ই আমি আনবো, চলো, পথ দেখাও’। সে সেই গাছের কাছে পৌঁছে কাপড় বেঁধে নিজ তীর ধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদ করতেই একটি ফলের সাথে সব ফল পড়ে গেল। সেসব গ্রামের মানুষ খেতেই সবাই সুস্থ হয়ে উঠল এবং অধম বাড়ি ফিরে গেল।
বিজয়পুর ফিরে যে যার কর্মকান্ডের কথা রাজাকে শোনায় এবং বলে ‘আমি শ্রেষ্ঠ’। রাজা কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, ‘উত্তম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। মধ্যম উদয়নগরে আমার রাজ্যের নামোজ্জ্বল করেছে। কিন্তু অধম বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে নিজের অলংকার ও মুকুট দান করে এবং নিজের লক্ষ্যভেদের দ্বারা। তাই আমি চাই যে অধম-ই সিংহাসনে বসুক। কারণ সেবাই আসল ধর্ম’।