ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
স্নেহের ছোট্ট বন্ধুরা,
আমি যখন তোমাদের মতো ছোট ছিলাম, খুব মনে পড়ে, কালীপুজোর দিন সন্ধে হলেই মাথায় একটা বাঁদর টুপি আর গায়ে একটা পাতলা চাদর বা হালকা সোয়েটার না পরলে ছাদে ওঠার পারমিশনই পেতাম না। কারণ তখন কালীপুজো আসতে আসতে রীতিমতো হিম পড়া শুরু হয়ে যেত, এখনকার মতো কটকটে রোদ আর কুটকুটে ঘামের কথা ভাবাই যেত না।
কালীপুজোর দিন ছাদে ওঠার মূল আকর্ষণ ছিল চারপাশের আকাশের গায়ে রঙবেরঙের হাউইয়ের কেরামতি। আমার বা ভাইয়ের দৌড় ছিল তারাবাতি অর্থাৎ ফুলঝুরি আর সরু রিবনের মতো জড়ানো রঙ মশাল আর দেশলাই বাক্সের মতো বাক্সে ভরা সাপ বাজির ট্যাবলেট পর্যন্ত। কালো কালো ট্যাবলেট গুলোতে আগুন দিলেই কালো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে হড়বড় করে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসত হিলহিলে সাপের মতো দেখতে একটা বস্তু, হাত দিলেই ঝুরঝুরে ছাই হয়ে পড়ে যেত। খুব বেশি হলে কখনো সখনো দু-একটা ছোটখাটো তুবড়ি কিংবা চরকি। কিন্তু দুমদাম করে ফাটা দোদমা, চকলেট বোম, হাউই এসব তো অনেক দূরের কথা, সামান্য সেই লঙ্কা বাজি বা ধানি পটকার সলতেতে আগুন দেবার সাহসই কোনদিন হয়নি!
তাই কালীপুজোর দিন ঐ ছাদই ছিল আমাদের ভরসা! দুপুর থেকে সব বাড়িতে বাড়িতে মাটির প্রদীপে তেল দিয়ে তাতে সলতে ডুবিয়ে রেডি করা থাকত। সন্ধে হলেই সব বাড়ির ছাদের কার্নিশে কার্নিশে জ্বলে উঠত প্রদীপের সারি, কোথাও কোথাও তার বদলে লাইন দিয়ে মোমবাতির মিটিমিটি শিখা। হাওয়া থাকলেই হত মুশকিল! প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখাই দুষ্কর হত। আমরা চাদর মুড়ি দিয়ে ছাদে ঘুরতে ঘুরতে আকাশে রঙবাজি দেখতাম। হুস হাস করে হাউই বাজিগুলো আকাশে উঠে হরেক রঙের আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়ে তারপর দুম করে ফেটে যেত, দেখতে তো দারুণ লাগত! তোমাদেরও নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে! তবে ঐ চকোলেট বোম কিংবা দোদমার পিলে চমকানো শব্দগুলো মোটেই ভাল লাগত না! তখন অবশ্য এখনকার মতো ফানুসের রমরমা ছিল না! আমরা মূলতঃ বইয়ের পাতায়, গল্প কথাতেই ফানুসের নাম শুনতাম তখন।
একটা সময় ছিল যখন দীপাবলি মানে ছিল শুধুই আলোর উৎসব। যা কিছু অজ্ঞানতা, যা কিছু অশুভ সেই সবের অন্ধকারকে দূর করে জ্ঞানের আলো, শুভ বুদ্ধির আলো জ্বালানোই ছিল দীপাবলির তাৎপর্য। এর একটা বৈজ্ঞানিক কারণও থাকে, সেটা হল হেমন্তের এই সময়টাতে পোকামাকড়ের উপদ্রবটা খুব বাড়ে, প্রদীপ শিখার আগুনে সেইসব পোকামাকড় ঝাঁকে ঝাঁকে মারা যাওয়ার ফলে এদের উপদ্রবটা অনেকটাই কমে যেত। তখন কিন্তু দীপাবলিতে ছিল না কোনো বারুদের গন্ধ, ছিল না কোনো শব্দ দৈত্যের তান্ডব। কিন্তু ঠিক কবে থেকে যে দীপাবলির উৎসবের সঙ্গে এই দুটো জিনিস জড়িয়ে গেল সেটার সঠিক সময়কালের হিসেব পাওয়া যায় না।
তবে ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে চীনে তাং রাজবংশের আমলে তাওবাদী ধর্মগুরু তথা বিজ্ঞানীরা এই বারুদ আবিষ্কার করেন এবং আতসবাজি বা শব্দবাজির প্রচলন সর্বপ্রথম চিনেই শুরু হয়। প্রথম দিকে এগুলির ব্যবহার ছিল মূলতঃ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে। তারপর ধীরে ধীরে এগুলির ব্যবহার উৎসবের আয়োজনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। ক্রমশঃ বিভিন্ন দেশে বারুদ এবং বাজির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। আর এখন আমাদের দেশে শুধু তো দীপাবলি উৎসবেই নয়, ছোট বড় যে কোনো উৎসবেই যেন শব্দবাজি বা আতসবাজি অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসো, এই সব বাজির শব্দ কিংবা আলোর ছটায় মেতে ওঠার সাথে সাথে, একবার একটু দেখে নিই, এদের এই চোখ ধাঁধানো আলো আর কান ফাটানো শব্দের মূলে কী আছে কারণটা। এদের ভিতর যে বারুদের মিশ্রণ, তাতে থাকে মূলতঃ সোরা বা পটাশিয়াম নাইট্রেট, তার সাথে চারকোল অর্থাৎ কার্বন আর গন্ধক বা সালফার। আর বিভিন্ন রঙ তৈরির জন্য থাকে বিভিন্ন ধাতুর লবণ। যেমন, গোলাপি রঙের জন্য লিথিয়াম লবণ, হলুদ বা কমলা রঙের জন্য সোডিয়াম লবণ, সবুজ এবং নীল রঙের জন্য বেরিয়াম এবং কপার লবণ, লাল রঙের জন্য স্ট্রনশিয়াম লবণ, এই রকম বিভিন্ন সব লবণ। এবার এই সব মিশ্রণ যখন আগুনের সংস্পর্শে আসে, তখন এদের দহনে বিভিন্ন রঙের আলোর ঝলক যেমন তৈরি হয় সেই সঙ্গে তৈরি হয় কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড কিংবা নাইট্রোজেনের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস এবং সেই সঙ্গে বাতাসে মেশে ঐ সব লবণ থেকে প্রচুর ধাতব কণা যেগুলো বাতাসে ভেসে কিংবা বৃষ্টির জলে মিশে ছড়িয়ে পড়ে দূর দূরান্তে এবং দূষিত করে জল, বায়ু, মাটি সবকিছুকেই! সেই সঙ্গে উৎপন্ন হয় প্রচুর তাপ। যে তাপ হঠাৎ করেই ভীষণ দ্রুত গতিতে বাতাসকে প্রসারিত করে, যার ফলেই ঐ তীব্র শব্দ উৎপন্ন হয় যার মাত্রা ১৫০ থেকে ১৮০ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে। এদিকে আমাদের কানের সহনসীমা মোটামুটিভাবে ৭০ ডেসিবেল! তার মানে আমাদের কানের সহ্য ক্ষমতার দ্বিগুনের বেশি তীব্রতার শব্দ আমাদের কানের পর্দায় আঘাত করতে থাকে এই সময়। এই পরিস্থিতিতে যেখানে সুস্থ মানুষেরাই ঠিক থাকতে পারে না সেখানে অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু, বিভিন্ন পশু এবং পাখিদের কীরকম অবস্থা হয় সে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না! সে অভিজ্ঞতা কম বেশি আমাদের সকলেরই কখনো না কখনো হয়ে থাকে! অতি সম্প্রতি একটি ঘটনার কথা তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই শুনেছ, শব্দবাজির আতঙ্কে উদ্ভ্রান্ত হয়ে একটি পথের কুকুর কোলকাতায় মেট্রোরেলের কামরাতে গিয়ে উঠে পড়ছে! কতখানি ভয় পেলে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একটি পথের কুকুর এমনটা করতে পারে একটু ভাবার চেষ্টা করে দেখো!
এছাড়া, এমনিতে দেখতে শান্তশিষ্ট নিরীহ ফানুসদের কথাও যদি ধরো, তাহলে তারাও আমাদের অপকার করার ব্যাপারে খুব যে পিছিয়ে আছে তা কিন্তু নয়! ফানুসের তারের খাঁচার তলার দিকে মোমবাতির আগুন ধরিয়ে সেই তাপে বিশেষ ধরণের কাগজের তৈরি বেলুনটির ভিতরের বাতাসকে গরম আর হালকা করে উড়িয়ে দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় সেই বেলুন কোনো গঠনগত ত্রুটির কারণে ভিতরের মোমবাতির আগুন নেভার আগেই নিচে নেমে আসে, আর তখন যদি নিচে কোনো দাহ্য জিনিসের ওপর সেটা পড়ে তাহলে কী বিপদ হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ! শুধু তাই নয়, ভিতরের আগুন নিভে বেলুনের ভিতরের বাতাস ঠান্ডা হওয়ার পরও যখন এই সব ফানুস মাটিতে এসে পড়ে তখন এদের ফ্রেমগুলো মাটিতে, পরিবেশে বর্জ্য পদার্থ হয়ে জমা হয়। মাটিকে দূষিত করে, জলকে দূষিত করে।
একটা বিষয় কি তোমরা ভেবে দেখেছ যে, এই যে আমরা এত এত টাকা খরচ করে এত এত বাজি কিনি আনন্দ করার জন্য, কিন্তু এর আড়ালে কত কত নিরানন্দের মুহূর্ত লুকিয়ে আছে! আমরা কি একবারও ভেবে দেখব না যে এই শব্দবাজির আনন্দ নিতে গিয়ে আমরা শুধু যে আমাদের চারপাশে বহু মানুষ, পশু পাখিকে বিপন্ন করছি তাই নয়, সেই মূর্খ কালিদাসের মতো আমরা যে গাছের ডালে বসে আছি, সেই ডালটিতেই কুঠারাঘাত করে চলেছি! যে পরিবেশে আমরা জীবনধারণ করছি, সেই পরিবেশকেই আমরা তীব্রভাবে দূষিত করছি, ভুলে যাচিছ এর বিষময় ফল তো আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে! আমরা মনে রাখি না, আমাদের বাজি ফাটানোর আনন্দ ক্ষণস্থায়ী অথচ এর ফলশ্রুতি যে কতখানি দীর্ঘস্থায়ী, তা একদিন অনেক মূল্য চুকিয়ে আমরা বুঝতে পারব, কিন্তু সেদিন আমাদের কিছু করার থাকবে না!
সবশেষে অনেক খারাপের মধ্যেও একটা মন ভালো করা ঘটনার কথা তোমাদের বলি। আমাদের দেশে তামিলনাড়ুর এরোড জেলায় একটি প্রখ্যাত পাখিরালয় আছে। সেখানে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ বিদেশের বহু পরিযায়ী পাখি এসে আশ্রয় নেয়। সেই সব পাখিদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তাই এই পাখিরালয়ের আশেপাশে সাতটি গ্রামের প্রায় নশো বাসিন্দা বিগত বাইশ বছর ধরে নীরবে শব্দবাজিহীন দীপাবলি পালন করে আসছেন! এ এক বিরল সহমর্মিতা!
তোমরা আগামী দিনের নাগরিক, ভবিষ্যত পৃথিবীর ভার তোমরাই একদিন হাতে তুলে নেবে। এখন থেকে শুধুমাত্র দীপাবলির উৎসবে নয় যে কোনো উৎসবে শব্দবাজির আনন্দে মেতে ওঠার আগে একটু অনুভব করার চেষ্টা কোরো তোমাদের এই আনন্দ কোথায় কোথায় গিয়ে আঘাত করতে পারে! আমরা সবাই যদি একটু করেও অন্ততঃ এই ব্যথাটা অনুভব করতে পারি, জানবে তাহলেও আমরা আমাদের ধাত্রী মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু অন্ততঃ করতে পারলাম!
ইতি—
তোমাদের সম্পাদিকা বন্ধু