ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
গেটের ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেয়ে বিলে তাকাল। তাকিয়েই অবাক। গেট খুলে কানাইমামা বাড়িতে ঢুকলেন। খুশিতে বিলে চেঁচিয়ে উঠল— মা, দেখে যাও কে এসেছে।
মা রসুই ঘরে। সেখান থেকেই গলা তুলে বললেন— কে এসেছে রে?
মিলি বাড়ির পিছন দিকে বিড়ালছানা নিয়ে খেলা করছিল। দাদার গলার আওয়াজ পেতেই একছুটে সামনে চলে এসে দেখে, কানাইমামা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি খুশির ভাবটা চেপে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল— মা কানাইমামা এসেছে, কানাইমামা!
বড় মামা, মেজ মামা বা ছোট মামা নয়— কানাইমামা! কানাইমামা ওদের মায়ের নিজের দাদা নন। তাহলে কী হবে, কানাইমামা নিজের মামাদের থেকেও বেশি। বিলেদের বাবা এখন বাড়ি নেই। বাজারে গেছেন। বাবা যদি এখন থাকতেন তাহলে বাবাও হইচই বাঁধিয়ে দিতেন। মা রসুই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন— কানাইদা এতদিন পরে সময় হল? আমার খুব রাগ হয়েছে। তোমার সাথে কথাই বলব না! কানাইমামা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন— ওই কাজটি তুমি পারবে না। বলেই বিলে মিলির দিকে চেয়ে বললেন— ঠিক কিনা?
ওরা একসাথে বলে উঠল— ঠিক ঠিক ঠিক! মা হেসে উঠলেন। তারপর মিলিকে বললেন— যা তো মা, এক গেলাস জল নিয়ে আয় তো। আর বিলেকে বললেন— তুই একটা রেকাবিতে করে বাতাসা নিয়ে আয়।
কানাইমামা বাধা দিয়ে বলে উঠলেন— আরে, এখুনি ওদের এসব...
মা কানাইমামাকে বলার আর সুযোগ না দিয়ে বললেন— ওরা এখন আর খুব ছোটো নেই। ওরা ঠিক পারবে। এভাবেই শিখবে। তারপর বলো, কেমন আছ? বউদি পুপুন মিতুন ওদের নিয়ে এলেনা কেন?
—তোমার বউদি পুপুন মিতুনকে নিয়ে ওদের মামার বাড়ি ঘুরতে গেল। আমি সেই ফাঁকে আমার বোন বোনাই আর তাদের ছানাপোনার কাছে চলে এলাম। খুব কপাল করে তোমাদের মতো বোন বোনাই পেয়েছি। আর তোমাদের এই যমজ ছেলেমেয়ে দুটিরও তুলনা হয় না!
কথা বলার মাঝে জল বাতাসা এনে হাজির করল বিলে মিলি। কানাইমামার সামনে এগিয়ে দিল। কানাইমামা দুটো বাতাসা কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নিলেন। এরপর জল খেলেন। শুধু খেলেনই না— আঃ করে গলায় একটা আওয়াজ করলেন। এক ফাঁকে বিলে মিলির বাবা বাজার থেকে এসে গেলেন। কানাইমামাকে দেখে বললেন— যাক আপনি তাহলে এখনো বেঁচে আছেন? আমি ভাবলাম—
মা তাড়াতাড়ি করে বাবার হাত থেকে বাজারের আর মাছের থলে দুটো নিয়ে বাবাকে বললেন— ও কী কথা? বালাই-ষাট! তোমায় অত ভাবতে টাবতে হবে না। তোমরা বরং বসে কথা বল। আমি চা জলখাবারের আয়োজন করতে যাই।
বিলে মিলি ওদের বাবা মায়ের কাছে কানাই মামার অনেক কথা শুনেছে।
কানাইমামা একটা কারখানায় কাজ করতেন। সেই কারখানার মালিক কানাইমামাদের বলেছিল— কারখানা আর চালাবে না। চালাতে পারে, তবে কাজের লোকদের কম মাইনে দেবে। কানাইমামার মতো আরও কিছু কাজের লোক এটা মানতে পারেননি। তাঁরা জোট বেঁধে লড়াই শুরু করলেন। ফলে কানাইমামাদের কাজ চলে গেছিল। কী করে তখন! কানাইমামা সকলকে নিয়ে পথে-ঘাটে লোকের বাড়ি বাড়ি চাঁদা চাইতে লাগলেন। অমন একটা দিনে কানাইমামা ওদের বাড়ি এসে সব কথা বলে চাঁদা নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে পরে শুধু কানাইমামা আসতেন। যেদিন আসতেন সেদিন মা-বাবা চাঁদা তো দিতই তার সাথে দুপুরে খাইয়ে তবে ছাড়ত। এর মাঝে বেশিরভাগ লোক কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি হওয়ায় কারখানা খুলে গেল। কানাইমামা আর কয়েকজন রাজি হলেন না। সে সময় একদিন ওদের বাবা কানাইমামাকে বললেন— এভাবে কতদিন? তার চেয়ে আপনারা একটা কিছু করুন। আর কোনো কারখানায় কাজের খোঁজ করেছেন? কানাইমামা বললেন— করেছি। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়। কাজ দিতে রাজি হলেও কম মজুরি দেবে বলে।
এসব কথা কী করে যেন এখন উঠে এল!
কানাইমামা সাথে করে যে ফল-টল এনেছেন সেগুলো দেখে বাবা বললেন— আপনি আবার এসব আনতে গেলেন কেন?
কানাইমামা বললেন— একটা সময় তোমরা আমার পাশে, আমাদের পাশে ছিলে। তখন আমার উপায় ছিল না। দু-হাত ভরে নিয়েছি। তোমার কথামতো আমরা ফুটপাতে বসে গামছা বেচেছি। তার টাকাও তোমরা দিয়েছিলে। তারপর জামাকাপড়ের গুমটি দোকান দিলাম বাজারে। তখনো তোমরা টাকা দিয়েছিলে। কারণ আমাদের দাঁড় করাতে চেয়েছিলে। এরপর গুমটিটা আমার সাথিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি যখন আলাদা জামাকাপড়ের দোকান দিলাম, তখনও তোমরা...
বাবা বললেন— আপনি সেসব টাকা ধীরে ধীরে শোধও তো করে দিয়েছেন। তাহলে এসব কথা উঠছে কেন? মানুষের বিপদে মানুষই তো পাশে দাঁড়ায়। আপনিও তো কম কিছু করেননি। বিলে মিলির মায়ের যখন অসুখ করল— যমে মানুষের টানাটানি— আপনি সমানে হাসপাতাল ঘর করেননি? ওষুধ কিনতে পাঠালে, সে ওষুধের দাম আমার থেকে নিয়েছেন? তাছাড়া দিনের পর দিন রাত জাগেননি? বউদি এসে আপনার বোনের সেবা করেননি?
মা তেলেভাজা-চা নিয়ে হাজির। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মায়ের কানে কিছু কথা ঢুকে যায়। মা বিলে মিলির বাবাকে বলেন— পুরনো কথা ছাড়ো। মানুষের বাড়িতে মানুষ এলে কিছু না কিছু নিয়েই আসে। আমরা যদি কানাইদার বাড়ি যাই আমরাও কিছু না কিছু নিয়ে যাব। তা-নিয়ে যদি কানাইদা কী বউদি কোনো কথা বলে, আমাদের কি ভালো লাগবে?
বাবা বলেন— আমি অতশত ভেবে কিছু বলিনি। ওটা কথার কথা আর কী!
বিলে বাবাকে বলল— বাবা, কথার কথা কাকে বলে?
বিলের কথার কী জবাব দেবে সেটা ভাবতে থাকে ওর বাবা। আর বাবার কণ্ঠস্বর, মুখের ভাব দেখে মা আর কানাইমামা দু-জনেই হেসে ফেলেন।
মা হাসতে হাসতে বলেন— ওসব মানে টানে পরে জানা যাবে। এখন মুড়ি তেলেভাজার সদগতি কর সবাই।
নিজের মামাদের থেকেও কানাইমামা বিলে মিলির কাছে কেন এতটা আপন মনে হয় সেটা এবার বলি।
আসল কথা, কানাইমামা ওদের পড়াশোনার বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর নেন না। সে বিষয়ে কোনো উপদেশও দেন না। ওদের সামনে কাগজ ভাঁজ করে ফুল পাখি পশু তৈরি করে ওদের উপহার দেন। কাগজ আঠা দিয়ে না জুড়ে কেবল ভাঁজের পর ভাঁজ করে কোনো কিছু তৈরি করাকে অরিগামি বলে। এটা বিলে মিলি কানাইমামার থেকে জেনেছে। এই শৈলীটা জাপান দেশের মানুষেরা খুব ভালো পারে। ওদের দেশ থেকেই সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আরও একটা জিনিস কানাইমামা ভালো পারেন। মজার কাহিনী শোনাতে। সেসব কাহিনী শুনতে বিলে মিলির সাথে ওদের বাবা-মাও জুটে যান।
আজও বিকেলবেলায় চায়ের আসরে কানাইমামার কাছে বিলে মিলি আবদার করল— মামা, মায়ের মুখে শুনেছি, তুমি নাকি ছোটোবেলায় টাকার গাছ পুঁতেছিলে? সেই কাহিনী না শুনে আজ তোমাকে ছাড়ছি না।
কানাইমামা ওদের মাকে বললেন— ওসব কথা কোন ফাঁকে তোমাকে বলেছি, আর তুমি আবার ছেলেমেয়ের কানে তুলে দিয়েছ! তুমি যখন ওদের কানে সেই কথাটা তুলেই দিয়েছ, তাহলে তুমিই শুরু কর। তারপর জায়গামতো আমি ধরে নেব।
বিলে মিলির বাবা বললেন— নাও, জলদি শুরু করো। টাকার গাছ বলে কথা!
মা শুরু করেন— তোদের কানাইমামা ছোটোবেলায় ওঁর বাবার কাছে কিছু একটা চেয়ে বায়না করেছিল— এই তোরাও যেমন আমাদের কাছে বায়না করিস— তেমন। তা সে সময় হয়তো কানাইমামার বাবার হাতে তেমন টাকা ছিল না— তাই হয়তো কানাইমামাকে বলেছিলেন— দাঁড়া, টাকার গাছ পুঁতব। টাকা ফললে, সেই টাকা দিয়ে তোকে ওই জিনিসটা কিনে দেব।
বিলে বলল, তারপর কী হল? দাদু টাকার গাছ বসাল? টাকা ফলল?
মিলি বলল— এ আবার হয় নাকি? টাকার আবার গাছ হয় নাকি? টাকা তো টাঁকশালে তৈরি হয়।
এবার কানাইমামা বললেন— দেখ, তোমাদের মতো আমি অত তো চালাক চতুর ছিলাম না— বোকাই ছিলাম বলতে পার। আমি রোজই বাবাকে শুধাতাম— টাকার গাছ কবে পুঁতবে?
বাবা বলতেন— ভালো বীজ মিলছে না। যেকোনো টাকা বীজ হিসেবে পুঁতলে গাছ হবে না। আমি সুযোগে রয়েছি। তেমন বীজ পেলে ঠিকই পুঁতব। একটু সবুর কর।
দেখা গেল বাবা আর টাকার বীজ জোগাড় করতে পারছেন না। আমার কি তর সয়? আমি করলাম কী, ঠাকুরদার থেকে বায়না করে একটা টাকা চেয়ে নিলাম। উঠোনের এক কোণে মাটি খুঁড়ে টাকা বসিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দু-ঘটি জল ঢেলে দিলাম। রোজই জল দিই আর দেখি টাকার গাছ বেরুল কিনা!
বিলে মিলি এবং ওদের বাবা-মা সবাই হাসতে লাগল। মিলি বলল— তারপর?
কানাইমামা বললেন— তার পরের কাহিনীটাই তো খুব মজার! দু-চার দিন যাবার পর একদিন সকালবেলায় দেখি যে-জায়গায় টাকা পুঁতেছিলাম, সেখানে একটা ঝাঁকড়া ডালে টাকা ফলে আছে! আমার খুশি আর দেখে কে! বাড়ির সবাইকে ডেকে ডেকে বলছি— টাকার গাছে টাকা ফলেছে! টাকার গাছে টাকা ফলেছে! সেই কথা শুনে বাড়ির সবাই তালে তাল দিয়ে বলতে লেগেছে— ও মা, তাইতো! আমাদের আর ভাবনা কী? বাবা বললেন— উঁহুঁ, খবরদার, তোমরা কেউ গাছে হাত দেবে না। কানাই যখন গাছ বসিয়েছে তখন ওই টাকাগুলো কানাইয়ের। কানাই তুই এবার ওই টাকা দিয়ে নিজের খুশিমতো জিনিস কিনবি, কেমন? বাবা নিজেই ডাল থেকে টাকাগুলো পেড়ে আমার হাতে দিলেন। আগেই বলেছি, আমি ছোটোবেলায় বেশ বোকাই ছিলাম। এখনো বোধহয় বোকাই আছি। যাকগে, যা বলছিলাম। পরে বড়ো হয়ে ঠাকুরমার মুখে শুনেছিলাম, একটা ঝাঁকড়া মরা ডাল জোগাড় করে তাতে আঠা দিয়ে টাকা আটকে, রাতেরবেলা আমি ঘুমিয়ে পড়লে বাবা, আমি যেখানে টাকার গাছ পুঁতেছিলাম সেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন!
বিলে মিলে দু-জনেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল— তা-ই-ই!
কানাইমামা ওদের সুরে সুরে মিলিয়ে বললেন— আমার বাবা ছিলেন অমন টা-ই-ই!