ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
স্নেহের ছোট্ট বন্ধুরা,
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে ৮ মে। নজরুলের ১৮৯৯ সালে ২৫ মে। সিয়ারশোল স্কুলে নবম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থা থেকেই নজরুল রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অদ্ভূত শ্রদ্ধা। নজরুল নিজেই লিখছেন, ‘‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয় মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে, ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছেন।’’
এই প্রসঙ্গে ১৯১৬ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করলে আমরা বুঝতে পারি কৈশোরেই নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন। তখন নজরুল শিয়ারশোল স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন খেলার মাঠে বন্ধুরা তাকে নিয়ে মজা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু অপ্রিয় কথা বললে নজরুল খেলার মাঠের বাঁশের গোলপোস্টের একটা বাঁশ উপড়ে বন্ধু জগৎ রায়ের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ১৯২০-এর দিকে নজরুলের আবির্ভাব। তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন গৌরবের শীর্ষে। তাঁর প্রভাব প্রায় সর্বত্র। ঐ সময় কলকাতার প্রবাসী, ভারতী, মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, নবযুগ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নজরুলের কবিতা ও বিভিন্ন রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। ঐ সময় রবীন্দ্রনাথ আগ্রহ নিয়ে নজরুলের কবিতা ও লেখা পড়তেন। ১৯২০-এর শেষের দিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান নজরুল। প্রথম সাক্ষাতে বিস্ময়ের ঘোরে নজরুল কোন কথাই বলতে পারেননি। এরপর চিঠিপত্র ও ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজী’ বলে সম্বোধন করতেন।
১৯২১ সালে অক্টোবরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নজরুলের। সেই সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথের পাশে বসেছিলেন বাংলা ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং নজরুল। শহীদুল্লাহ সাহেব কবিগুরুকে বলছিলেন, ‘‘ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলির সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন।’’ এই শুনে কবিগুরু বললেন, ‘‘তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো। আমার গীতাঞ্জলির সবতো আমারই মনে থাকে না।’’ অন্যদিকে নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ নজরুল রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’ চরণ থেকেই নিয়েছিলেন। গুরু শিষ্যের আর একটা চমকপ্রদ সাক্ষাৎকার। ১৯২২ সালে জানুয়ারী ‘বিজলী’ পত্রিকায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নজরুল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘গুরুজি গুরুজি আপনাকে হত্যা করব’ বলতে বলতে হাজির হন। কবি তাঁকে উপরে ডেকে নিয়ে যান। নজরুল তার বিদ্রোহী কবিতা আগাগোড়া আবৃত্তি করে কবিকে শোনান। ঐ কবিতা পড়া শেষ হলে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘‘হ্যা কাজী তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ব বিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতায় জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’’
এই সময় নজরুল ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি টেলিগ্রাম করে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠালেন।
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু—
‘‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় তোরণ!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে
আজ যারা অর্ধচেতন।’’
নজরুল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেন কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথকে। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেন যৌবনের দূত নজরুলকে।