ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
আমাদের দেহে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কর্ণ বা কান হল অন্যতম। কানের সাহায্যে আমরা শুনতে পাই। কিভাবে শুনতে পাই সে কথা বলার আগে কানের গঠন প্রণালী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। মাথার দুপাশে পাতলা হাড় আর মাংস দিয়ে ঢাকা যে দুটো জিনিষ রয়েছে যাকে সোজা বাংলায় বলি কান তা আমাদের আসল কান বা শোনার যন্ত্র নয়। কানের তিনটি অংশ— বাহির-কান, মধ্যকান এবং ভিতর-কান। বাহির-কানটা কি দিয়ে তৈরী তা জেনেছ। মধ্য-কানে আছে পাতলা চামড়ার একটা পর্দা। আর পর্দাটার ঠিক পিছনে লাগানো রয়েছে তিনটে ছোট হাড়। ভিতর কানে আছে আধখানা চাঁদের মত বাঁকা তিনটে ফাঁপা পাতলা হাড়ের নল যার ভিতর থাকে এক রকম তরল পদার্থে পূর্ণ আরও সেখানে থাকে কতকগুলো স্পর্শকাতর কোষ এবং সেই কোষগুলোর সঙ্গে লাগানো থাকে অসংখ্য স্নায়ু। সেই স্নায়ু শেষ পর্যন্ত এসে মিশেছে মস্তিষ্কে।
আমরা কিভাবে শুনতে পাই এবার সেই কথায় আসা যাক। নিশ্চয় তোমরা লক্ষ্য করেছ পুকুরের শান্ত জ্বলে একটা ঢিল ফেললে জলে কিরকম ছোট ছোট ঢেউ ওঠে আর সেই ঢেউ ক্রমশঃ বড় হতে হতে গোল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর মিলিয়ে যায়। আমরা বাতাসের সমুদ্রের মধ্যে বাস করছি। সেই বাতাসের মধ্যে কথা বললে বা কোনও শব্দ হলে জলের ঢেউয়ের মত বাতাসে ঢেউ ওঠে। ক্রমশঃ সেই ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বাতাসের এই ঢেউ আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। বাতাসে যে ঢেউ উঠল তা ভাসতে ভাসতে তোমার কানের গর্তের ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়ে আছাড় খেলো কানের ভিতরে লাগানো পর্দাটায়। বাহির কান এই বাতাসের ঢেউগুলোকে ধরে কানের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। আমরা কান নাড়তে পারি না বটে কিন্তু লক্ষ্য করেছ তা জন্তুরা যেমন গরু, কুকুর এরা কি সুন্দর কান নাড়তে পারে। দূরে কোথাও কোনো শব্দ হলে দেখবে ওরা কান দুটো খাড়া করে শব্দটা শোনবার চেষ্টা করছে। তার মানে বাহির কানটাকে এমনভাবে খাড়া করে রাখছে যাতে শব্দের ঢেউগুলো ওখানে আঘাত খেয়ে কানের ভিতর ঢুকে পড়ে মধ্য-কানের পর্দায় ঠিকমত ধাক্কা খায়।
শব্দতরঙ্গ যখন কানের ভিতরকার পর্দায় আঘাত করে তখন সেই পর্দাটা অনুরূপ ভাবে কেঁপে ওঠে। ঠিক যেমন বারোয়ারী পূজামণ্ডপে ঢাকীর পাশে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনতে গেলে তোমার বুকের মধ্যে ঢাকের কাঠির আওয়াজ শুনতে পাও। কানের পর্দাটা কাঁপবার সঙ্গে সঙ্গে পর্দার পিছনে লাগানো সেই ছোট তিনটে হাড়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। এই হাড় তিনটে পর্দার কাঁপুনিটাকে অন্ততঃ দশগুণ বাড়িয়ে ভিতরকার কানে পাঠিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি ভিতর-কানে তিনটে ফাঁপা পাতলা হাড়ের নলের মধ্যে থাকে এক রকম তরল পদার্থ। দশগুণ বর্দ্ধিত পর্দার কাঁপুনি এবার ধাক্কা দিল ভিতর কানের তরল পদার্থকে। ফলে ঐ তরল পদার্থে ঢেউ উঠল ঠিক যেমন জোরে বাতাস দিলে পুকুরের শান্ত জলেও ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। এইবার ঐ ঢেউ এসে আছাড় খেলো ওখানকার স্পর্শকাতর কোষগুলোর ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সেই স্পর্শকাতর কোষগুলো কেঁপে উঠল। কোষগুলো কাঁপার সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুভূতি কোষের তলায় লাগানো অসংখ্য স্নায়ু দিয়ে চলে গেল মস্তিষ্কে টেলিফোনের মত। মস্তিষ্কে যেখানে শোনার কেন্দ্র থাকে সেই কেন্দ্রে গিয়ে সাড়া জাগালো আর অমনি তুমি শুনতে পেলে। এবার দেখলেত কত কান্ড হবার পর তুমি একটা শব্দ শুনতে পাও। অথচ দেখ এত কান্ড ঘটতে এক মুহূর্ত সময় বেশী লাগে না। শব্দ কানের পর্দাটাকে কাঁপানো মাত্র নিমেষের মধ্যে সবকিছু ঘটে যায়।
সব শব্দ যেমন এক ধরণের নয় তেমনি স্পর্শ-কাতর কোষগুলোরও শ্রেণী বিভাগ আছে। আস্তে শব্দ হলে যে কোষগুলো কাঁপবে জোরে শব্দ হলে সে কোষগুলো কাঁপবে না আবার জোরে শব্দ হলে যারা কাঁপবে আস্তে শব্দ হলে তাঁরা কাঁপবে না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। ধর হারমোনিয়ামের কথা। যখন যে রীডের সুর বাজাও তখন সেটা ভিন্ন যেমন অন্য রীডের সুর বাজে না তেমনি স্পর্শকাতর কোষগুলোও যেন এক একটি রীড। সেইজন্য জোরে শব্দ হলে যারা সাড়া জাগাবে আস্তে আস্তে তারা চুপ থাকবে।
যখন দু-কানের গর্ত আঙুল দিয়ে চেপে ধর তখন কানের মধ্যে কিরকম গুর গুর শব্দ হয়— লক্ষ্য করেছ কি? তোমরা বল রাবণের চিতা জ্বলছে। আসলে কি হয় জান? কানের পর্দার পিছনে যে বাতাস রয়েছে আর পর্দার বাহিরে যে বাতাস আছে সেই দুটোর চাপ মিলে কানের পর্দাটাকে টান করে রেখেছে। যদি কানে আঙুল দিয়ে বাহিরের বাতাসের চাপ বন্ধ করে দাও তাহলে ভিতরের বাতাসের চাপটা পর্দাটার ওপর খুব জোরে পড়বে তার ফলে পর্দাটা কাঁপতে থাকবে। আর সেই কাঁপুনির ফলে ঐ রকম গুর গুর শব্দ হতে থাকবে।
যারা কানে একেবারেই শুনতে পায় না বুঝতে হবে হয় তাদের কানের পর্দাটা খুব মোটা বলে সেটা কাঁপে না কিংবা কানের ভিতরের ছোট ছোট হাড় গুলোর কিছু গন্ডগোল আছে। আর একটা জিনিষ তোমরা হয়ত লক্ষ্য করে থাকবে যারা জন্ম থেকে কালা হয় তারা সবাই বোবা মানে কথা বলতে পারে না এর কারণ কি জান? যারা জন্ম থেকেই শুনতে পেল না শব্দ কি জিনিষ তারা কেমন করে শব্দ বার করবে। শুনতে না পাওয়ার জন্য তারা উচ্চারণও জানে না ফলে কথা বলতে পারে না। আর গলার স্বরযন্ত্রের অব্যবহারের ফলে সেটাও ক্রমশঃ অকেজো হয়ে পড়ে ফলে বোবা হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ যারা অন্ধ তারা চোখ ফিরে পাচ্ছে আর যারা কালা তারাও শুনতে পাচ্ছে। কানে যারা কম শোনে এক রকম যন্ত্র ব্যবহার করার ফলে তারাও স্বাভাবিকভাবে শুনতে পায়। এই যন্ত্রটায় থাকে রিসিভার আর এমপ্লিফায়ার। ঠিক যেমন মাইকের সামনে কথা বললে সেই কথা বহু গুণ জোর হয়ে এমপ্লিফায়ারের ভিতর দিয়ে শুনতে পাওয়া যায় তেমনিভাবে ঐ যন্ত্রটাও কাজ করে। ঐ যন্ত্রেও রিসিভারটা ব্যাটারীর সঙ্গে আটকানো অবস্থায় বুক পকেটের মধ্যে থাকে আর সঙ্গে লাগানো তারটা এসে মিশেছে কানের গর্তের ভিতর আটকানো এমপ্লিফায়ারে। শব্দ রিসিভারের মধ্য দিয়ে এমপ্লিফায়ারে যায় ও বহুগুণ হয়ে কানের ভিতরে পর্দাটাকে কাঁপিয়ে নিয়ে শুনতে সাহায্য করে। সম্প্রতি সোভিয়েট বিজ্ঞানীরা এক অভিনব চশমা আবিষ্কার করেছেন। এই চশমার হাতলের মধ্যে থাকে ছোট্ট একটা ব্যাটারী যেটা এক সপ্তাহ অন্তর রি-চার্জ করে নিতে হয়। ব্যাটারীর সঙ্গে রিসিভারও বসানো থাকে ঐ একই জায়গায়, আর সুক্ষ্ম তার দিয়ে আটকানো থাকে একটা এমপ্লিফায়ার যেটা কানের গর্তের মধ্যে বসানো থাকে।
যারা জন্ম থেকেই শুনতে পায় না কানের পর্দাটা ফেটে যাওয়ার জন্য কিংবা মোটা হয়ে যাবার বা ছোট হাড়গুলোর গণ্ডগোলের জন্য তাদের শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার এক নতুন চিকিৎসার উপায় আবিষ্কার করেছে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। তাঁরা রোগীর দেহের যে কোন স্থান থেকে পাতলা চমড়া কেটে এনে কানের ঐ পর্দাটাকে বদলে দিতে পারেন আর হাড়ের গণ্ডগোল হলে প্লাস্টিকের টিউব বসিয়ে সেই হাড়ের কাজ করাতে পারেন।
কানের আর একটা কাজ হল ব্যালান্স বা ভারসাম্যের কাজ। ওজন দাঁড়ির যেমন যেদিকে বেশী ওজনের বাটখারা থাকে সেদিকটা ঝুলে পড়ে তেমনি একদিককার কানের ভিতরের যন্ত্রটা বার করে নিলে মাথাটাও একদিকে হেলে পড়বে আর দুদিকেওর কানের যন্ত্রটা বার করে নিলে কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
ছোটদের কথা, বর্ষ-১৫, সংখ্যা-৪+৫, ফেব্রুয়ারী-মার্চ ১৯৮৭ থেকে পুনর্মুদ্রিত