ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
অনেকদিন আগের কথা। বর্ধমান জেলার রাইপুরে বিকাশ নামের একজন লোক ছিল। বাজার থেকে সব জিনিসপত্র কম দামে কিনে চড়া দামে বিক্রি করাই তার কাজ। তার সংসারে ছিলেন তার বৃদ্ধা মা, তার স্ত্রী ও এক পুত্র সন্তান। এই কাজ করার জন্য তার অনেক শত্রুও ছিল। তার বিশাল বড়ো একটা গুদাম ঘর ছিল, সেখানে বিকাশ সব মাল মজুত করে রাখত।
বিকাশের এই ব্যবসার জন্য তাকে কেউ পছন্দ করত না। অন্যদিকে স্থানীয় মানুষদের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বাজারে কোনো জিনিস নেই— সব বিকাশ কিনে নিয়েছে। আর বিকাশের কাছে সেসব জিনিসের যা দাম, হাত দেওয়া মুশকিল। সমাজের তখন দুটি ভাগ ছিল— উঁচু তলার মানুষ— যারা লোক ঠকিয়ে বা লোকের সর্বনাশ করে বড়োলোক হয়েছে ও নীচু তলার মানুষ— যারা খেটে পয়সা উপার্জন করে। কিন্তু সেই পয়সাই কেড়ে নেয় উঁচু তলার মানুষরা। তাদের উপর অত্যাচার করে। ফলে নীচু তলার মানুষরা গরীবই থেকে যায়। বিকাশের কাছে জিনিস কিনতে পারে শুধু সেই উঁচু তলার বাবুরা। বিকাশ দিন-দিন আরও বড়োলোক হতে থাকে। আর একদিকে গরীব মানুষগুলো না খেতে পেয়ে মরতে থাকে। বিকাশের দিন-দিন লোভও বাড়তে থাকে। একবার সে ঠিক করে আলু মজুত করে রাখবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সে কৃষকদের কাছ থেকে সব আলু কিনে। আলু চট করে পচে যায় বলে সে আগে কখনো আলু মজুত করে রাখেনি। কিন্তু তখন বাজারে আলুর খুব চাহিদা, অনেক দাম উঠছে। সে তার মানে আরও বেশি দাম পাবে। এই ভেবে লোভ সামলাতে না পেরে সে সব আলু কেনে। সাথে অন্যান্য সমস্ত মালও সে কিনে নেয়। বাজারে চাল, ডাল সবজি কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের হাহাকার, চিৎকার ও কান্না শুনতে পাওয়া যায় সবসময়। তারা বিকাশকে অভিশাপ দেয়। এদিকে বাজার থেকে সব মাল সাথে আবার আলু এত পরিমাণ কেনার জন্য বিকাশেরও অনেকটা অর্থ ব্যয় করতে হয়। সে ভাবে মাসের শেষে তার অনেক লাভ হবে। তার গুদামঘরে সব জিনিস একসাথে রাখা থাকত। সে প্রত্যেকদিন সেগুলো দেখত, কোন্ সবজি পচে যাচ্ছে, পচা সবজি সে ভালো বলে চড়া দামে বিক্রি করে দিত— এতটাই অসৎ ছিল সে।
কিন্তু এইবার তার মাসের প্রথম থেকেই অতটা বিক্রি হল না। কিছুদিন পর তাকে শহরে যেতে হল। তার বউ বা মা কেউ তাকে সহযোগিতা করত না, বরং তাকে বারণ করত এরকম করতে। ফলে সে গুদামঘরের চাবি নিজের সাথে নিয়ে গেল। বেশ কয়েকদিন শহরে থাকার পর সে ফিরে এল। ফিরে এসে তার মাথায় হাত পড়ে গেল। গুদামঘর খুলে সে দেখল সব সবজি পচে গলে গেছে একদম। আলু গুলোর থেকে এমন পচা গন্ধ বেরোচ্ছে যেন মনে হচ্ছে কোনো মৃতদেহ পচে গেছে। এরকম অবস্থায় তার বদমাইশির কথা বুঝতে পেরে বাবুরাও আর তার থেকে মাল নেয়না, কারণ তাদেরকেই বিকাশ কিছুদিন আগে পচা সবজি ভালো বলে দিয়ে দিয়েছিল। ফলে বিকাশ বাধ্য হয় বেঁচে থাকা চাল ডাল গরীবদের মধ্যে একদম কম দামে বিক্রি করে দিতে। এইবার সে এতটাই লোকসান করে যে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না, যা টাকা পয়সা ছিল তা সহজেই ফুরিয়ে যায় আর সে পথে বসে।
আমরা বুঝতে পারছি যে বিকাশ প্রথম থেকেই ভীষণ লোভী এবং অসৎ প্রকৃতির মানুষ। সেই বার সে শহরে গিয়েছিল একটা খারাপ ঔষধ বিক্রি করতে যার তারিখ পেরিয়ে গিয়েছিল। কারণ তার টাকার লোভ বেড়েই চলেছিল। সে যার কাছ থেকে ওষুধটি নিয়েছিল সে তাকে অনেক টাকা দেবে বলেছিল। তাই সে শহরের একজনের কাছে সেটি বিক্রি করতে গেছিল। কিন্তু সেই লোকটি বুঝতে পেরে যায় আর বিকাশকে প্রচুর মারধোর করে আর পুলিশে দেবে বলে। কিন্তু বিকাশ পায়ে ধরে, ক্ষমা চেয়ে, কান্নাকাটি করে সেটা আটকায়। প্রথমতঃ অত মাল একসাথে লোভে পড়ে না কিনলে আজ এমন হত না। দ্বিতীয়তঃ তার আরও বেশি টাকার লোভে পড়ে এত মাল বন্ধ ঘরের মধ্যে রেখে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। তৃতীয়তঃ বাবুদেরকে তার ঠকানো উচিত হয়নি। আর সব থেকে বড়ো ব্যাপার হল টাকা আয় করার জন্য তার এরকম একটা অসৎ উপায় বেছে নেওয়া উচিত হয়নি। কথাতেই আছে ‘‘অতি লোভে তাঁতী নষ্ট।’’ এটা তার মাথায় রাখা উচিত ছিল।