ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
রা তিন সখী, কী সুন্দর দেখতে! যেন সবুজ মখমলের শাড়ি পরা তিন সু¨রী, যেন আকাশ থেকে নেমে আসা রূপকথার তিন পরী! ডানা মেলে এসে বসল, আমাদের মাধবপুরের সুপ্রাচীন দেবতা বংশীবদনের মন্দিরের পাশে; দুশো বছরের চিরসবুজ চাঁপাফুলের গাছটার ডালে! ওরা প্রতিদিন পূর্বদিক থেকে আসে সূর্য ওঠার সময়; সারাদিন কোথায় থাকে কে জানে! তবে আবার দেখি ঠিক বিকেল বেলা সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে পশ্চিম দিক থেকে ওরা তিন সখী আবার এসে চাঁপাগাছের দক্ষিণ দিকে, পঞ্চানন চাটুজ্যের বড় বড় দুটো নারকেল গাছের ডালে গিয়ে বসে ওরা। নারকেল গাছটার সঙ্গেও ওদের খুব বন্ধুত্ব; ওদের সঙ্গেও কত কথা হয় শকুন্তলা-অনসূয়া-প্রিয়ংবদার! তারপর ওরা প্রতিদিনের মত আবার উড়ে যায় পূর্বদিকে কোন গ্রামে কে জানে!
সেদিন বিকেল চারটে, সেই প্রতিদিনের মত আজও আমি এসে বসে আছি আমাদের মাধবপুরের বাড়ির দোতলার ঘরটার সমুখের খোলা বারা¨ায়। শরৎ আকাশের নীল সমুদ্রে এখনো কালো মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে! আলো ছায়ার এই খেলার মধ্যেই দেখি পশ্চিম আকাশের অস্তে যাওয়া সূর্যের আলোর আদর মাখতে মাখতে ওরা অপূর্ব ভঙ্গিতে তীব্র গতিতে ছুটে এসে বসল, তাদের একান্ত ভালবাসার চাঁপা গাছটার আশ্রয়ে!
কিছুদিন আগে, একদিন ভোরে উঠে যখন আমি উদিয়মান সূর্যের অপেক্ষায় পূর্বদিকের আকাশের দিকে তাকিয়ে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছি; সেদিন দেখি ঐ তিন সখী কী সুন্দর ভঙ্গিতে পূর্বদিকের আকাশ থেকে অপরূপভাবে উড়ে এসে বসলো, সবুজ পাতায় ছাওয়া ঠাকুরবাড়ির সেই চাঁপা গাছটার ডালে। আমি সূর্য প্রণাম সেরে তাদের দিকে তাকিয়ে সেদিনেই ওদের নাম রেখেছিলুম--শকুন্তলা, অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা!
কিন্তু আজ আমার মনে হলো ওদের সঙ্গে যদি একটু আলাপ করা যায়, তবে বড়ো ভালো হয়। তাই ওরা চাঁপাগাছটায় যেই এসে বসেছে, আমি ওদের দেখব বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লুম। চাঁপাগাছটার দিকে তাকিয়ে সবুজ পাতার মধ্যে ওরা কোথায় বসে আছে খুঁজতে লাগলুম। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর কানে এলো--‘এ্যাই সন্টে; তুই তো খুব বদমাস। আমাদের তিন বোনের আজে বাজে নাম রেখেছিস--শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা!’
আমি তো অবাক হয়ে চাঁপাগছটার দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার অনসূয়া টিয়াটাই চেঁচিয়ে ঐ কথা বলছে!
আমি তখন বললুম--‘ও অনসূয়া, আমি যে তোমাদের নাম দিয়েছি এ কথা কী করে জানতে পারলে?’
এবার অনসূয়া--‘ট্যাঁ...ট্যা...ট্যা’... করে হাসতে হাসতে বলল--‘ও সন্টে, জানো আমরা তোমাদের মনের কথা জানতে পারি!’
আমি তো আশ্চর্য হয়ে বললুম--‘বলো কী অনসূয়া? সত্যি তোমরা আমাদের মনের কথা জানতে পারো? আচছা বলতো আমি তোমাদের দেখে কী ভাবছিলুম?’
এবারও অনসূয়া আমায় অবাক করে দিয়ে হাসতে হাসতে শব্দ করে বলল--‘টিয়া-টি; টিয়া-টি; টিয়া-টি... কী আর ভাববে; তুমি আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছ; তাই তো?
আমি এবার থমকে গেলুম; কী আশ্চর্য ওরা আমার মনের কথাও জানতে পেরে যাচেছ! আমি তখন নিতান্ত অসহায় হয়ে বললুম--‘ও অনসূয়া, সত্যি তুমি ঠিক বলেছ; আমি তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতেই চাই। অনুগ্রহ করে বলো তোমাদের বাসা কোথায়?’
এবার অনসূয়া একটু রেগে গিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল--যাও, যাও বলব না, তুমি খুব দুষ্টু। তুমি যার তার যা খুশি নাম রাখ। ঐ তো বিল্টু লাহার দোতলা বাড়ি, তোমাদের দুর্গাতলায়; ওরও তো তিনটে মেয়ে! সেদিন ওরা দুর্গাতলায় খেলা করছিল তিন বোনে। তুমি সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচিছলে, ওদের দেখে অমনি বলে উঠলে--‘ও শকুন্তলা; ও অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা!’... ওরা হাসছিল তোমার কথা শুনে। বলো, ডাকোনি ঐ নামে?’
আমি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলুম। বললুম-- ‘ও অনসূয়া, তখন তোমরা কোথায় ছিলে?’
অনসূয়া এবার আরো রেগে গিয়ে র্গ র্গ করে গলার আওয়াজ করে বলল--‘কেন তুমি আমাদের নামটা ওদের দিলে? তোমার সঙ্গে কথা কইব না,-- আড়ি...আড়ি...আড়ি! আমরা তখন ওই নারকেল গাছটার ডালে বসে ছিলুম, সব শুনতে পেয়েছি।’
অনসূয়ার কাছে ধরা পড়ে গিয়ে এবার আমি আরো অনুনয় করে বললুম--‘রাগ কোর না অনসূয়া; আর কখনো এমন করব না।’
কিন্তু এবার অনসূয়ার সঙ্গে প্রিয়ংবদাও বলতে আরম্ভ করেছে,-- ‘ও সন্টে, তুমি আমাদের নাম রেখেছ মানুষের নামে; সে না হয় ঠিক আছে। কিন্তু তোমার নাতনির কেন নাম রেখেছ--‘টুনটুনি’? আবার শশী ন¨ীর মেয়ের নাম রেখেছ--‘বুলবুলি’? আমাদের পাখির নাম কেন রেখেছ ওদের জন্যে?’
এই কথা বলে দেখি প্রিয়ংবদাও আমার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে চোখ টিপে হাসছে! এবার বেজায় ভয় পেয়ে আমি বললুম--‘ও অনসূয়া, ও প্রিয়ংবদা, আমি আর কখনো ওরকম করব না।’
প্রিয়ংবদা বলল--‘ঠিক আছে, দ্যাখা যাক্। তবে তোমার দেওয়া আমাদের নামগুলো বেশ ভালো। আমরা জানি শকুন্তলার কাহিনি। শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদাও তিন সখি; থাকতো কণ্বমুনির আশ্রমে। মৃগয়া করতে এসে রাজা দুষ্মন্তের ভালো লেগে যায় শকুন্তলাকে!
গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে শকুন্তলাকে। যাওয়ার সময় একটা আংটি দিয়ে যায় শকুন্তলাকে। কয়েকমাস বাদে শকুন্তলা রাজসভাতে গেলে রাজা দুষ্মন্ত কিন্তু চিনতে পারেনি শকুন্তলাকে; ভারি বদমাস রাজা! শকুন্তলা রাজার দেওয়া আংটিটা হারিয়ে ফেলেছিল। শকুন্তলা লজ্জায়, দুঃখে, অভিমানে ফিরে এসেছিল কণ্বমুনির সঙ্গে!’
প্রিয়ংবদার কথা শেষ না হতে হতেই এবার অনসূয়া বলল--‘তারপর সেই আংটিটা একটা মাছের পেট থেকে পেয়ে, দুষ্মন্তের মনে পড়লো শকুন্তলার কথা! রাজা দুষ্মন্ত তখন শকুন্তলাকে নিতে এসেছিল মুনির আশ্রমে! শকুন্তলার তখন ভরত নামে একটা সুন্দর পুত্র হয়েছে! শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা আর কণ্বমুনির কাছে ক্ষমা চেয়ে রাজা দুষ্মন্ত তখন শকুন্তলা আর ভরতকে নিয়ে গেল রাজধানীতে; রাজরানি হলো শকুন্তলা!’
এবার প্রিয়ংবদা বলল--‘জানিস সন্টে, ঐ ভরতের নামেই এই ভারতবর্ষ! কী রকম মজার ব্যাপার বলতো?’
আমি তখন, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার কথায় একটু ভরসা পেয়ে বললুম--‘জানো প্রিয়ংবদা, তোমাদের দিদি শকুন্তলা কিন্তু বড়ই সু¨র, খুব ভালো লাগে তোমাদের!’
তখন হঠাৎ দেখি, শকুন্তলা তার অপূর্ব সু¨র ডানা দুটো একটু আলতো ভাবে নাচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল--‘দ্যাখো সন্টে; তোমার ভাল নাম তো বিজন, সেটা আমরা জানি। কিন্তু গত সপ্তাহে রবিবার, তোমাদের আঁটপাড়া বাড়ির পাশে কর্ণেশ্বরের ম¨িরের বাগানে যে স্বর্ণচাঁপা গাছটা রয়েছে, ওখানে বসে স্বর্ণচাঁপার ফল খাচিছলুম আমরা, তখন বেলা প্রায় একটা বাজে। জাড়গ্রামের অরুণ চাটুজ্যের তিন নাতনি তোমাদের গানের ßুñলে তোমার কাছে গান শিখতে আসে। তাদের মা সেদিন মোটর সাইকেলে করে ওদের নিতে এসেছিল। ওরা তোমাকে প্রণাম করছিল যখন, গানের ßুñলের বাইরে এসে, তখন তুমি তাদেরও বলছিলে--‘শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা ভারি ভালো মেয়ে।’ ওদের মা তোমার কথা শুনে খুব খুশি হয়ে তখন হাসছিল। তুমি তো ওদেরও আমাদের নামটা দিয়ে দিলে! তবে তোমার দেওয়া নামগুলো আমাদের তিন বোনের খুব ভালোই লেগেছে। আজ আমরা চলে যাচিছ,... আবার দেখা হবে; আমাদের নামটা আর কাউকে দিও না।’
কথাগুলো শেষ করেই শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা উড়ে চলল পূব আকাশের দিকে; তাদের সবুজ মখমল ডানায় ঢেউ তুলতে তুলতে! সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু তখনো আকাশে লেগে রয়েছে! সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে; এখনি বেজে উঠবে তার আগমনির শাঁখ! এদিকে আমার দুচোখ ভরে গেছে এক অমোঘ বেদনার অশ্রুতে; ‘কেন সে তা কেই বা জানে!’