ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
কোথাও কোনোখানে একটু ধুলো বালি নেই, একটাও কুটিকুটি পড়ে নেই কোথাও। দুপাশে শুধু ফুলের বাগান, আর তার মাঝখান দিয়ে একটা পায়ে হেঁটে চলা পথ। সেইরকম একটা পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে তপু। পথের দু’ধারে কতো রকমের ফুল ফুটে আছে। তাদের কত রকম রঙ। সেই পথের দু’ধারে যে সবুজ ঘাসেরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারা তপুকে দেখছে অবাক চোখে। তপুও রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সেই ফুলগুলোকে একবার ছুঁয়ে দেখছে। এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডাকল— ‘তপু...!’
পিছনে ফিরে তপু দেখলো একটা নীল রঙের পরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝলমল করছে সেই পরীর পোশাক। নীল গাউন, নীল টুপি, বৃত্তাকার নীল কেপ পরে আছে। তার ডানা দুটো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। এতো আলো যে তপু ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। চোখ দুটো একেবারে ধাঁধিয়ে যাচেছ। তপুর এরকম অবস্থা দেখে সেই পথের দু’ধারের রঙবেরঙের ফুলেরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। এমন সময় সেই নীলপরী পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এসে তপুর সামনে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে বলল—‘কোথায় চলেছো তপু?’
পরীকে দেখে তপু তো তখন বিস্ময়ে প্রায় হতবাক!
তপু পরীকে বলল—‘জানি না তো! ওই যে, ওই দিকটায় হেঁটে চলেছি অজানা কতো কিছু দেখবো বলে।’
নীলপরী বললে—‘তাহলে আমার হাতটা ধরো, তোমাকে আমি ওই দিকটায় নিয়ে যাই।’
এই কথা বলে তপু আর নীলপরী দুজনে এগিয়ে চলল সেই পথটা ধরে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা হলুদ পরী তার হলুদ ঝালর দেওয়া জামা পরে হলুদ ফুলের বন থেকে বেরিয়ে এসে তপুদের সামনে দাঁড়ালো। বলল—‘কি গো, কোথায় চলেছো তোমরা?’
নীলপরী তপুকে দেখিয়ে বলল—‘এই নতুন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নতুনের দেশে।’ তা শুনে হলুদ পরী মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলল—‘সঙ্গে নেবে আমায়!’ তপু বলল—‘বেশ তো, চলোই না!’
ওরা তিনজনে যেতে যেতে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল একটা লাল পরীর সাথে। লালপরী তপুদের কাছে এসে সব কুশল সংবাদ নিয়ে কথায় কথায় জানতে চাইলে—‘আচছা, তুমি ßুñলে যাও? তোমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে!’
—‘হুম, লাগে তো। তবে সবসময় নয়। তাছাড়া অনেক সময় পড়াশোনার সময় কোথায়? জানতো, আমাদের খুব কষ্ট! আমার মা সকাল হলেই পাঁচটা বাড়ির কাজে যায়। আমাকে পড়তেও হয়, আবার বাড়ির কাজও করতে হয় মাকে সাহায্য করার জন্য।’
তপু এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল। লালপরী জানতে চাইল—‘আর তোমার বাবা!’
তপু বলল—‘আমি যখন খুব ছোট, সেই কবেই আমার বাবা তারাদের দেশে চলে গেছে।’
নীলপরী বলল—‘দুঃখ করো না। তোমার কাছে এটা জেনে খুব ভালো লাগলো যে তুমি তোমার মাকে সাহায্য করো। আর যে ছেলেমেয়ে তার মায়ের কথা ভাবে, আমরা তার সহায় হই।’ ওরা চারজন কথা বলছিল, এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালো একটা সবুজ রঙের পরী। সবুজ পরী আসতেই চারপাশের সবুজ গাছপালা, সবুজ পাতা, ঘাস সব্বাই কী খুশিটাই না হলো। ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে লাগলো। এখানে তপুর একটুও গরম বোধ হচেছ না। এখানে সূর্যের আলো সবসময়ই নরম রশ্মি ছড়িয়ে দিচেছ। কতোরকম ফুলের সুবাস নিতে নিতে সবুজ পরী বলল—‘জানো, আমরা এখানে সবাই কতো আন¨ে থাকি। খিদে পেলে ফুলের মধু খাই, তৃষ্ণায় ঝর্ণার জল পান করি।’
তা শুনে তপু বলল—‘তোমাদের এখানে ঝর্ণাও আছে বুঝি!’
হলুদ পরী বলল—‘আছেই তো। শুধু কি ঝর্ণা, একটা আস্ত পাহাড়ও আছে। সেই পাহাড়ের গা বেয়েই নেমে আসছে ঝর্ণার জল।’
এসব কথা বলতে বলতে লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ পরীরা তপুকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় দেখতে গেল। পাহাড়ের কাছে পৌঁছতেই তপু দেখলো একটা বেগুনী রঙের পরী সেই পাহাড়ের গায়ের রাস্তা দিয়ে নেমে আসছে ওদের দিকেই। তারপর একেবারে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো ও। কতো কথা হলো ওদের নিজেদের মধ্যে। তপুর কথা জানলো। এবার তপুর দিকে তাকিয়ে বেগুনী পরী বলল—‘আমাদের এই দেশটা তোমার লাগছে কেমন?’
তপু একটু ইতস্তত করে উত্তর দিলে—‘আমি তো তোমাদের মতো অত সু¨র করে কথা বলতে জানি না। তবে এটা বলতে পারি, আমাদের ভাঙা দাওয়ায় বসে চাঁদের আলো মাখতে মাখতে খিদের পেটে নুন মেখে পান্তাভাত খাওয়ার যে আনন্দ পাই—এখানে এসে আমি সেটাই পাচিছ।’
পরীরা ওর কথা ঠিক বুঝতে পারলো কিনা জানলো না তপু। কেবল দেখলো পাঁচটা পরী ওকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের ওপর চড়তে লাগলো। কিছুটা ওঠার পরে তপুর পা দুটো কেমন টান ধরলো। যেন ভারী হয়ে আসতে লাগলো। পরীরা কিন্তু সবাই তরতর করে ওপরে উঠে যাচেছ, আর তপু ওদের পিছনে পড়ে থাকছে। খুব একটা উঁচু পাহাড় নয়। কিছুটা কষ্ট হলেও যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলো সবাই, তপু দেখতে পেলো ওখানে একটা কমলা রঙের পরী আপনমনে খেলা করছে। কমলা পরী পিছনে ফিরে তাকাতেই ওদের সকলকে দেখতে পেয়ে আন¨ে একেবারে আত্মহারা। কমলা পরীর হাতে ছিল একটা যাদুকাঠি। সেই কাঠির ছোঁয়ায় ও বানিয়ে নিলো হরেকরকম খেলনাপাতি। সেখানে সেই ছয়পরী আর তপু মিলে খেলাধুলো করলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর একসময় ওরা তপুকে বলল—‘চলো, তোমাকে আমরা সবাই মিলে ওই দুঃখ নদী পার করে দিয়ে আসি।’ এসব কিছুর পরে তপুর মুখে আর কোনো ভাষা নেই। ও শুধু চলতে লাগলো ছয়পরীর সাথে পা মিলিয়ে। তপু দেখলো পাহাড়ের ওই পাড়ে একটা নদী বয়ে চলেছে। নদীর জলটা কেমন যেন কালো রঙের বলে মনে হলো তপুর। সেই নদীর বুকে বাঁধা ছিল একটা ডিঙি নৌকো। ছয়পরী আর তপু সেই নৌকোয় চড়ে বসলো। তপু হাত বাড়িয়ে জলটা ছুঁয়ে দেখলো একবার। এপার থেকে ওপারে তিরতির করে বয়ে চললো ডিঙি। একসময় নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছে গেল ওরা। তারপর ছয়পরী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাতে হাত রাখতেই তপু দেখলো ওরা একসাথে মিশে গিয়ে এক সাদা রঙের ঝলমলে পরীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তার নমনীয়তা, তার উজ্জ্বল কোমল পোশাকে পরীকে কেমন সরল মনের বলে বোধ হচিছল। পরীর সাদা পোশাক দেখে বুঝে নিতে একটুও অসুবিধে হলো না ও কতো স্বাধীন, ও কতো ভালো। আসলে সব রঙ মিশে গিয়ে যে সাদা রঙই পাই! সেই সাদা পরী তপুকে বলল—‘এই দেখো, সব পুরনোকে পিছনে ফেলে তোমাকে আবার এক নতুন দেশে নিয়ে এলাম, সবকিছুই নতুন করে পাওয়ার জন্য।’
তপু ওর দুহাত দিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে সবকিছু বলার জন্যে এক অস্ফুট চিৎকারে মাকে ডাকলো—‘মা..., মাগো...।’