ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
নুপগড়ের নাম শুনেছ? দেখো রাজস্থানের ম্যাপে গরম হাওয়ায় যেথায় বালির পাহাড় যেন কাঁপে।
সেথায়—
এক যে ছিল রাজা, তার ছিল এক রানি। প্রজারা সব থাকতো সুখে, ছিল না তো টানাটানি। তাদের ছেলে মিষ্টি ভারী যেমনি হলো বড়, বললো মাকে, ‘ঘুরতে যাবো, তোমরা আদেশ করো।’
হলো বজ্রপাত, মায়ের মাথায় হাত, ‘কোথায় যাবি? কী যে খাবি? বাছা আমায় বল।’
জড়িয়ে ধরে মাকে, রাজপুত্তুর শৌর্য বলে তাকে, ‘ভয়টা কিসের? তোমাদেরই স্নেহাশীষ সম্বল।’
রাজার কাছেও নিতে গেল আদেশ। রাজা বললেন, ‘বেশ। সারা রাজ্য ঘুরে এসো, দেখ নিজের চোখে/ কেমন করে বেঁচে থাকে এ রাজ্যের লোকে।’
রাজপুত্তুর দারুণ ঘোড়সওয়ার। রাত পোহাতেই ছুটিয়ে দিল আরবি ঘোড়া তার।
পুঁটুলিতে বাজরা রুটি আর গুয়ারফলি সবজি বেঁধে দিয়ে, বললে রানি, ‘মনে করে খাস। বাছা আমায় পত্র দিয়ে খবর রোজ জানাস।’
বালির সাগর পার হয়ে ছোটে অশ্বারোহীর ঘোড়া। এলো কত গ্রাম আর হাট, থামলো রাতে ওরা। কোথাও বসে গল্প করে, সবার কথা শোনে। প্রজাদের সুখ দুঃখগুলো রাখে টুকে মনে।
কোথাও আবার দেখতে সে পায় যাচেছ উটের সারি। সারেঙ্গিটা উদাস সুরে বাজলে দূরে মায়ের কাছে মনটা জমায় পাড়ি।
দিন বয়ে যায় এমনই করে, কাটলো কত রাত। মরুভূমির সাগর মাঝে উঠল ঝঞ্ঝাবাত। যায় না কিছুই দেখা। অশ্বারোহী শৌর্য ছোটে বালির দেশে একা। সঙ্গে খাবার শেষ হয়ে গেছে, একফোঁটা নেই জল। মনে মনে মাকে ডেকে শৌর্য বলে, ‘কী করি মা বল?’
সূর্য তখন মাথার ওপর, পৌঁছাল কোন গ্রামে। তেষ্টা কাতর রাজকুমারের দুচোখেতে কালো আঁধার নামে। তার জ্ঞান হারিয়ে গেল আহা খেজরি গাছের ছায়ায়। পশ্চিমেতে সূর্য তখন নিচেছ রাঙা বিদায়। তৃষ্ণা কাতর ঠোঁটের ফাঁকে কে দিল জল ঢেলে। শৌর্য তখন দেখল তাকে চোখ দুটি তার মেলে।
কলসি কাঁখে শুধায় মেয়ে, ‘হে বিদেশি, কোথায় তোমার ঘর? বাপ মা তোমার আসতে দিল এই মরু প্রান্তর?’
শৌর্য ভাবে থাক গোপনে বংশ পরিচয়। দেখি নাহয় অজান্তেতে কী জানি কী হয়! শুধায় হেসে, ‘রাতের মত তোমার গ্রামে পাবো কি আশ্রয়?’
মুচকি হেসে বললো সে যে, ‘আমি মোড়ল গজাধরের মেয়ে। বাপুর কাছে থাকার হুকুম দেখো নাহয় চেয়ে।’
সঙ্গে করে তাকে নিয়ে পদ্মিনী যায় ঘর। আদর করে রাখল তাকে মোড়ল গজাধর।
রাত পোহাতে ভোরের আলোয় দেখল কুমার চেয়ে। দুটো তিনটে কলসি মাথায় যাচেছ চলে গাঁয়ের যত মেয়ে।
অনেক কথাই বললো তাকে মোড়ল গজাধর। শুধায় কুমার, ‘জলের অভাব এখানে ভয়ংকর?’
মোড়ল বলে, ‘মোদের গ্রামের নাম কি তুমি জানো? নাম নিরজলা—তাইত জলের পাবেনা সন্ধানও।’
কী যে হল নিরজলাতে শৌর্য গেল থেকে। পদ্মিনীর দুই চোখে যেন রামধনু যায় এঁকে। দুজনাতে অনেক কথা হয়। দিনে দিনে আরও মিষ্টি তাদের পরিচয়। শেষে একদিন বিকেল বেলায়, যখন আবির আকাশ রাঙায় গজাধরকে শৌর্য শুধায়, ‘পদ্মিনীর হাত দেবেন আমার হাতে?’
মোড়ল মশাই গদগদ, হেসে বলেন, ‘সে তো পরম সৌভাগ্য, আপত্তি কী তাতে? তবু মেয়েকে একবারটি জিজ্ঞেস করতে চাই। মেয়ের মাকে তাড়াতাড়ি খবরটা জানাই।’
কিন্তু এসব শুনে টুনে পদ্মিনী যে নেহাত বেঁকে বসল। ‘বাপু আম্মা থাকবে একলা যাই কী করে এদের ফেলে?’ বললো।
‘তাইলে বুঝি কোনদিনই করবে নাকো শাদি?’ শৌর্য বড়ই উদাস।
দুঃখ হল পদ্মিনীরও, ফেলল দীর্ঘশ্বাস।
‘ওদের এখন বয়স হল। রোজ কে আনবে জল? এদের ফেলে কেমন করে তোদের বাড়ি থাকতে যাবো বল?’
‘আমি যদি নিরজলাতে পুষ্করিণী খুঁড়িয়ে দিতে পারি। তাহলে কি আমার সঙ্গে যাবি মোদের বাড়ি?’
‘ওরে বাবা! মুখেতে তোর বড় বড় বাত! তুই যেন কোন রাজার ছেলে করবি কেল্লা মাত!’
শৌর্য চুপটি করে থাকে। দেখতে চায় পরিচয় তার না পেয়ে পদ্মিনী ভালবাসবে তাকে?
কন্যে বলেন, ‘তুই কি নিজের হাতে তুলে নিবি রে কোদাল?’
কুমার দিল একটা মোহর, ‘কাজ শুরু হোক কাল।’
পদ্মিনী তো অবাক ভারী। ‘চল, রহমত চা’র বাড়ি। বলে দেবেন কোথায় খুঁড়লে পরে/জল বেরুবে ভালো করে।’
রহমত চা’র হাতে ঘোরে তসবি মালা। শুনে বলেন, ‘মেহেরবান খোদাতালা!’
হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান মাটির নিচে কোথায় আছে পানি। পুব পচিছম ওতর দখিন—কোথা থেকে দিচেছ সে হাতছানি। মাটি তুলে, মাটি শুঁকে, দেখেন চারিধার। বলেন, ‘এইখানেতে মাটি খোঁড়া হোক এবার।’
জুটে গেল গাঁয়ের লোকে। কত আশা, উদ্দীপনা ঘনায় সবার চোখে। উঠছে কোদাল, নামছে কোদাল, কোদাল কাটে মাটি। মাটির মায়ের বুকেরই ধন সেই তো সোহাগ খাঁটি। সবার সাথে কাঁধ মিলিয়ে শৌর্য ঝরায় ঘাম। সকাল থেকে সাঁঝ অব্দি কাজ করছে অবিরাম।
নোনা ঘামে ভিজল মাটি হঠাৎ আকাশ কালো। মৃদঙ্গ ঢাক উঠল বেজে, বিদ্যুৎ চমকালো। মাটি আপন আঁচলা ভরে নিচেছ ভরে জল। দু’হাত দিয়ে আকাশ বিলোয় তার যা সম্বল। সবার শ্রমের ভগীরথ আজ গঙ্গা ডেকে আনল। হল্লা করে এ ওর গায়ে মাটি কাদা মাখল। মেয়েরা তোলে রাজস্থানী সুর। তাল দিয়েছে বৃষ্টি তখন টাপুর টুপুর।
‘এইবার?/আর কি কোন বাধা আছে?’ শুধায় কুমার।
পদ্মিনীর মুখ হল রাঙা, মা’র পিঠে মুখ লুকালো।
শৌর্যকে সব জিজ্ঞেস করে তার বাড়িতে মোড়ল খবর পাঠালো।
বরযাত্রীর বহর দেখে অবাক গাঁয়ের সবাই, ‘রাজার ছেলে হল কি ভাই গজাধরের জামাই?’
গজাধরের মাথায় হাত। বিনে মেঘে বজ্রপাত, ‘রাজা গজার কেমন করে করব আমি খাতির?’
শুনে রাজা বলেন, ‘আমি সব ব্যবস্থা করব বরযাত্রীর।’
তাই শুনে—
গাঁয়ের লোকের মনে সবার লাগলো বড় ঘা। ‘কী? আমরা পারবো নাকি খাতির করতে, দেখিয়ে দেবো, আচছা।’
বিয়ে হল সাঙ্গ। ভুরিভোজ খেলেন রাজার যত সাঙ্গ পাঙ্গ।
ভুরিভোজে সবার পাতে পড়েছিল দাল বাটি চুরমা, পেঁয়াজ কচৌরি, বিকানেরী ভুজিয়া, গাট্টে কী সবজি, মেওয়া লাড্ডু, দুধ ফেনি, মালাই দেয়া লস্যি—আরও কত কী! সেসব কখনও খেয়ে দেখেছ কি?
রাজস্থানে এসে তোমরা খেয়ে দেখতে পারো। যখন খাবে এ গল্প কি মনে পড়বে কারো?
এবার—
ছেলে বৌকে নিয়ে চললেন রাজা। আদেশ দিলেন, ‘ওরে বাদ্যি বাজা।’ দারুণ হট্টগোল। ঢুলি বাজায় ঢোল। সারেঙ্গীটার বুকে বাজছে বিদায়—করুণ— সুর। পদ্মিনীর নামে পদ্মদীঘি হল সে পুকুর।