ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
মহান মানবের পবিত্র মানবজীবনের আখ্যায়িকা বা গল্পগুলি চিরস্মরণীয়। সেই সব অনন্যসাধারণ পুরুষের পৌরুষ দেশ ও দশের হৃদয়ে দিয়ে যায় সঞ্জীবনী সুধা। তাঁদেরই একজন হলেন রামমোহন।
তাঁর অনন্যসাধারণতা, সুবুদ্ধি, মমত্ববোধ ও মহানুভবতায় তিনি অমর। তখন ভারত ইংরাজ সরকারের শাসনাধীন। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ভারতের বড়লাট। সতীদাহ প্রথা বিলোপের বা নিবারণের জন্য বেন্টিঙ্ক রামমোহনের সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে রামমোহনের নিকট পাঠিয়েছিলেন। ইংরাজ কর্মচারীর মুখে এ সংবাদ শুনে রামমোহন স্থির গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন— ‘আমি এখন ও বিষয়ের সঙ্গে লিপ্ত নই বর্তমানে ধর্মবিষয় নিয়ে ব্যাপৃত।’
ইংরাজ কর্মচারী চলে গেলেন এবং রামমোহনের বক্তব্য অবিকল বড়লাটকে জানালেন। বড়লাট বেন্টিঙ্ক পূর্বেই শুনে ছিলেন যে ভারতে ‘রাম’ ছিলেন তিনজন, প্রথমজন হলেন— রাবণ দমনকারী— ‘রাম’, দ্বিতীয়জন হলেন— ‘হলায়ধ’ ধারণকারী— ‘বলরাম’, আর তৃতীয়জন হলেন— ‘পরশুরাম’! এখন দূতের মুখে রামমোহনের বক্তব্য শুনে বেন্টিক ভাবলেন— ভারতে তিনজন— ‘রাম’ ছিলেন, এখন দেখলেন চতুর্থ রামও সাহসিকতা ও তেজস্বিতায় বিদ্যমান! পুনরায় বড়লাট সাক্ষাতের জন্য অন্য কর্মচারীকে রামমোহনের নিকট পাঠালেন। এখন রামমোহন আর বড়লাটকে বিমুখ করলেন না। তাঁর অনুরোধ রক্ষার্থে স্বয়ং গিয়ে বেন্টিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। বিদেশী বড়লাট সেদিন দেখেছিলেন পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষকে!
অসাধারণ বুদ্ধিতে আর একবার রামমোহনের এক বন্ধু কালীনাথ মুন্সীকে প্রবঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন রামমোহন। একদিন একটি লোক মুন্সী মহাশয়ের নিকট এসেছিলেন একটি শাঁখ বিক্রি করতে। সেই শাঁখটি মানুষকে নিঃশঙ্ক করে এবং যার ঘরে এই শাঁখ থাকে তার ঘরে নাকি দেবী লক্ষ্মী স্থায়ী হন, অভাব দেখা দেয় না। কালীনাথ জিজ্ঞাসা করলেন— শাঁখের মূল্য কত? লোকটি বলল— ‘পাঁচশত টাকা।’ কালীনাথ শাঁখটি কেনবার আগে চিন্তা করলেন বন্ধু রামমোহনের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তাই তিনি লোকটি সহ হাজির হলেন রামমোহনের কাছে। রামমোহন সমস্ত ঘটনা শুনে হেসে বললেন— ‘‘পাঁচশত টাকার শাঁখ ঘরে রাখলে যদি লক্ষ্মী থাকে তবে শাঁখটি বিক্রি না করে তিনি নিজের ঘরেই শাঁখটি রাখতে পারতেন।’’ একথা শুনে কালীনাথ নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এরকম বুদ্ধির জন্য তিনি বন্ধুর পরামর্শে একটা বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেলেন!
আর একদিনের ঘটনা— রামমোহন চলেছেন জনবহুল কর্মমুখর কলকাতার রাস্তা দিয়ে। দেখলেন— একজন মোটবাহী শ্রমিক প্রকান্ড একটা মোট নিয়ে অপেক্ষা করছে। এত ভারী যে তার একার পক্ষে তোলা সম্ভব নয়। পথযাত্রীরা দেখছে আর চলে যাচ্ছে, কেউ মোটটা তুলতে সাহায্য করছে না। রামমোহনের হৃদয় চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি শাস্ত্রবাক্য স্মরণ করলেন— ‘ভারবাহীকে পথ ছেড়ে দেবে, —অগ্রে গমন করতে দেবে।’’
সঙ্গে সঙ্গে রামমোহন শ্রমিকটির সামনে গেলেন ও তার মাথায় মোটটি তুলে দিলেন। শ্রমিকটির হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল। এরকম হৃদয়বান ছিলেন রামমোহন। শ্রমিক, কৃষকদের সঙ্গে তিনি অবাধে মেলামেশা করতেন।
এরকম দয়ার্দ্র হৃদয়ের আর এক অবিস্মরণীয় ঘটনা— হঠাৎ তিনি একদিন শুনলেন— তাঁর পুত্র বাজারে ‘তোলা’ গ্রহণ করে। গরিব ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের নিকট থেকে ঐ ‘তোলা’ নেওয়া অত্যন্ত অন্যায়। তখন তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন— ‘‘আমার পুত্র অতি দরিদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট হতে ‘তোলা’ গ্রহণ করছে। তাহলে, তার হৃদয় কত দরিদ্র!’’ পুত্র পিতার এই খেদোক্তি শুনলেন এবং তারপর আর কোনদিন ‘তোলা’ গ্রহণ করেননি। দরিদ্র ব্যবসায়ীরা শ্বাস ফেলে বাঁচলেন। রামমোহনের পিতা ছিলেন জমিদার, তিনিও ছিলেন জমিদার। তথাপি জমিদারি প্রথা প্রজাদের দুঃখের কারণ ছিল না।
এরকম বহু ছোট বড় আর স্মরণীয় ঘটনা রামমোহনের সমগ্র জীবনকে ঘিরে রয়েছে।