ছোটদের কথা
ছোটদের কথা
পুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি?’’ দেশে দেশে রয়েছে কত নগর, গ্রাম! কত মানুষ! প্রত্যেকটি মানুষ স্বতন্ত্র, তাদের ভাবনাও স্বতন্ত্র। মানুষ যখন তার ভাবনাকে কথায় প্রকাশ করতে শিখল, তখনই সৃষ্টি হতে থাকল সাহিত্য। কিন্তু তখনও এক ভাষার প্রকাশ অন্য ভাষাভাষীর কাছে অধরাই রয়ে গেল। তাহলে এই অচেনাকে চেনা, অধরাকে ধরার উপায় কি! ভাষা না জানলে তো তোমার ভাষা আমার ভাষা হয়ে ওঠে না। সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলি অচেনাই থেকে যায়। এই অজানাকে জানা সম্ভব হয় অনুবাদের মধ্য দিয়ে। সার্থক অনুবাদককে শুধু নিজের ভাষা জানলে হবে না। যে ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করবেন, সেই ভাষাও তার জানা দরকার। স্বদেশের প্রাদেশিক ভাষা সম্পর্কে এটি যেমন সত্য, বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কেও এটি তেমনভাবেই সত্য।
আজ এই লেখার মধ্য দিয়ে এরকম একজন অনুবাদকের কথা তুলে ধরতে চাই। সম্প্রতি প্রয়াত এই অনুবাদকের নাম উইলিয়াম রাদিচে। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক হিসেবে তিনি বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় এক মস্ত কবি। তিনি শুধু বিশ্বকবি নন, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বস্তরেই তার অবস্থান। সুখে দুঃখে, আন¨ ভালোবাসার উপলব্ধিতে তার কবিতা আমাদের মনের কাছে এসে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথ যদিও কল্পনা করেছিলেন, শতবর্ষ পরেও মানুষের কাছে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকবে, তাহলেও অনেকদিন তো হল, বর্ষে বর্ষে নতুন কবির দল উপস্থিত হয়েছে, নতুন নতুন কবিতা সম্ভার নিয়ে।
প্রাচ্যের কথা থাক। পাশ্চাত্যের অনুবাদের মধ্য দিয়ে ধর্মচর্চা পাঠকের কাছে পৌঁছান। রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদের মধ্য দিয়ে যারা জীবন্ত করেছেন অতিসম্প্রতি প্রয়াত উইলিয়াম রাদিচে তাদের মধ্যে একজন। রাদিচের জীবনে তার মায়ের প্রভাব ছিল খুব বেশি। মায়ের ইচছাতেই তিনি অক্সফোর্ডে ইংরেজি পড়াশোনা করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ সম্পর্কে তার জানবার ইচছা ছিল প্রবল। কিন্তু বাংলা না জানলে তো তাদের কাছে পৌঁছানো যাবে না। বাংলা জানার প্রবল ইচছা থেকে তিনি দেশেই ফিরে গিয়ে ßুñল অফ ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভর্তি হলেন। এইবার তার চাকুরী জীবন শুরু হল। তিনি ছিলেন কবি। কবিতা রচনা করেছেন। তিনি যেমন কাব্য রচনা করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা ও ছোটগল্পের অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি তার অনুদিত কবিতার একটি। এছাড়া ‘ডাকঘর’, ‘তাসের দেশ’ ও ‘ঘরে বাইরে’ তিনি অনুবাদ করেন।
রাদিচে কিন্তু শুধু রবীন্দ্রনাথেরই অনুবাদ করেননি। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’রও অনুবাদ করেছেন। স্বামী বিবেকান¨কে নিয়ে বই লিখেছিলেন। ছোটদের জন্য উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’ অনুবাদ করেন।
রাদিচের কাছে আমাদের ঋণের অন্ত নেই। তাঁর বিভিন্ন অনুবাদ সব বাঙালি ভারতীয়দের কাছে এবং বিদেশীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সঙ্গে একজনের পরিচয় থাকা কখনই সম্ভব নয়। বহু ভাষাবিদ ব্যক্তিরও ভাষাজ্ঞানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই অনুবাদক যিনি, তিনি একাধিক দেশের সাহিত্য, সংßৃñতি, সমাজের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন।
১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার পরেও কেটে গিয়েছে বহুকাল। রাদিচে পশ্চিমি দুনিয়ায় রবীন্দ্রনাথকে বহুকাল পরে নিয়ে এলেন। রাদিচের রবীন্দ্রপ্রেম রবীন্দ্রনাথকেও ফিরিয়ে আনলো পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে।
ব্রিটিশ কবি অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে প্রয়াত হলেন ২০২৪-এর ১০ই নভেম্বর। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পিছনে পড়ে থাকলো তাঁর সৃষ্টি সম্ভার।