ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
(১)
ল থেকে ফেরার পথে পানের জন্য মশলা সুপুড়ি কিনবে বলে মধুময় বাস থেকে আগের স্টপেজেই নেমে পড়লো। সামনে দুটো গলি পড়বে। সে দুটো পেরোলেই পানের দোকান। রন্তুদার দোকান। ওখান থেকেই পান নিয়ে বাড়ি ঢুকবে।
বিকেলের আলো পড়ে আসছে। এখনো সন্ধ্যার ঘুরঘুট্টি অন্ধকারটা নামতে বিশ-ত্রিশ মিনিট লাগবে। অবশ্য তারপরই একে একে ল্যাম্পপোষ্টের ভেপার আলো গুলো জ্বলে যাবে।
সামনের গলিটা পেরনোর মুখেই মধুময় দেখলো পাড়ার ভেতরের ফুটপাথটায় সেই দোকানটা। একটা পলিথিনের ছাউনি টানিয়ে নতুন হয়েছে। দুদিন আগেই রথ গেলো। সেই উপলক্ষ্যেই পাঁপড় ভাজা, চপ ভাজার একটা ছুটকো দোকান।
স্টোভ জ্বেলে তাতে কড়াই-এর তেলে চপ ভাজা হচেছ। তেলেভাজার এই গন্ধটায় একটা মন হালকা করা জাদু থাকে বোধহয়। মধুময় পায়ে পায়ে দোকানের সামনে দাঁড়ালো।
--‘কত করে চপ?’
দোকানের ছাউনি বেয়ে একটা বাল্ব ঝোলানো তারের সাথে। এখনো জ্বলেনি সেখানা।
--‘এইত্তো! একটা পাঁচ। দুটো আট টাকা। নিন না; গরম ভেজে দেবো।’
মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার নোটটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ কানে যেন খটকা লাগলো মধুময়ের।
এইবার ভালো করে দোকানের ভেতর তাকিয়ে দেখলো একজন নয়। দুটি বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে দোকানের দায়িত্ব সামলাচেছ। মধুময় এদের এভাবে দেখে অবাক।
স্নেহ আর শাসন দুটোই গলাতে মিশিয়ে বললো-- ‘পরাগ, পলাশ না? তোরা এমন করে ßুñলটা ছেড়ে দিলি!’
পরাগ উঠে দাঁড়িয়ে দোকানের বাল্বটা জ্বেলে দিলো। সামনে এসে বললো-- ‘মাস্টারমশাই আমাদের বড় দাদা যে বড় কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে। অনেক টাকা লাগলো সেখানে বাবার। আর আমি আর ছোটদা তো ßুñলে তেমন পারতাম না পড়াশোনা, তাই বাবা বললো হাতের কাজ শিখতে। আমরা দুভাই এখন পার্কিং গ্যারেজে গাড়ি সারাই এর কাজ শিখছি।’
এইবার পলাশ বললো-- ‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই গ্যারেজের লিটনদা বলেছে আর বছর খানেক কাজ শিখলেই আমরা নিজেরা নাকি গাড়ি সারাইয়ের দোকানও দিতে পারবো।’
(২)
মধুময় এই ঘটনার আকস্মিক বর্ণনায় কিছুটা স্তম্ভিত হতে হতে নিজেকে সামলে নিচিছলো। অথচ এই পরাগ ভীষণ ভালো আবৃত্তি করতে পারতো ßুñলের অনুষ্ঠানে। মধুময় মনে মনে ভাবছিলো--ßুñলে কতবার কতরকমভাবে ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদের ক্লাস নিয়েছে; ছাত্রদের কাছে বলেছে যোগ্যতমদের উদবর্তনের কথা! যোগ্যতমরাই জীবন যুদ্ধে শেষ অবধি টিকে থাকে! অথচ এই যে নিজেদের ইঞ্জিনিয়ার পড়তে যাওয়া বড়দাদার থেকে পড়াশোনাতে একটু পিছিয়ে পড়া পলাশ পরাগের এই লড়াইটা, এটাকে কি বলবে মধুময়! এও তো সেই যোগ্যতম হয়ে ওঠার প্রবল লড়াই-ই!
(৩)
একটা মন উদাস করা ভাবনায় তেলেভাজার গন্ধের জাদুর নেশাটা কেটে গেছে মধুময়ের। মধুময়ের মনে পড়ছে, ওর গ্রামের বাড়ির সেই ছোটদাদুর মুখখানা। সব শরিকদের বিঘা বিঘা জায়গা জমির ভাগভাগিতে সেই নিরীহ ßুñল মাস্টার ছোটদাদু মানুষটা কক্ষনো লড়াই করেননি। পরিজনরা তাঁকে নিজেদের ঝাড়াই বাছাই হয়ে যাবার পর এককোণের মাত্র এক কাঠা জায়গা ‘দয়া করে’ দিতে চেয়েছিলেন। সেখানা ছোটদাদু হেলায় ঠেলে সরিয়ে সে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। উত্তর কলকাতাতে নিজের সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে জায়গা কিনে সুবিশাল বাড়ি করেন এই অকৃতদার মানুষটি। তকন অবশ্য ওই শরিকরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কলকাতায় এনে পড়াশোনার সুবিধা করতে চেয়েছিলো অনেকবার। ছোটদাদু পুরনো চটিতে আর পা গলাননি। পরিবারের অন্যান্য শরিকদের আইনিভাবে অস্বীকার করে উইল করেছিলেন। আর একটা ßুñলবাড়ির জন্য তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিয়েছিলেন। এখন সেখানেই ‘‘বাণীব্রত মেমোরিয়াল’’ নামের হাই ßুñলটা জ্বল্ জ্বল্ করছে।
(৪)
আসলে এই ‘যোগ্য’ হয়ে ওঠার বিষয়টাই বড় অদ্ভুত লাগে মধুময়ের। আজ যা কিছু যোগ্য বলে তোষামোদ পায়, কাল হয়তো তাই-ই অযোগ্যতার অনেক নজির বহন করবে। কে জানে এমন তো কত ভুরি ভুরি নজির রয়েছে!
মনে মনে ঠিক করলো, সন্ধ্যার পর রোজ মধুময় পরাগ আর পলাশকে পড়াবে। ওদের গ্যারেজের কাজ শেষ করে ওরা মধুময়ের বাড়িতে এলেই হবে। ওরা চাইলে ওরা আসতে পারে। মধুময় নিজের মনের ভাবনাটা ওদেরকে সবটুকু বলে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা কার্ডটা পরাগের হাত ধরিয়ে পানের দোকানটায় এগিয়ে চলল।
বাকি পথটা যেতে যেতে মধুময় একা একাই ভাবছিলো--হয়তো বাইরে থেকে যোগ্যতার বিচার করা ভীষণ সস্তা আর সহজ। কিন্তু ‘যোগ্য’ করে কোনো কিছুকে গড়ে তোলার যাত্রাপথটায় সাক্ষী থাকতে পারাটা অনেক সৌভাগ্যের! আর মধুময় শুধু পরাগ পলাশকে তেমন যোগ্য করে গড়ে তোলার পথটায় ওদের পাশে থেকে একসাথে হাঁটতে চায়।