ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
হিরণ্যগড়ের রাজা অমরাদিত্য। তাঁর একমাত্র কন্যা হিরণমালা। হিরণমালার রূপে রাজপুরী ঝলমল করে। সত্যিই দেখবার মত রূপ তার। তাই বুঝি হিরণমালার মনে অহংকার, ‘আমার মত সু¨রী আর ভূ-ভারতে নেই!’
সত্যিই তার মত সুন্দরী সারা দেশে আর একটিও ছিল না। কিন্তু তাই বলে কি রাজকুমারীর অহংকার করা সাজে? রাজকুমারী তার গোলাপ সখী, টগর সখী আর চাঁপা সখীর কাছে রূপের বড়ো বড়াই করতো!
একদিন রাজকুমারীর অহংকারের খবর পেলেন রাজা অমরাদিত্য, পেয়ে তাঁর মনে বড়ো কষ্ট হল। একমাত্র কন্যা— রূপে গুণে রাজপুরী আলো করে থাকুক— এটাই তো তিনি চান; কিন্তু চাইলে কী হবে, কন্যের মেজাজ হয়ে গেল অন্য রকম। রূপ সে পেলো কিন্তু গুণ পেলো না। মনের কষ্ট মনে নিয়েই রাজা চুপ করে থাকেন।
অহংকারী কন্যের অহংকার কী করে দূর করা যায়, সেই হল তাঁর চিন্তা। তিনি একদিন মন্ত্রীমশাইকে ডেকে তাঁর দুঃখের কথা বললেন।
মন্ত্রী মশাই স্থির হয়ে সব শুনলেন, শুনে বললেন, দুঃখ করবেন না মহারাজ! মা মরা মেয়ে উপযুক্ত শিক্ষার অভাব ও-রকম হয়েছে। হিরণমালাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে একজন জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত ব্যক্তিকে রাজপুরীতে আহ্বান করুন। জ্ঞানের আলো পেলে রাজকুমারীর তুচ্ছ অহংকার দূর হয়ে যাবে।
মন্ত্রী মশাইয়ের পরামর্শ মত এক অসামান্য পণ্ডিত ব্যক্তিকে আহ্বান করা হল। সেই পণ্ডিতের নাম দেবকুমার। দেবকুমারকে দেখেই হিরণমালা ঠোঁট উলটে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখালো। দেবকুমারকে সামনা সামনিই বলে বসলো, ‘কী ছিরি আপনার!’
দেবকুমার মৃদু হাসলেন, কথার জবাব দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মাথা ভর্তি জটা আর মুখ ভর্তি দাড়ি দেখে রাজকুমারী এই রকম বিদ্রূপ করলো! কিন্তু তাতে দেবকুমার কিছু মনে করলেন না।
রাজপুরীতে আসবার পরের দিনই হিরণমালাকে পাঠ দেওয়া শুরু হল দেবকুমারের। হিরণমালাকে সামনে বসিয়ে তিনি কয়েকটি সুন্দর নীতিকথা শোনাতে লাগলেন। কিন্তু সে-সব কি আর ভাল লাগে হিরণমালার? সে খানিকক্ষণ বসে শোনে, তারপর গল্পের মাঝখানেই উঠে পড়ে।
দেবকুমার বলেন— কী ব্যাপার? উঠে পড়লে যে?
হিরণমালা বলে, —কী করবো বলুন পণ্ডিত মশাই, এ-সব শুনতে আমার একটুও ভাল লাগছে না! কোথাকার কী সব বলেন— তার ঠিক নেই!
হিরণমালা চলে যায়। দেবকুমার তখন চিন্তা করতে থাকেন। পরের দিন রাজকুমারী এলে গল্প বলার কিছু ধারা পালটে দেন তিনি।
এমনি করে নিত্য নতুন গল্প বলে হিরণমালাকে জয় করতে চেষ্টা করেন দেবকুমার।
হিরণমালা দেবকুমারের কাছে কতো দেশ-বিদেশের রাজারাণীর গল্প শোনে, রাজকুমার রাজকুমারীর গল্প শোনে, রূপের চেয়ে গুণের আদর বেশি— এমন কথাও শোনে সে, তবু নিজের রূপের অহংকার কমে না।
দেবকুমার সামনা সামনি তাকে একদিন এই কারণে তিরস্কার করলেন, বললেন, সারা দেশে তোমার মত রূপবতী কেউ হয়তো না থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে রূপের অহংকার করা তোমার শোভা পায় না।
রাজকুমারী মুখ ভার করে রাজার কাছে নালিশ জানালো, বললে, পণ্ডিত মশাইকে বিদায় করে দাও বাবা। ওঁর কাছে আমি কিছু শিখবো না।
রাজা অমরাদিত্য সমস্যায় পড়লেন। দেবকুমার খুব বড় পণ্ডিত, অনেক গুণ তাঁর। তাঁকে মেয়ের আব্দার মত বিদায় করা কি উচিত হবে? মেয়েকে তিনি অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হিরণমালার এককথা, ওঁর কাছে আমি কিছু শিখবো না বাবা! উনি আমায় অপমান করে কথা বলেছেন!
কী করবেন, কী করা উচিত— রাজা যখন এই রকম একটা সমস্যায় পড়েছেন, ঠিক সেই সময়েই তার সমাধানও হয়ে গেল!
কয়েকদিন পর, এক বিকেলে টগর সখী, চাঁপা সখী আর গোলাপ সখীকে নিয়ে বাগানের মধ্যে বেড়াচ্ছিল হিরণমালা। বেড়াতে বেড়াতে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল জুঁই-মাধবীর কুঞ্জ বনে। ওখান থেকে একটা মিষ্টি সুর ভেসে আসছে বাতাসে। সেই সুর শুনতে শুনতে হিরণমালার মন কেমন উদাস হয়ে গেল! সে সখীদের কথা ভুলে গেল। তিন সখীই যে তাকে কখন পিছনে রেখে চলে গেছে, সে-খেয়ালই তার ছিল না। মিষ্টি সুরের স্পর্শ তার মনকে মুগ্ধ করে রাখলো।
কিছুক্ষণ পরে দেবকুমার রাজকুমারীর সামনে এসে দাঁড়ালেন, বললেন, কী বাপার? রাজকন্যা হিরণমালা এমন ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে যে?
দেবকুমারকে দেখে মুখটা ফিরিয়ে নিতে গিয়েও ফিরিয়ে নিতে পারলো না হিরণমালা, মনটা তার দেবকুমারের প্রতি বিরূপ হয়েছিল সত্যি। কিন্তু সুরের যাদুতে সেই বিরূপ ভাব অনেকটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। খুব ধীর ভাবে হিরণমালা বললে, কিসের যেন একটা মিষ্টি সুর শুনতে পাচ্ছিলাম, কিসের বলুন তো?
দেবকুমার মৃদু হাসলেন, —সুরটা শুনতে কি তোমার ভাল লাগছিল?
হিরণমালা বললে, হ্যাঁ।
দেবকুমার বললেন, —শুনে খুশী হলাম। ও-সুরটা প্রকাশ হচ্ছিল একটি বাদ্যযন্ত্র থেকে, যন্ত্রটির নাম সারেঙ্গী।
রাজকুমারী বললে, —জানেন কে এই সারেঙ্গী বাজাচ্ছিল?
—আমি। —দেবকুমার মৃদু হেসে রাজকুমারীর মুখের দিকে তাকালেন।
রাজকুমারীর দুটি চোখ বিস্ময়। বললে— আপনি? আপনি এতো সুন্দর সুর সৃষ্টি করতে পারেন?
—পারি, কিন্তু উত্তরাধিকার হিসেবে এই সুর সৃষ্টির শিক্ষা তো কারোকে দিয়ে যেতে পারছি না! কাল রাজপুরী থেকে তো বিদায় নিয়ে যাবো। দেখি, অন্য কোথাও কারোকে এই সুরের উত্তরাধিকারী করে যেতে পারি কিনা!
রাজকুমারী অবাক হয়ে বললে— আপনি কাল চলে যাবেন? কেন?
—তুমি যখন আমার কাছে কোন শিক্ষাই নিতে চাইছ না তখন বৃথা এখানে কালক্ষেপ করায় লাভ কী?
রাজকুমারী লজ্জা বোধ করলো, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
দেবকুমার আবার বললেন— চলে যাবোই মনস্থ করেছি, তবে কিন্তু একটা শর্তে এখানে আমি আরও কিছুদিন থেকে যেতে পারি।
—কী সেই শর্ত? রাজকুমারী সাগ্রহে মাথা তুললো।
—যদি তুমি আমার বাদ্য যন্ত্রটি হাতে নিয়ে আমার কাছে বসে সুর সৃষ্টির শিক্ষা গ্রহণ কর!
রাজকুমারীর মনে সংশয়— বললে, আমি কি পারবো? অমন মিষ্টি সুর আপনি যা সৃষ্টি করেন?
—কেন পারবে না? সাধনায় সব পাওয়া যায়। তুমি রাজি হও।
সন্ধ্যার পর। রাজার পাশে বসে নতুন এক আব্দার রাখলো রাজকুমারী, বললে— আমি পণ্ডিত মশায়ের কাছে সারেঙ্গী বাজানো শিখবো বাবা। উনি সুন্দর সুন্দর গল্পও যেমন বলতে পারেন, সুরও সৃষ্টি করতে পারেন কতো সুন্দর।
মেয়ের কথা শুনে রাজা খুশী হলেন, বললেন— তাই কি? তুমি ওঁর কাছে বাজাতে শিখবে? সে তো আনন্দের কথা! কিন্তু মা, উনি যে রাজপুরী হতে বিদায় নিতে চাইছেন!
রাজকুমারী বললে— কিন্তু ওঁর কাছে আমি সুরের শিক্ষা নিতে রাজি হলে উনি যাবেন না।
—খুব ভাল কথা! চমৎকার প্রস্তাব। রাজা অমরাদিত্য মেয়ের মানসিক পরিবর্তনে খুব খুশী হয়ে উঠলেন, বললেন, আমি দেবকুমারের সঙ্গে কথা বলছি, তুমি তাঁর কাছে সুরের সাধনা কর।
কয়েক মাস পরে। একদিন সকালে দেখা গেল রাজপুরীর পূর্ব তোরণের সম্মুখ-পথে বহু মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়েই আছে ওরা। কারোর মুখে কোন কথা নেই, কিন্তু চোখে ওদের বিমুগ্ধ বিস্ময়।
কী ব্যাপার?
ব্যাপার এই— রাজপুরীর পূর্ব সীমার এক নির্জন কক্ষ থেকে মনকে মুগ্ধ করার মত সুন্দর একটা সুর ভেসে আসছে। পথ চলতি মানুষেরা সেই সুরে আকৃষ্ট হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কে এই সুরের শিল্পী, কোথায় সে আছে— তা ওরা জানতে চাইছে না। শুধু শুনতে চাইছে ঐ সুমধুর সুর।
দেবকুমার নির্জন কক্ষের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রাজকুমারীকে ডেকে বললেন— দেখো তো ওখানে এত জনসমাগম কেন?
হিরণমালা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পথের দিকে তাকিয়ে সত্যিই ও অবাক হয়ে গেল। বললে— আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কেন বলুন তো অত লোক?
দেবকুমারের মুখে স্মিত হাসি, স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন হিরণমালার দিকে। বললেন— সুরে মুগ্ধ হয়ে ওঁরা ওখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সুরের যাদু ওঁদের মনকে স্পর্শ করেছে।
রাজকুমারীর বুকে আনন্দের জোয়ার। তার কাজল টানা দুটো চোখে খুশী ঝিলমিল করে উঠল। দেবকুমারের পাশে দাঁড়িয়ে সে চেয়ে রইল সুরে মুগ্ধ জনতার দিকে।
দেবকুমার বললেন— কেন ওরা দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারলে তো? তোমার হাতের যাদুতে আর মনের একাগ্রতায় যে সুর তুমি সৃষ্টি করেছিলে তাতে মুগ্ধ হয়েই ওরা থমকে গিয়েছিল। এখন দেখ, সুর থেমে যেতেই ওরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
সামান্য সময় নীরব থেকে দেবকুমার বললেন— আচ্ছা রাজকন্যা, ওঁরা কেউ কি তোমায় দেখতে পেয়েছেন?
রাজকুমারী মাথা নাড়লো— কই, আমাকে তো কেউ দেখতে পাননি!
—তবু দেখো, ওঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, কেন, না, তোমার সৃষ্ট সুরের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে। ঠিক কিনা?
রাজকুমারী হিরণমালা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। দেবকুমার বললেন,— ওঁরা তোমাকে দেখেননি, তোমার সুর শুনেছেন, তাই মুগ্ধ হয়েছেন। অপূর্ব সুর সৃষ্টি করেছ তুমি, ওটা তোমার গুণ। কোথা থেকে সুর আসছে, কে বাজাচ্ছে—ওঁরা কেউ জানেন না, তবু দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। সুর শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওঁরা আবার চলতে শুরু করেছেন, দেখো। তুমি এই পূজা পেলে তোমার রূপের জন্যে নয়, তোমার গুণের জন্যে। রূপেরও মানুষ পুজো করে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী নয়, গুণের যে আদর তা চিরস্থায়ী।
রাজকুমারী দেবকুমারের কথা বুঝতে পারলো। সে মাথা নত করে দেবকুমারের চরণ স্পর্শ করলো।
দেবকুমার হিরণমালার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমার সাধনা সফল হল, আর তুমি হলে সেই সাধনার সার্থক উত্তরাধিকারিণী। তোমাকে আমি আশীর্বাদ করছি, তুমি আরো বড় হও; তোমার সারেঙ্গীর সুর সব মানুষের বুকের দুঃখ যন্ত্রণা মুছিয়ে দিক, সুরের অমৃত স্পর্শে সকলকে এনে দিক শান্তি।
———
ছোটদের কথা, বর্ষ-৯, শারদ সংখ্যা, ১০ম-১১শ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮১ থেকে পুনর্মুদ্রিত