ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
এইমাত্র যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হল। টুসি প্রথম হয়েছে। সহজ তো নয়, প্রতিযোগিতায় তাদের গ্রুপে জেলার সমস্ত বিদ্যালয়ের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেছে। ঘোষণা শুনে টাবলুমামার হাতে তালি আর শেষ হচ্ছে না। মা টুসিকে জড়িয়ে ধরল। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বিদ্যালয় থেকে কয়েকজন দিদিমণি মাস্টারমশাই এসেছেন। তারাও টুসিকে আদর করে গেলেন। টুসি বিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এবার তাকে রাজ্য স্তরে যেতে হবে, সেইমত যেন প্রস্তুতি নেয়, বলে গেলেন। আর টুসি আদর করছে তার মনের মিতাকে। এরপর পুরস্কার নিতে বেলা হয়ে যাবে। টুসি আনন্দে ভাসতে ভাসতে মা বাবা, মামার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে চলল।
প্রথম স্তরে স্কুলের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে টুসি গিয়েছিল ব্লক অফিসে। সেখানেও প্রথম হয়ে তারপরে গেছে বিভাগীয় স্তরে, রানাঘাটে। সব শেষে আজকে এসেছে জেলার স্তরে, নদীয়া জেলার সদর শহর, কৃষ্ণনগরে। যেখানেই গেছে, টুসি রজতকে নিয়েই গেছে। রজত হল টুসির ‘মিতা পুতুল’। রজত নামটা টুসির দেওয়া। যে সে পুতুলতো নয়, যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার পিছনে ওর যে বিরাট অবদান।
রেস্টুরেন্টে চাওমিন খেয়ে টুসি বাইরে এসে কথাগুলো ভাবছিল। ভাবতে গিয়েই এবছর জন্মদিনের কথা মনে এল। ওই দিন সন্ধ্যায় কি মজাই না হয়েছিল। টুসির বন্ধুরা সবাই এসেছে। তাছাড়া চুমকি মাসি, টাবলুমামা, আরো অনেকে এসেছিল। সবাই অনেক অনেক গিফট দিল। টাবলুমামা এই পুতুলটা দিয়ে তাকে বলেছিল, পুতুলটা তোর মনের কথা জেনে যাবে, সেইমতো তোকে সাহস যোগাবে। সব সময় কাছে কাছে রাখবি। মা তো কথাগুলো শুনেই হেসে খুন! চুমকি মাসিও মুচিক মুচকি হাসছিল।
টুসির অনেক পুতুল আছে। তারা কেউ একই কথা বারবার বলে, কেউ শুইয়ে দিলে ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ হাসতে পারে, কেউ হাত পা ছুড়ে নাচতে পারে, ব্যস ওটুকুই। টুসির ইচছা ছিল ওই দিনই ওকে নিয়ে খেলা করে। কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ার সম্ভব হল না। ঘরে দুটো আলমারি আছে, দুটোই তালা দেওয়া। কোন একটায় পুতুলটা ছিল। মায়ের কাছে চাইতে গেলে বকা খেতে হবে। পরের দিন সকালে আবার ইস্কুল। মন খারাপ নিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন, শুক্রবার, বাড়ি ফিরতে সেই দুপুর। বিকেলে ম্যাম পড়াতে এলেন। তারপর বাবার কাছে তাকে অঙ্ক করতে বসতে হল। ওই দিন রাতেও টুসি অনেকক্ষণ ছটফট করেছে। পরের দিন শনিবার, স্কুল বন্ধ ঠিকই, কিন্তু সকালে পড়া করে তারপর গান শিখতে যাওয়া ছিল। শেষমেষ বিকেলে সময় পাওয়া গেল। মা সময় মত নিজেই বের করে দিয়ে গেল।
ও বাবা এটা তো একটা ছেলে পুতুল! দেখতে রজতের মত। এ বছর ফাইভে উঠে রজত স্কুল ছেড়ে গেল। ওর বাবা দিল্লিতে বদলি হয়েছেন। টুসির সঙ্গে রজতের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। টুসি খেলাধুলা একদম পারে না, দৌড়তে তো নয়ই। তাই তাকে কেউ খেলায় নেয় না। রজত টুসির সঙ্গে খেলত। ওরা ক্লাস রুমে এক বেঞ্চে বসত, স্কুল বাসে যাতায়াত করত পাশাপাশি বসে। কিন্তু পুতুলটা তো নড়াচড়া করছে না, কথাও বলছে না! ওমা যেই টুসি এমন ভাবছে, মনে হল ও কিছু বলছে। ‘‘কী গো দু-দিন ধরে যে আলমারিতে পড়ে আছি, আমার যে কী কষ্ট হচ্ছিল, তোমায় কী বলবো! তুমি তো ব্যস্ত ছিলে। তোমার কিন্তু আমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই না?’’
‘‘ওমা তুমি তো সবই সত্যি বলছ, ঠিক রজতের মত! আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, তুমি আমার মনের মিতা হলে। কিন্তু তোমার নাম তো একটা দিতে হয়। আচছা তোমার নাম যদি রজত রাখি তোমার পছন্দ হবে?’’ ‘‘কেন হবে না, আমি তাতেই খুশি। তুমি আমায় ওই নামেই ডাকবে। আচ্ছা বল তো তুমি খেলতে যাও না কেন? অন্য বন্ধুরা তোমাকে বাদ দিলেও জোর করে খেলবে।’’ ‘‘ও বাবা তুমি দেখি এটাও জানো। আসলে বেশি দৌড়দৌড়ি করলে আমার শরীর খুব খারাপ লাগে, জানো। আমি বসে বসে খেলতে ভালোবাসি।’’
‘‘দেখো টুসি, তুমি পড়াশোনায় ভালো। প্রতি বছর প্রথম হও। কিন্তু খেলাধূলা তোমায় করতেই হবে। শরীর ভালো না থাকলে জীবনে তুমি কিছুই করতে পারবে না। ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ কথাটা তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। সেটা মান না কেন? স্কুলে টিফিন টাইমে রজত আর তুমি খেলতে তাই না! এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকব। কিন্তু আমি তো স্কুলে যাব না। বাড়িতেই সেটা হতে পারে। ‘‘ওমা তুমিতো ডাক্তারবাবুর মত কথা বলছ। কিন্তু আমি কি করব? আমি যে শরীরচর্চা করার সময় পাই না। সে যাই হোক, তোমার সঙ্গে তো আমার শুধু শনিবার ছাড়া আর দেখাই হবে না। ওই একটা দিন বিকেলে আমি যা একটু ছুটি পাই।’’
‘‘আমি বলি শোনো। তুমি সকালে ঘুম থেকে ওঠো সাতটায়, ওটা ছটায় করে নাও বুঝলে। কয়েকদিন একটু অসুবিধা হবে। তারপর দেখবে তোমার কেমন ভালো লাগবে। তোমাকে আমি যোগব্যায়াম করতে বলছি।’’
‘‘ও হরি, যোগব্যায়াম তো আমি শিখেছি। ডাক্তারকাকু বাবাকে বলেছিল আমি যেন যোগব্যায়াম শিখি। সেইমত বাবা আমাকে গোপেনকাকুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। গোপেনকাকু আমাকে অনেকগুলো আসন শিখিয়েছেন। জান কী কী আসন? পদ্মাসন, ভুজঙ্গাসন, বজ্রাসন এমন আরো কত আসন আমি জানি।’’
‘‘হ্যাঁ সে আমি জানি। সেগুলো কর না বলেই তো শরীর ভালো হচ্ছে না। এখন থেকে ছটায় উঠে তুমি আসন করবে। আমি পাশেই থাকব। কদিন করে দেখো, যা উপকার পাবে, তুমি অবাক হয়ে যাবে। এই যে তুমি খেলতে পার না, গান করতে বসে ঝিমিয়ে যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ সেই যে টুসি যোগব্যায়াম শুরু করেছিল, রোজ সকালে উঠে সে গোপেনকাকুর বলে দেওয়া আসনগুলো নিয়মিত করতে লাগল। মাস খানেক যেতে না যেতে টুসি টিফিনবেলা খেলতে গেলে সবাই ওকে টানাটানি করে। রজত চলে যাবার পর তার মন খুব খারাপ হয়েছিল। মনের মিতাকে পেয়ে তার দিন ভালো কাটছে।
আর কী আশ্চর্য কয়েকদিন পর স্কুল থেকে জানানো হলো যোগব্যায়ামের প্রতিযোগিতার কথা। ক্লাসের ম্যাম তার নামটা দিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে এসে বলতেই বাবা গোপেনকাকুর কাছে তাকে আবার নিয়ে গিয়েছিল। গোপেনকাকু সেই মতন তাকে নতুন আসনগুলো ভালো করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। টুসি রোজ সেগুলো অভ্যাস করত।
টুসি রেস্টুরেন্টের বাইরে রজতকে কোলে নিয়ে গল্প করছে। কাছের টেবিলে মা-বাবা, টাবলু মামা চা খেতে খেতে কথা বলছে। টুসিকে পুতুলটার সঙ্গে কথা বলতে দেখে মা মিটিমিটি হাসছে। টাবলুমামাও হঠাৎ করে, কী জানি কেন, হেসে উঠল। বাবা বলল, ‘‘পুতুলটা পেয়ে টুসির খুব উপকার হয়েছে। ওটা পাওয়ার পর থেকে রোজ ভোরে উঠে আসন করা শুরু করেছে। আগে বকাবকি করেও ওকে সাতটার আগে বিছানা থেকে তোলা যায়নি।’’ মা মাথা নাড়ল।
বাবার কথা শুনে টুসি অবাক। টাবলু মামা বলেছে বলেই নয়, পুতুলটা হাতে নিলে টুসি যে রজতকে দেখতে পায়, সেটা তো বাবা জানে না। রজত হল টুসির প্রাণের বন্ধু, খেলার সাথী। ফলে টুসি যখন যা ভাবে রজত সব জেনে যাবেই। তখন দুজনের কথা বলতে অসুবিধা হবে কেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মাইকে ঘোষণা হল টুসিকে মঞ্চে যেতে হবে।
বাবা-মা সবাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। টুসি মায়ের কাছে মনের মিতাকে দিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখল, মা মিতাকে আদর করছে। টুসির খুব ভালো লাগল। টুসি যে মিতাকে ভালোবাসে। কাজেই মিতাকে কেউ ভালোবাসলে টুসির তো ভালো লাগবেই।