ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
ধান আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও আমরা বন্ধু ছিলাম। পড়তাম একই ßুñলে এবং এক ক্লাসে। তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি ক্লাস ফাইভে। প্রথম দিনে দুটো ক্লাসের পরেই খেলার ক্লাস। গেমস্ টিচার রবীনবাবু সবাইকে নিয়ে গেলেন ßুñলের মাঠে। তারপর দু’দলে সবাইকে ভাগ করে শুরু হল ফুটবল খেলা। ফুটবল ছিল আমার প্রিয় খেলা। নিজে ফুটবল খেলতাম খুব। আর রেডিয়োতে কলকাতার ফুটবল টিমের খেলাগুলির ধারাবিবরণী শুনতাম বাবার সঙ্গে বসে। সেকালে তো টি.ভি ছিল না বাড়িতে বাড়িতে। তাই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো বড়ো ক্লাবের খেলা হলে অনেক সময় পরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো বাড়িতে গিয়ে বসে পড়তাম ম্যাচ দেখতে।
যাই হোক, খেলা তো শুরু হল ßুñলের মাঠে। কিন্তু খেলবো কি! শুরুতেই দুটো গোল খেয়ে বসলো আমাদের টিম। আমার বিপরীত দলের বিধানই সেই গোলদাতা। তখন তার বয়সই বা কতো? অথচ গোটা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে খেলছে সে। অনায়াসে দু’তিনজনকে কাটিয়ে প্রায় সেন্টার লাইন থেকে নির্ভুল নিশানায় গোলে শট নিচেছ। সেই শট রুখতে হিমসিম খেয়ে যাচেছ আমাদের গোলকিপার রতন। পায়ে বল পড়লেই বিধান প্রায় চিতাবাঘের মতো oুততায় ডিফেন্সে ঢুকে মুহূর্তে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে জালে বল জড়িয়ে দিচেছ। আমরা আরও দুটো গোল খেয়ে গেলাম পরে।
বলাবাহুল্য যে, বিধানের মতো একজন অতিoুতিমান ফুটবলারকে পেয়ে খেলার শিক্ষক রবীনবাবু তখন আন¨ে আত্মহারা। অথচ কতটুকুই বা বয়স তখন বিধানের। কিন্তু সেই বয়সেই সে ßুñলটিমের সিনিয়র দলেই অন্তর্ভুক্ত হল। তখন জেলার অন্যান্য ßুñলের সঙ্গে ইন্টারßুñল ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। আমরা বিভিন্ন ßুñলের ছেলেরা ভিড় করতাম সেই টুর্নামন্টে। পরপর কয়েক বছরই আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। ßুñলগুলিতে বিধানের মতো অল্পবয়সী এক দক্ষ ফুটবলারকে নিয়ে সকলেরই তখন বিস্ময় ও কৌতূহল।
এ হেন বিধান যে আমাদের কাছে নায়কের সম্মান পাবে তাতো স্বাভাবিকই। আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকতো বিধানেরা। ßুñলে এক সঙ্গে যাতায়াতের সুবাদে ওর সঙ্গে ভাব জমে উঠতে দেরি হয়নি। আমি বরাবরই ভালো রেজাল্ট করতাম পরীক্ষায়। বিধান পাশ করতো কোনক্রমে টেনেটুনে। একবার তো ফেলই করে গেল। আমি উঠে গেলাম ওর থেকে উঁচু ক্লাসে। তবু ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটা রয়ে গেল। ওর বাড়িতে যেতাম যখন-তখন। গেলেই মাসিমা ছোলাভাজা আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খেতে দিতেন। বিধানের বাবা, যাঁকে মেসোমশাই বলতাম কাজ করতেন একটি কাপড়ের দোকানে। মাইনে সামান্য। কোনক্রমে সংসার চলে বিধানদের।
এরমধ্যে জেলা ßুñল টিমে বিধান ßT্রাইকার হিসেবে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। কলকাতা থেকে আই.এফ.এ-র কর্তাব্যক্তিরা এসেছিলেন সেই ফাইনাল ম্যাচ দেখতে। বিধানের মতো ফুটবলারকে দেখে তাঁরা তো মুগ্ধ। তাঁদেরই উদ্যোগে ও সুপারিশে কলকাতার প্রথম ডিভিশনের একটি ক্লাবে নাম লেখালো বিধান।
বিধান কলকাতায় চলে যাবে। হয়তো আর কোনদিনই দেখা হবে না ওর সাথে। মনটা খুবই বিষণ্ণ। যেদিন আমার বাবা একটি নামী কোম্পানির ফুটবল কিনে এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন--‘যা, এটা বিধানকে দিয়ে আয়। ওর তো নিজের ফুটবলই নেই।’ বাস্তবিকই ফুটবল কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে ßুñলের ফুটবল নিয়ে প্র্যাকটিশ করতো বিধান। সেদিন বিধানের হাতে ফুটবল তুলে দেওয়ার পর দেখি চোখ দুটো ছলছল করছে। আমি বললাম-- ‘ভবিষ্যতে তোকে যেন মোহনবাগান মাঠে দেখতে পাই খেলোয়ার হিসেবে।’
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। বিধানের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগই নেই। সত্যি বলতে কি ভুলেই গেছি ওর কথা। এখন কলকাতায় থাকি। মাঝে মধ্যে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে খেলার মাঠে যাই। হ্যাঁ ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা আর ফুটবল ম্যাচ দেখার নেশাটা তখনও পুরোমাত্রায় রয়েছে।
সেদিন ছিল মোহনবাগানের সঙ্গে অন্য একটি দলের ম্যাচ। আমি তখনও অন্ধ মোহনবাগান ভক্ত। কিন্তু খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই গোল খেয়ে গেল মোহনবাগান। দর্শক গ্যালারিতে তখন প্রবল উত্তেজনা। খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বলছে নানা ধরণের কটুক্তি, বিoুপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কয়েকজন খেলোয়ার বদল হল। তার মধ্যে একহারা, ছিপছিপে শ্যামলবর্ণের একটি ছেলেকে দেখে তাজ্জব হয়ে গেলাম। গোটা মাঠ জুড়ে খেলছে মোহনবাগানের এই নতুন ছেলেটি। পাসিং, ড্রিবলিং, বলধরা এবং ছাড়া সবেতেই অসাধারণ মুন্সিয়ানা। মাঠের খুব কাছ থেকে ছেলেটিকে ভাল করে দেখতে গিয়ে হঠাৎই যেন চমকে উঠলাম। এতো অবিকল সেই চেহারা, সেই মুখ। আমার ßুñলবেলার বন্ধু বিধান। হ্যাঁ, ওকে বলেছিলাম মোহনবাগানে তার খেলা দেখতে চাই। কিন্তু এযে অভাবনীয় আর অসম্ভব! আমার নিজের বয়স এখন পঞ্চাশ। আর ছেলেটি কতো হবে? বড়ো জোর বাইশ-তেইশ! মোহনবাগান গোল শোধ করে আরও একটি গোল দিয়ে এগিয়ে গেল। দুটি গোলই করল এই নতুন ছেলেটি।
হাফটাইমে গ্যালারিতে কিছুটা যেন ঘোরের মধ্যেই বসে আছি। ছেলেটির মুখ-চেহারা আমাকে নিয়ে গেছে বহুকাল আগের ßুñল জীবনে। জীবনে কতরকম অদ্ভুত আর আশ্চর্য ঘটনা ঘটে এইসব দার্শনিক ভাবনায় আচছন্ন হয়ে রয়েছে সব। এমন সময় একটা বহুকালের পরিচিত কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এল কোন্ বহু যুগের ওপার হতে। সুনির্মল না?’ প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে দেখি এক লজেন্স বিক্রেতা। খেলা চলাকালীন ইনি গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে লজেন্স বিক্রি করেন। আগেও দেখেছি এনাকে। শীর্ণ চেহারা। গায়ে বিবর্ণ জামা। চোখে চশমা। গালে কাঁচা পাকা দাড়ি। আমাকে ইনি চেনে কিভাবে! বললাম, ‘চিনতে পারছি না ঠিক আপনাকে।’
‘স্বাভাবিক। বহুকাল দেখা হয়নি তো। কোন যোগাযোগও নেই। আমি বিধান।’ আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি? এই সেই বিধান। মুখ, চেহারা সবই বদলে গেছে। তবে কপালের কাছে সেই জরুল রয়ে গেছে। যা দেখে বিধান বলেই চিনতে পারলাম। আর সেই কণ্ঠস্বর। খুব পাতলা মিহিগলার স্বর ছিল বিধানের। এই ব্যক্তিরও তাই। না ইনিই সেই বিধান। কোন ভুল নেই।
হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বসালাম পাশে। অনেকক্ষণ কথা নেই। কতকালের আগের শৈশব- কৈশোরের ধূসর স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে গোটা মাঠ জুড়ে। হ্যাঁ মোহনবাগান মাঠেই তো বিধানকে দেখতে চেয়েছিলাম। তবে খেলোয়াড় হিসেবে। লজেন্স বিক্রেতা হিসেবে নয়। বিধান যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারল। বলল : ‘ফুটবলার আর হতে পারলাম না। বাবা মারা গেলেন। সাংসারিক চাপ। অর্থকষ্ট। পাকা কোন চাকরিও পেলাম না সেভাবে। এইরকম ছোটখাটো কাজ করেই সংসার চলে কোনক্রমে।
ওর মলিন বিষণ্ণ মুখ দেখে আমারও খুব কষ্ট হল। যে ছেলেটি হতে পারতো একজন নামী ফুটবলার সে কিনা হল লজেন্স বিক্রেতা! প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললাম--জানিস, আজ মোহনবাগানের একটা নতুন ছেলেকে দেখলাম। অবিকল তোর মতো। মানে ছেলেবেলায় তুই যেমনটি ছিলি দেখতে হুবহু ঠিক তেমনটি। আর খেলছিলও ঠিক তোর মতো। যেমন খেলতিস তুই। ওই রকমই সূক্ষ্ম পায়ের কাজ। পাসিং, ড্রিবলিং....।
বিধানের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ চোখ বদলে গেছে মুহূর্তে। বিপক্ষের গোলের জালে বল জড়িয়ে দেবার পর যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতো ওর মুখ-চোখ তেমনই উজ্জ্বলতা ঠিকরে পড়ছে ওর সারা মুখে। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল : ‘তুই যাকে দেখছিস তার মধ্যেই আমি বেঁচে আছিরে! ও আমারই ছেলে। আমি মোহনবাগানে খেলতে পারিনি। আমার ছেলে পেরেছে। আমার স্বপ্নপূরণ করেছে।
এবার আমার আরও অবাক হওয়ার পালা। বিধান বলল--‘জীবন বড় অদ্ভুত রে! বাবার ইচেছ আর স্বপ্ন সন্তানরাও পূরণ করতে পারে। তাতে একধরণের ইচছাপূরণও হয়। এখন আর আমার মনে কোন খেদ নেই। আশীর্বাদ কর, যেন আমার ছেলে আরও বড় ফুটবলার হতে পারে।’